কাব্যচিন্তা ও কাব্যলোক
জুলফিকার নিউটন ।।
সে ঐশ্বর্য সর্বব্যাপী, একমাত্র কাব্যরচনাতেই তার প্রকাশ-এমন নয়। কবিকে সব দেশেই বলা হয়েছে স্রষ্টা। স্রষ্টার মন অকৃপণ মন। সৃষ্টির প্রদান লক্ষণ তার অজস্রতা। আমরা আমাদের চতুর্দিকে যে সৃষ্টিলীলা দেখছি তার অজস্রতা আমাদেরকে অভিভূত করে। চতুর্দিকে ঝরছে পড়ছে উড়ছে মরছে নষ্ট হচ্ছে অথচ কোথাও কিছুর কমতি নেই। এত অপব্যয়েও ভান্ডার সর্বদাই পূর্ণ। অপব্যয়ের ভয় নাহি তার পূর্ণের দান স্মরি। যাকে অপব্যয় মনে করি সে শুধু সৃষ্টির লীলা। এই যা কিছু মনে করছি নষ্ট হচ্ছে এ আর কিছু নয়-নিয়ে সে সন্তুষ্ট নয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত যেটা উদ্বৃত্ত, যেটা না হলেও চলত সেই উদ্বৃত্তের মধ্যেই তার ঐশ্বর্যের প্রকাশ। সৃজনী মন অর্থাৎ কবির মনও এমনি ভরাট, কানায় কানায় পূর্ণ-খানিকটা সারাক্ষণই ছলাৎ করে উপচে পড়ছে। সেই উদ্বৃত্ত অংশ কাব্যে যতটুকু প্রকাশ পায় তার চাইতে বেশি পায় আলাপে ব্যবহারে, আচারে রুচিতে, চিন্তায় কর্মে। কারণ কাব্যের চাইতে জীবনের ব্যাপ্তি বৃহত্তর। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত জীবনের সাধনা এই উদ্বৃত্তের সাধনা।
মনের সম্পদ যে সব চাইতে বড় সম্পদ সে কথা বলাই বাহুল্য। কবিমনের স্পর্শমণিতে সমস্তই সোনা হয়ে ওঠে। সেটিই কবির আসল ঐশ্বর্য। অবশ্য এ কথা এমন সর্বজনস্বীকৃত সত্য যে এর উল্লেখমাত্র নি®প্রয়োজন। কিন্তু যে কথাটার উল্লেখ প্রয়োজন সেটি হচ্ছে সাংসারিক অর্থে আমরা যাকে ঐশ্বর্য বলি সে ঐশ্বর্যও রবীন্দ্রকাব্যে একটি বিশিষ্ট স্থান গ্রহণ করেছে। এখানে আবার সেই জীবনচরিতের প্রশ্নেই ফিরে আসতে হয়। ঐশ্বর্যবানের গৃহে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। মোগল রাজত্বের অন্তিম পর্যায়ে-ব্রিটিশ আগমনের সুচনায় ঠাকুরবংশের অভ্যূত্থান। বাদশাহী আমলের হালচাল, জাঁকজমক এ পরিবারে প্রবেশ করেছিল। দ্বারকানাথের বিরাট ঐশ্বর্য রবীন্দ্রনাথ দেখেননি কিন্তু তার যে ভগ্নাবশেষ তিনি দেখেছেন তারও তুলনা নেই। প্রিন্স দ্বারকানাথের জীবনে যে রাজসমারোহ রবীন্দ্রকাব্যে সেই সমারোহের সুস্পষ্ট আভাস। পিতা দেবেন্দ্রনাথ মহর্ষি আখ্যা লাভ করেছিলেন, কিন্তু রাজর্ষি আখ্যা বোধকরি তাঁকে আরো বেশি মানাত। তিনি যথার্থই রাজপুত্র। যৌবরাজ্যে অভিষেক। মুহূর্তে তাঁর বনবাস-পিতার ঐশ্বর্য দেনার দায়ে নিঃশেষিত। পিতৃসত্য রক্ষার জন্য অর্থাৎ পিতৃঋণ পরিশোধের জন্য দেবেন্দ্রনাথের দারিদ্র বরণ এবং আপন পৌরুষ বলে