সামনে নতুন বছর। শিশুকে কোথায় ভর্তি করাবেন? স্কুলে নাকি মাদ্রাসায়? ইংরেজী মাধ্যম নাকি বাংলা মাধ্যমে? সরকারী নাকি বেসরকারী স্কুলে? প্রাইমারিতে পড়াবেন নাকি কিন্ডারগার্টেন? স্বাভাবিক স্কুলে দেবেন নাকি বিশেষ শিশুদের স্কুলে- এসব নিয়ে প্রায় সব মা-বাবার চিন্তার অন্ত নেই।
আশপাশ থেকে আসে অংসখ্য পরামর্শ। এত পরামর্শের ভিড়ে অধিকাংশ মা-বাবাই বুঝতে পারেন না, কোথায় ভর্তি করাবেন। বেশিরভাগ সময় অন্যের অনুকরণে বা চাপে পড়ে বা বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রলুদ্ধ হয়ে শিশুকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়। অথচ শিশুর বর্তমান সুবিধা অসুবিধা এবং ভবিষ্যতে কী বাস্তবতা মোকাবিলা করতে হতে পারে- এই বিষয়গুলো একবারেই আমলে নেয়া হয় না।
সবাই নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোঁজেন। কিন্তু সেখানে পড়াশোনা হয় কিনা, সেদিকে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমাদের দেশে এমন অনেক নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে আদতে কোনো পড়াশোনা হয় না। অভিভাবকরা নিজ উদ্যেগে সন্তানদের প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়িয়ে ভালো রেজাল্ট অর্জনের চেষ্টা করেন।
পড়াশোনা হয় না- তা জেনেও কেন অভিভাবকরা এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাচ্ছেন। অনেকে নিরুপায় হয়ে ভর্তি করাচ্ছেন, কারণ তাদের কাছে ভালো কোনো বিকল্প নেই। তবে বেশিরভাগই ভর্তি করাচ্ছেন সামাজিক স্টাটাস বা আভিজাত্য রক্ষার জন্য । যেন সবাইকে বুক ভরে বলতে পারেন- আমার ছেলে/ মেয়ে অমুক নামকরা স্কুলে পড়ে। ভাবখানা এমন যে এসব স্কুলে ভর্তি করাতে না পারলে, সমাজে তারা মুখ দেখাতে পারবেন না।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তির কারণ খুজলেও দেখতে পাবেন- এই সামাজিক স্ট্যাটাস বা আভিজাত্য রক্ষার লড়াই। তবে তা সবার ক্ষেত্রে নয়। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি মনে করেন, আপনার সন্তান ভবিষ্যতে দেশের বাইরে পড়াশোনা এবং বসবাস করবে, তাহলে আপনার জন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নির্বাচন করাই সঠিক। কিন্তু শিশুকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়িয়ে, আপনার ভবিষ্যত চাওয়া যদি হয় সন্তান দেশে থাকবে- তাহলে ভবিষ্যত কিছু চ্যালেঞ্জের জন্য আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
আপনার আর্থিক সামর্থ্য কম হলে, যেখানে পড়াশোনার খরচ বেশি সেখানে ভর্তি না করানোই ভালো। যদি ভর্তি করান, তাহলে আপনি দুই দিকে দিয়ে চ্যালেঞ্জে পড়বেন। প্রথমত প্রতিমাসের স্কুলের খরচ বহন করতে গিয়ে আপনাকে হিমশিম খেতে হবে। পাশাপাশি নানা কারণে বিব্রতও হবেন। অভিভাবক যদি ভালো ইংরেজী বলতে না পারেন অথবা আর্থিকভাবে কম সামর্থ্যবান হন, তাহলে কর্তৃপক্ষও আপনার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাবে।
দ্বিতীয়ত, উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুদের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আপনার শিশুও তাদের লাইফস্টাইল অনুকরণ করার চেষ্টা করতে পারে। অথবা নিজেকে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে হীনমন্যতায় ভুগতে পারে। ইংরেজীতে একে বলা হয়- ঢ়ববৎ ঢ়ৎবংংঁৎব। সবাই গাড়িতে করে স্কুলে আসে, দামি স্মার্ট ফোন বা ল্যাপটপ আছে, অথচ আমার নেই- এ ধরনের ভাবনা তাকে সবসময় পীড়া দেবে। দিন শেষে শিশুর হীনমন্যতাজনিত প্রতিক্রিয়া আপনাকেই সামলাতে হবে।
ইংরেজী মাধ্যমে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারা। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না। কারণ এত দিন তারা যে ধরনের পরীক্ষা পদ্ধতিতে অভ্যস্ত ছিল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি সে তুলনায় ভিন্ন। বাধ্য হয়েই একটি বড় অংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, অথবা অন্য বন্ধুদের দেখাদেখি সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় দেশের বাইরে পাড়ি জমায়। অনেক মা-বাবা শিশুকে ইংরেজী মাধ্যমে পড়াতে চান আবার ধর্মীয় শিক্ষাও দিতে চান। এজন্য তারা এমন স্কুল নির্বাচন করেন যেখানে দুটোই আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ ধরনের স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষা প্রাধান্য থাকলেও একাডেমিক কারিকুলাম মূলত পশ্চিমা ধারায়। উন্নত বিশ্বের মুভি, ভাষা, গান, পোশাক, খাবার-দাবার, সংস্কৃতি ইত্যাদির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে এক সময় শিক্ষার্থীরা নিজের পরিচয়কেই ভুলে যেতে বসে। খুব কম শিশুই পারে পশ্চিমা সংস্কৃতির বিপরীতে ধর্মীয় মূল্যবোধকে ধারণ করতে।