হৃত ঐশ্বর্যের পুনরুদ্ধার জন্য দেবেন্দ্রনাথের দারিদ্র বরণ এবং আপন পৌরুষ বলে হৃত ঐশ্বর্যের পুনরুদ্ধার-এ সবের মধ্যে আমাদের প্রচলিত রূপকথার আমেজ আছে। রাজর্ষি আখ্যা এই কারণে দেবেন্দ্রনাথের প্রাপ্য যে রাজ-ঐশ্বর্য লাভ করেও নিরাসক্ত তাঁর মন। ত্যাগের মধ্যেই ভোগের আনন্দ লাভ করেছেন। দেবেন্দ্রনাথের এই দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রগাঢ়তম প্রভাব। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ যে রবীন্দ্রনাথের মনোহরণ করেছেন, ভিক্ষুবেশী রাজা অশোককে যে তিনি পুরুষোত্তমের আসন দিয়েছেন তার মূলে (রাজর্ষি) দেবেন্দ্রনাথের দৃষ্টান্ত। শিবাজীর প্রতি গুরু রামদাসের আজ্ঞা-রাজ্য লয়ে রবে রাজ্যহীন-মহর্ষির জীবনকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। অপর পক্ষে সংসারের সহস্র বন্ধনের মধ্যে থেকেও-লভিব মুক্তির স্বাদ-এ সমস্তই মহর্ষিজীবনের প্রতিধ্বনি। জীবনের উপরিস্তরে রাজসমারোহ, অন্তস্তলে নিরাসক্তি-এ দুই জিনিসই রবীন্দ্রনাথ পারিবারিক আবহাওয়া থেকে পেয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ পার্থিব ঐশ্বর্যের প্রত্যাশী ছিলেন না। কিন্তু ঐশ্বর্যের রূপ তাঁর কবিচিত্তকে মুগ্ধ করেছে (কবি মাত্রেরই মন ঐশ্বর্যবিলাসী)। এই কারণে জীবনে যা কিছু বৃহৎ মহৎ কামিনীয় এবং বরণীয় মনে হয়েছে তাকেই তিনি ঐশ্বর্যমন্ডিত রূপে দেখেছেন। দেবতাকে যখন আবাহন করেছেন, অন্তরতমকে চেয়েছেন তখন তাঁকেও দেখেছেন রাজা বেশে। বলেছেন-রাজাসমারোহে এস। তাঁর দেবতার আগমন স্বর্ণরথে-তুমি তখন চলেছিলে তোমার স্বর্ণরথে / আমি মনে ভাবতেছিলাম এ কোন্ মহারাজ। / ‘মহারাজ, এ কী সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে / গভীর রাতে এসেছে আজ আঁধার ঘরের রাজা / হে রাজেন্দ্র, তব হাতেকাল অন্তহীন।
এমন দৃষ্টান্ত অনেক দেয়া যায়। বরণীয় তা তো বটেই, যা কামনীয় তাকেও রাজা হিসেবেই দেখেছেন এবং রাজসমারোহ তাতে আরোপ করেছেন- রাজার দুলাল গেল চলি মোর ঘরের সমুখ পথে / প্রভাতের আলো ঝলিল তাহার স্বর্ণশিখর রথে।
দেবতার বেলায় যেমন মানুষের বেলায়ও যেখানে মনুষ্যত্বের চরম বিকাশ দেখেছেন সে মানুষকেও তিনি রাজা হিসেবেই দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু কেবল মাত্র বাংলাদেশের স্থপতি নন, তিনি বাংলাদেশের জাতির পিতা। অগণিত মানুষের ওপর যাঁর বিপুল প্রভাব তিনিই যথার্থ রাজা। তাঁর গল্পে যে মানুষ প্রকৃত প্রেমিক, যে নারীর মনোহরণ করেছে সেও রাজা-অন্তর, অন্তর আমার, আমার রাজা, আমার দেবতা। প্রেমের অভিষেক কবিতায় প্রথমেই বলে নিয়েছেন, তুমি মোরে করেছ সম্রাট, তুমি মোরে পরায়েছ গৌরব মুকুট।
যে কালে রবীন্দ্রনাথ নাটক লিখেছেন সেকালে রাজা উজির নিয়ে নাটক লেখার রেওয়াজ প্রায় উঠে গিয়েছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেকটি নাটকেই একটি রাজা আছে। আপাতদৃষ্টিতে এই ভূমিকাটি কোনো কোনো নাটকে অনাবশ্যক মনে হতে পারে। ফাল্গুনী নাটকে ছেলের দল বার্ধক্য এবং মৃত্যুকে উপেক্ষা করে যৌবনের জয়গান করছে। কেন? না, মহারাজের মন খারাপ হয়েছে তাঁর মাথায় পাকা চুল দেখা দিয়েছে অর্থাৎ কিনা যমরাজ কানের কাছে তাঁর নিমন্ত্রণপত্র ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছেন। মহারাজের মন প্রফুল্ল রাখতে হবে, অতএব নৃত্যে গীতে যৌবনের পাল জমাতে হবে। মনে হতে পারে রাজা ব্যাপারটা এখানে অবান্তর হবে, মহারাজের জীবনের মৃত্যুর ছায়া ঘনিয়ে এলে সমস্ত রাজ্যেই মৃত্যুর ছায়া পড়বে। কিন্তু এ আইডিয়া রবীন্দ্রনাথ কোথায় পেলেন? সাহিত্যরসিকের পক্ষে ভাবা অসঙ্গত নয় যে এটি একটি পাশ্চাত্য মিথলজির প্রাচ্য রূপায়ণ। আপাততঃ লক্ষ্য করবার বিষয় যে রবীন্দ্রনাথের নাটকে রাজা-একটি অত্যাবশ্যক প্রতীক।
রবীন্দ্রনাথ যখন সাধারণ মানুষের কথা ভেবেছেন তখনও তাকে রাজার ভূমিকায় দেখতে চেয়েছেন-আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। রবীন্দ্রনাথের সমাজদর্শনে রাজাকে বাদ দিয়ে সকলে মিলে সমান দরের প্রজা সাজতে পারলেই সাম্যবাদী সমাজ গড়ে ওঠে না। আদর্শ মানবসমাজে প্রত্যেকটি ব্যক্তি রাজসম্মানের অধিকারী। সকলে সমান ধনী হলে তবেই সমাজে সমতা আসবে। ধনীকে নির্মূল করে সকলে সমান নির্ধন হওয়াটা সমাজকল্যাণের আদর্শ নয়। সরল অনাড়ম্বর জীবনের কথা নিরন্তর বলেছেন কিন্তু সাংসারিক অর্থে আমরা যাকে বলি দারিদ্র তাকে কখনো তিনি প্রশ্রয় দেননি। দারিদ্রের ললাটে জয়তিলক পরিয়ে একদা আমাদের সাহিত্যে দারিদ্রের জয় ঘোষণা চলছিল, রবীন্দ্রনাথ বহু পূর্বে যথেষ্ট শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর কাব্যে ব্যবহার করেছিলেন-রিক্ত যারা সর্বহারা সর্বজয়ী বিশ্বে তারা-কিন্তু মনে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথের সর্বহারা আজকের দিনের প্রলেতারিয়েত নয়। ভাগ্যর স্বৈরাচারকে উপেক্ষা করে অদৃষ্টকে পরিহাস করার সাহস এবং শক্তি যারা রাখে তাদেরকেই তিনি সর্বজয়ী সর্বহারা আখ্যা দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। এ কালের বহু বিজ্ঞাপিত প্রলেতারিয়েত ডিক্টেটরশিপ বা সর্বহারার রাজত্ব মন ভোলানো স্তোকবাক্য মাত্র; প্রকৃতপক্ষে সর্বহারার দাসত্বই সর্বত্র প্রকট।