অনেকে অভিভাবক তাদের শিশুকে প্রাইমারিতে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে তারপরে বাংলা মিডিয়ামে আনতে চান। তাদের উদ্দেশ্য থাকে- শিশুর ইংরেজীর গাথুনি যেন সুন্দর হয়। সেটা আপনি করতে পারেন। তবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রপ্ত করতে ব্যর্থ হলে, নতুন বাংলা মাধ্যম স্কুলেও শিশু নিজেকে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুক্ষীণ হবে। এতক্ষণ আমার লেখা পড়ে মনে হতে পারে, আমি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বিরুদ্ধে। আসলে তা নয়। আমার বক্তব্য খুব সহজ- কেন আপনি শিশুকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কলে দিচ্ছেন, তা আপনার কাছে পরিস্কার থাকতে হবে। আপনি যদি মনে করেন- ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে আপনার সন্তানকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবেন, আপনার সাথে দ্বিমত করা কোনো সুযোগ নেই। শুধু অনুরোধ থাকবে, এমন স্কুল নির্বাচন করবেন যেখানে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির উপর জোর দেয়া হয়। একই কথা মাদ্রাসার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শিশুকে যদি মাদ্রাসা শিক্ষায় দিতে চান, আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে কেন আপনি সেখানে ভর্তি করাচ্ছেন। কেউ যদি মনে করে মাদ্রাসায় পাস করে সে একজন ভালো মুয়াজ্জিন বা মসজিদের ইমাম অথবা ধর্মীয় শিক্ষক অথবা ইসলামী চিন্তাবিদ হবেন- আমি তাকে সম্মান জানাই। কারণ তার নিয়ত তার কাছে পরিস্কার। তবে মাদ্রাসায় পড়িয়ে সন্তানকে যদি ভালো ডাক্তার বা বিজ্ঞানী বা গবেষক বা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখতে চান, তাহলে অবশ্যই কোন ধরনের মাদ্রাসায় ভর্তি করাচ্ছেন সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ আপনার ভুল সিদ্ধান্ত শিশুর ভবিষ্যত জীবনকে বিপর্যস্ত করতে পারে। তাই এমন মাদ্রাসা নির্বাচন করতে হবে, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি গণিত-বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়।
আবার বাংলা মিডিয়ামে ভর্তির ব্যাপারে একই যুক্তি প্রযোজ্য। সেখানে পড়াশোনার মান কেমন? ইংরেজী ভাষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার উপর জোর দেয়া হয় কিনা? ধর্মীয় বা নৈতিক শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষ কতটা আন্তরিক- এই বিষয়গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
শিশুকে স্কুল বা মাদ্রাসা বা ইংরেজী মাধ্যমে- যেখানেই ভর্তি করান না কেন, কিছু সাধারণ বিষয় অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। ক্লাস রুমের পরিবেশ কেমন? ছাত্রদের সাথে শিক্ষকদের আচরণ কেমন? ক্যাম্পাস পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কিনা? স্কুলে কোন শ্রেণী পেশার পরিবারের শিশুরা পড়ছেন? পর্যাপ্ত খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে কিনা? বইয়ের বোঝা বা পড়াশোনার চাপ কেমন? পরীক্ষার নামে শিশুদের উপর মানসিক পীড়ন দেয়া হয় কিনা? শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করা হয় কিনা? ছাত্র-শিক্ষকদের অনুপাত, স্কুলের বেতন ও আনুসাঙ্গিক খরচ কেমন? প্রয়োজনে যে স্কুলে শিশুকে ভর্তি করাতে চান, সেখানে একদিন গিয়ে দেখে আসুন।
সবকিছু আপনার মন মতো হবে ব্যাপারটি তা নয়। তারপরেও দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নেবেন। বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব, আপনার আর্থিক অবস্থা, স্কুলের সার্বিক পরিবেশ ইত্যাদি সব বিষয় মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিশু স্পেশাল চাইল্ড হলে বিশেষ স্কুলে ভর্তি করানোই ভালো। অটিস্টিক, বাক-প্রতিবন্ধী, অন্ধ শিশুদের পরিচালনা এবং শেখানোর জন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকের প্রয়োজন হয়।
তবে শারিরীক পঙ্গুত্ব থাকার পরেও শিশু যদি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী না হয়, তাহলে সাধারণ স্কুলে ভর্তি করাতে পারেন। এক্ষেত্রে একজন শিশু মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ নিলে ভালো হয়। বেশিরভাগ ডিসলেক্সিক শিশুদের জন্য আলাদা স্কুলের প্রয়োজন হয় না। তবে এই শিশুদের প্রতি স্কুল কর্তৃপক্ষ বিশেষ নজর দিতে পারবে কিনা- এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। আবার আপনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হলে শিশুকে এমন স্কুলে দেবেন না, যেখানে সে বিব্রত হতে পারে। শেষ কথা হচ্ছে- শিশুকে কোথায় ভর্তি করাবেন এ ব্যাপারে আপনি স্বাধীন। তবে আপনার সিদ্ধান্ত শিশুর ভবিষ্যত জীবনে কী প্রভাব ফেলবে- সেটা অবশ্যই বিবেচনায় রাখবেন। যদি ভুল সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে শিশুর ভবিষ্যত ধ্বংসের জন্য আপনিই দায়ী থাকবেন।
প্রার্থনা করি, আপনার সঠিক সিদ্ধান্ত শিশুর ভবিষ্যত জীবনকে সুন্দর করবে।
লেখক: গবেষক
[email protected]