রবীন্দ্র-জীবন দর্শনে দারিদ্রের সংজ্ঞা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্তরে যার অপরিমের ঐশ্বর্য দারিদ্র শুধু তাকেই মানায়, দারিদ্র তাকে কলঙ্কিত করতে পারে না। ভিক্ষা শুধু তাঁকেই মানায়, যাঁর কিছুরই অভাব নেই। আমায় কিছু দাও গো বলে বাড়িয়ে দিলে হাত-এই ভিক্ষুক স্বর্ণরথে উপবিষ্ট দরিদ্রের নিলয়। আমরা যে দরিদ্র নিলয় বলি এ শুধু মন-ভোলানো কথা। দরিদ্র মাত্রই নিলয় হয় না, একমাত্র নিলয় তুল্য ব্যক্তিকেই দরিদ্র হলেও মানায়। যিনি ইচ্ছা করলেই ভোগ করতে পারেন কিন্তু বোগে যাঁর স্পৃহা নেই, যিনি ত্যাগের মধ্যে ভোগের তৃপ্তি লাভ করেন দারিদ্র তাঁরই ভূষণ। দরিদ্র জীবনের নিষ্করুণ বাস্তব চিত্র রবীন্দ্রনাথের চাইতে নিপুণতর হাতে এঁকেছেন একাধিক আধুনিক লেখক, সে কৃতিত্ব তাঁদের প্রাপ্য। কিন্তু দরিদ্র জীবনের মহিমা রবীন্দ্রনাথ যেভাবে প্রকাশ করেছেন এমন আর কেউ নয়। ন্যায়াধীশ রামশাস্ত্রী পেশোয়া নৃপতির বিচারশালায় খেলাঘর ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন-তেজস্বী ব্রাহ্মণের সেই দারিদ্রবরণ দারিদ্রকে চিরকালের জন্য মহিমান্বিত করেছে; ছাড়ি দিয়া গেলা গৌরব পদ / দূরে ফেলি দিলা সব সম্পদ,গ্রামের কুটিরে চলি গেলা ফিরে / দীন দরিদ্র বিপ্র।
রবীন্দ্রনাথে যে দারিদ্র্যের ছবি এঁকেছেন তার মধ্যেও একটি ঐশ্বর্যের আভাস আছে। যেই দীন নারী / অরণ্য আড়ালে রহি কোনো মতে / একমাত্র বাস নিল পাত্র হতে / বাহুটি বাড়ায়ে ফেলি দিল পথে / ভূতলে।” সেই নারী কি সত্যিই দীন? এই দান দীনতার দান নয়, অন্তরগত পরম ঐশ্বর্যের দান। লৌকিক অর্থে আমরা যাকে বলি দীনতা রবীন্দ্রনাথ তাকে সর্বান্তঃকরণে ঘৃণা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ মূলতঃ ঐশ্বর্যের কবি। সে ঐশ্বর্যের একদিকে পূর্ণতার সমারোহ অপর দিকে রিক্ততার মহিমা-একই জিনিসের দুই ভিন্ন প্রকাশ। সংসার-জীবনে ঐশ্বর্যের যে দ্বিবিধ রূপ তাঁকে মুগ্ধ করেছে, লক্ষ্য করার বিষয়, প্রকৃতির রাজ্যের সেই দুই রূপেরই বিচিত্র লীলা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের জীবনকাব্য এবং প্রকৃতিকাব্যের মূল তত্ত্বটি প্রধানতঃ এক। ঋতু পর্যায়ে প্রকৃতিদেবী কখনো সম্রাজ্ঞী কখনো তপস্বিনী। তরুলতার শাখা পল্লবিত নাট্যশালায় ছয় ঋতুর বিচিত্র নাট্যাভিনয় তাঁর কাব্যকে বিচিত্র রংএ রঞ্জিত করেছে। ‘নববর্ষা প্রথম যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত রাজপুত্রের মতো তাহার পুঞ্জ পুঞ্জ সজল নিবিড় মেঘ লইয়া আনন্দ গর্জনে চির প্রত্যাশী বনভূমির উপরে আসন্ন বর্ষণের ছায়া ঘনাইয়া তুলিতেছে। শরতে অন্নপূর্ণা ধীরত্রীর বক্ষে শিশিরে সিঞ্চিত, বাতাসে চঞ্চল নানা, বর্ণে বিচিত্র, দিগন্তব্যপ্ত শ্যামল সফলতার অপর্যাপ্ত বিস্তার। বসন্তের তো কথাই নেই। রাজপুত্ররূপী বর্ষার যেমন যৌবরাজ্যে অভিষেক, ঋতুরাজ বসন্তের আবির্ভাব তেমনি ভুবনমোহ নব বর বেশে তার অভ্যর্থনার আয়োজনও রাজকীয়-“বার্তা ব্যাপিল পাতায় পাতায় করো ত্বরা, করো ত্বরা। / সাজাক পলাশ আরতিপাত্রে রক্তপ্রদীপে ভরা। / দাবিড় বন প্রচুর পরাগে / হোক প্রগল্ভ রক্তিম রাগে / মাধবিকা হোক সুরভি সোহাগে মধুপের মনোহরা।”
প্রকৃতির এই এক মূর্তি, যেখানে রাজসমারোহ, অপরদিকে তার নিরাভরণ তপস্বিনী মূর্তি। প্রকৃতির ঐশ্বর্য অফুরন্ত বলেই শীতের প্রকৃতি এমন করে নিজেকে রিক্ত করতে পারে। নিঃশেষে দান করার মধ্যে ঐশ্বর্যের নিঃসংশয় প্রমাণ। ভরা পাত্রটি শূন্য করে সে ভরিতে নতুন করি। সেই কারণেই সঞ্চিত ধনে তার উদ্ধত অবহেলা। এ ছাড়া মনে তার নিরাসক্তি। বর্ষায় বসন্তে যে ভোগের মেলা বসেছিল তার পাট চুকিয়ে দিয়ে এখন সে বসেছে যোগের আসনে ত্যাগের সাধনায়-বৃক্ষশাখা রিক্তভার, ফলে তার নিরাসক্ত মন। বর্ষা বসন্তের বর্ণসমারোহ যেমন কবির মনোহরণ করেছে, শীতের তপঃক্লিষ্ট মূর্তিও তেমনি তাঁকে মুগ্ধ করেছে। রুক্ষ এবং কঠিনের মধ্যেও তিনি কোমলের স্পর্শ দেখেছেন-জ্যৈষ্ঠের খর রৌদ্রই তার অশ্রুশূন্য রেনাদ।
(চলবে...)
========================কবিতা==============================================
প্রেমিক মনজুবাইদা নূর খান
সবুজ শাড়ি লাল পাড়, খোপায় গোঁজা গোলাপ লাল
কত কথা, কত শপথ, দুচোখ ভরা স্বপ্ন জাল।
আমি তোমার পার্বতী গো, ভালোবাসার তাজমহল
কাটিয়ে দিতে পারি জীবন পেরিয়ে বাঁধা বিঘ্ন সকল।
দেখা হবে কাল তোমার সাথে, সূর্য ওঠার মিষ্টি প্রাতে।
ভুল করোনা আনতে ওগো পরবো মালা দুটি হাতে।
কুয়াশা মোড়ানো হিম সকালে,গায়ে জড়ানো পশমী শালে
কথা হবে কত শত, গানের কলি সুযোগ মত।
তোমায় নিয়ে ডুব সাঁতারে আনবো তুলে শালুক ফুল
ইচ্ছে করেই করবো আমি ছোট বড় শত ভুল।
নায়ে চড়ে জ্যোৎস্না রাতে দেখবো তারার লুকোচুরি
শাপলা ফুলের পাপড়ি ছিড়ে ভরবো আমার রঙিন ঝুড়ি।
তোমার কাঁধে মাথা রেখে বুঝবো আমি নই যে একা
প্রেমের কাঠি যাদুর কাঠি, যায়না তারে ঢেকে রাখা।
সম্রাজ্ঞী’র কবিতা বিহনে
বিনিদ্র রজনী কালের সাক্ষী হয়ে
আজিকে বহিছে অবিরত ছুঁয়ে
সারা দেহ মন অবিচলিত হয়ে
কি চলিছে আজিকে যেন ছায়ে।
আঁধারটিকে আলোকিত করা যার কাজ
চলিছে শুধু সে আলোকিত সাজ
টলেনি সে ঘুনাক্ষরে ও সে রাজাধিরাজ
করে চলেছে অবিরত আপনার কাজ।
এসেছিল সন্তর্পণে কি জানি কি করে
কোন বা জাদুর কাঠিটির পরে
টেনে নিলো মোরেআরো বেশি ডোরে
পারিনি আমি পারি নি কো ক্রোড়ে
ছুটে পারি নি পালাতে দূরে।
অদৃশ্য স্নেহের হাতখানি সযতনে বুলায়ে
রেখেছিল মোরে সে তাঁরই বৃক্ষ সম ছায়
আজিকে শুধুই শূণ্যতায় ভরে উঠেছে তায়
পারিনি তারে সরায়ে কোন ক্ষণে অবহেলায়।
সে কাণ্ডারী করেছে কতক পণ্ডিতের মানদণ্ড
গড়িছে সে কতক আলোকের আলয়
তুলিছে কত শিক্ষা বীজ গড়ে ত্রাই নিপুণ কাণ্ড
শত হাজার লক্ষ কোটি ছাড়িবে তারই রচনায়
তবু ও সে থামবে না কভু কোন বন্দনায়।
আজি আর কেহ সে স্নেহের আশীষে
করিবে না মোরে কারও নব মাসে
ডাকিবে না কাছে তারই মত করে
করিবে না আর মোরে রতন সম যতন
লইতে পারবে না টেনে আপনার বচন
নিজের মুখে আমারই অন্তস্থলের বাসন
আজিকে তাহারই শূন্যতায় বিজিছে আঁখি
চারিিেদকে শুধু অপূর্ণতা; অস্থিতি আর পীড়ন
বুঝিনি কখন ও হবে এমন তাড়ন
নিজেকে আর মন চাহে না বিকশিতে
চাহেনা আর নতুন উদ্যম চমকিতে
ইচ্ছে জাগে না কো নব নব কর্মস্পৃহা
একাকিত্বে যেন খণ্ড বিখণ্ড হয়ে সমস্ত হীয়া
লুটিয়ে পড়ে আছড়ে পড়ে যখন দেখি তব বিহন
নিঃশেষ হয়ে যায় যেন সকল ক্ষেত্র অন্তর দহন
আর কেহ পারিবে সেই উদ্যমী মনুষ্যত্বকে ফেরাতে?
না পারবে তাহারি মত মায়াতে আবিষ্ট করতে?
ঠাঁই হবে নাকো আর কারও এমনি করে
সে যে কে ছিল মোর জানে কি অন্তস্থল?
জানে কি সে কি ছিল জগতজুড়ে শ্রেষ্ঠ কর্মস্থল?
আমাকে করিল মানি, সে মান্যবর
এতখানি মূল্যবান করে গড়ে মোরে উঠাল ঝড়
ভিতর বাহির বায়ু অন্করীক্ষ সকল প্রহর
গড়িয়া মোরে হঠাৎ করে অসমাপ্ত রয়ে
রহিলাম সে বিজনে কোন জহর
ঈর্ষনীয় মোহে সকলেরই কাছে
আমার সফলতার শিখরে উঠানোর পাছে
ছিলই কি শুধু কর্তব্য না আর কিছু আছে
কি যেন দুর্বার অভিকর্ষজ ত্বরণের মত সে
টানিছে যেন দুর্ভেদ্য দুর্দমনীয় পিয়াসে
কোন দিক ফিরে চাহিবার অবকাশ না পাই
শুধুই কর্মস্পৃহায় নাকি অন্য কোন অভিলাসে
কত যে আলোকবর্ষ বেগে তাহার হিসাব নাই
আজ আর কি কি থেকেও যেন খুঁজে না পাই
আর কি ম্যাসেঞ্জার এর টুং টাং অনুরণে
আবেশিবে কি মোর মজ্জা দেহ মনে?
কম্পিবে কি আদৌ প্রতিধ্বনিত হবে কি
হৃদ হতে হৃদপিণ্ডে কিংবা শিহরণে?
ভীরু ভীরু মনে প্রতিটার জবাব দিতে যেয়ে
অম্ল মধুর বকাবকি যেন আরো ত্বরান্বিত করে পেয়ে
শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে শক্তপোক্ত না দেখা হাতখানি
আর নিবে না মোরে বারে বার টানি
আমায় খুঁজিবে না আর ঘন্টায় ঘন্টায় সে
সারাদিনমান ভরে রহিবে না চাহিয়া মুখ পানে
কি জানি কি খুঁজে বেড়ায় চক্ষু দুটির পরে
দৃষ্টির ক্লান্তি বলতে বুঝি নাই তাঁর দিব্যলোকে
শাসিবে না কপট রাগে মুখখানি দেখার ছলে
আর ফিরিবে না আমার অক্ষির সম্মুখ পানে
অনুভবে তুমিফারুক সরকার
কুয়াশার চাদরে ঢাকা শীতের সকালে
মনে পড়ে তোমার সোনালি স্মৃতি,
হেমন্তে বয়ে চলা মৃদু সমীরণে
তোমার দরাজ গলায় সেই গীতি।
বসন্তের দখিনা বাতাসে ব্যালকনিতে বসে
তুমি অবলোকন করতে অপরূপ প্রকৃতি,
গাছের ডালে হরেক পাখির আগমনে
কবিতার ক্যানভাসে লিখতে সব অনুভূতি।
উতাল মনে শ্রাবণ ধারা উপভোগে
তুমি ছুটে যেতে গ্রামের বাড়ি,
কখনও নৌকা চড়ে খরস্রোতা নদীতে
তুমি দেখাতে আমায় জ্যোৎস্না রাত্রি।
তোমার স্পর্শের সেই উষ্ণতা অনুভবে
অবচেতন মনে আমি তোমাকে খুঁজি,
তুমি আজও আছো আমার বিশ্বাসে
যেন কুয়াশার আড়ালে সূর্যের জ্যোতি।
তুমি ছিলে মোর জীবন সংগ্রামে
স্বপ্নের বাস্তব রূপায়নে প্রেরণা নারী,
তুমি সতত সতেজ মোর অন্তরে
অনুভবে তুমি আমার কল্পরাজ্যের রাণী।
স্বাধীনতাশাহীন শাহ্
ভূমিষ্ঠ হয়ে যে শিশুটি স্বাধীনতা পেল
যে শিশুটি পেল না- তাদের ফারাক অনেক।
স্বাধীন শিশু থেকে বেড়ে ওঠা জীবন আমার
না পাওয়ার বেদনায় দগ্ধ হতে দেয়নি।
পতাকা থেকে মানচিত্র- মাটি থেকে জলের জানালা
বিগত রক্তের বিনিময়ে উত্তরাধীকারে পাওয়া
স্বাধীনতা আমার সমস্ত ভালোবাসা।
রক্তেমাখা লক্ষ শহীদের স্বাধীনতার স্বপ্ন-
বুক সমান মাটির নিচে ঘুমিয়ে আছে।
বাংলার সবুজ মাটি, আলপথের নরম ঘাসের সবুজ চাদরে
এখনও রক্তের দাগ গান গায়, কথা কয় প্রাণভরে...।
জলের মায়ায় মায়ায় ছায়ায় ছায়ায়
জলের জানালা ভেঙ্গে সমুদ্রের নীরবতায়
ষোড়শীর স্বপ্ন দেখে দেখে চোখ ভাসায়।
যে-শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রিয় মাটির মানচিত্র পেল না
পেল না ষোড়শীর মায়াভরা চামচ চোখের ভাষা
সে-ই শিশুটির দেশহীন জীবন শেষে-
ঠাঁই হবে...
অন্য দেশের গণকবরে-অন্য দেশের গণকবরে।
স্বাধীনতা পেয়েছি এ-মাটির মানব জমিনে
পাইনি কেবল পরম পরার গভীর ভালোবাসা।
৫৩ বছর শেষে গায়েব হয়েগেছে
এ-মাটির মালিকানা...
গায়েব হয়েগেছে লক্ষ শহীদের
রক্তে ভেজা দ্বীপ্ত স্লোগান।
তবুও শান্তি এ-মাটির রুমালে অশ্রু মেখে
গাইতে পারি...
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি
ভালোবাসি বটের ছায়ায় ঝরা পাতার নিঃষ্কণ্ঠের গান
ভালোবাসি স্বাধীন বর্ণমালার সুগন্ধি শরীর...।
জলের জানালা ভেঙে-সবুজ পাসপোর্ট বুকে নিয়ে
পৃথিবীর পথে পথে এই বাংলার পরিচয় ছড়িয়ে দিতে চাই
ছড়িয়ে দিতে চাই প্রিয় বর্ণমালার সুগন্ধি শরীর
ছড়িয়ে দিতে চাই আমার প্রিয় স্বাধীনতার কথামালা...।