যে লেখকদের লিখেই জীবিকা অর্জন করতে হয় পাঠক এবং প্রকাশকের রুচি অথবা দাবি তারা অগ্রাহ্য করতে পারেন না। আমি পেশাদার লেখক নই, লিখে জীবিকা উপার্জন করি না, জীবনে একবার বছর দুই গবেষণার কাজ ছেড়ে দিয়ে একটি পত্রিকায় নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে কলাম লেখার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। সেই দুবছরেই বুঝতে পারি লেখাকে জীবিকা করা আমার ধাতে পোষাবে না। তারপর নানা রকমের আকর্ষণীয় আমন্ত্রণ সত্ত্বেও লেখাকে জীবিকা অর্জনের প্রধান উপায় হিসেবে গ্রহণ করি নি। লিখি নিজের খুশি মাফিক জীবিকার জন্য গবেষণার পথ বেছে নিয়েছি। পেশাদার নই বটে, কিন্তু লিখেছি তো নিতান্ত কম নয়। সেই ছাত্র বয়স থেকে লিখছি, এবং অসংকলিত বিস্তর লেখার কথা বাদ দিলেও আমার ইংরেজি এবং বাংলায় লেখা বইয়ের সংখ্যা প্রায় শতাধিক হবে। সুতরাং এ প্রশ্ন খুবই সঙ্গত কেন লিখেছি? কী লিখেছি?
ভাতডালের মতোই লেখাপড়ার ব্যাপারটা আমাদের পরিবারে ছিল নিত্যনৈমিত্তিক সংবৃত্তি। শৈশব অতিক্রম করবার আগে থেকেই আমরা জানতাম যেমন আহার- নিদ্রা তেমনই পঠনলিখন প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্মের অঙ্গ। এমনকি বাঘবন্দি খেলার মতো শাদা কাগজে কালিকলম দিয়ে আঁকিবুকিও যে মজার অনুষ্ঠান হতে পারে। তার কিছু কিছু আভাস শৈশবকালেই পাই।
মোদ্দা শিশুকাল থেকেই আমি স্বগৃহে এমন এক আবহাওয়ায় বড়ো হয়েছি যেখানে শুধু বই পড়া নয়, নিজের খুশিমতো লেখাটাও ছিল আবালবৃদ্ধ নারী পুরুষের পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক ক্রিয়া। বয়ঃপ্রাপ্তির পর নানা অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে অবশ্য বুঝতে শিখি এ আবহাওয়াটা কতটা ব্যতিক্রমী, আমি এ দিক থেকে কতটা সৌভাগ্যবান। তা ছাড়া অল্প বয়সেই চিন্তা না করে বুঝেছিলাম যে শুধু ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার লোভে বা খ্যাতির উৎকাক্সক্ষায় বা অর্থোপার্জনের প্রত্যাশায় মানুষ সব সময়ে লেখে না, নিজের ভিতরকার গোপন এবং অপ্রস্ফুটিত কামনা ভাবনা অনুভব আকুতিকে নিজের কাছে উদঘাটিত করবার তাগিদ থেকেও মানুষ লিখে থাকে। পরে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে, অনন্ত্যতন্ত্র সাহিত্যিকদের রোজনামচা এবং চিঠিপত্র পড়ে এবং অনেকের সঙ্গে আলোচনা করে এ প্রত্যয় দৃঢ় হয় যে সাহিত্যকর্মের পিছনে নানারকমের উদ্দেশ্য এবং তাগিদ সচেতন অথবা অচেতন ভাবে ক্রিয়াশীল, যে 'কেন লিখি' এই সরল প্রশ্নের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সরল উত্তর নেই। বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন কারণে লেখেন, একই লেখকের বিভিন্ন লেখা বিভিন্ন তাগিদ থেকে উদ্ভূত হতে পারে। সমাজের হিতসাধনের উদ্দেশ্যে লেখনী ধারণই শুধু মাত্র সংগত, রবীন্দ্রনাথ এই সুস্পষ্ট নির্দেশ তাঁর নিজের সব- কটি উপন্যাস সম্পর্কে খাটে, একথা আমার আগেও মনে হয় নি, এখনো মনে হয় না। শেষের কবিতার ট্রাজেডির ভিতরে যদি সমাজকল্যাণের কোনো বীজ নিহিত থাকে আমার কাছে তা দুনিরীক্ষ; কিন্তু ঐ অসামান্য উপন্যাসের ভাষা, কাহিনী এবং প্রকীর্ণ কল্পনার সমারোহ প্রতিবার পাঠের সময়ই আমাকে গভীর- ভাবে আহলাদিত এবং বিস্মিত করে।
ফলত বাড়ির এই অনুকূল আবহাওয়াতে অল্পবয়সেই লেখা শুরু করি এবং আমার প্রথম লেখা দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। পাঠ্যসূচীর বাইরে আমাদের এইসব স্বরচিত গদ্যপদ্যকে অধিকাংশ শিক্ষক সন্দেহের চোখে দেখতেন- কিন্তু তাতে আমাদের উৎসাহ দীর্ণ হয় নি। স্কুলের চৌকাঠ পেরোবার আগে আমার লেখা একটি নাতিদীর্ঘ রচনার কথা মনে আছে যার উপজীব্য ছিলেন বিদ্রোহী রোম্যান্টিক কবি লর্ড বায়রন- কীটস-এর বিধুর রূপময় প্রমিতির পাশাপাশি বায়রনের দুর্বার, কৌতুকক্ষিপ্র ক্ষুরধার বহমানতা আমার হৃদয়, বুদ্ধি এবং কল্পনাকে আলোড়িত করেছিল। সম্ভবত বয়ঃসন্ধির কিছুটা আগেই হৃদয়হীনা সেই রূপসী রমণী এবং যৌবনচঞ্চল ডন হুয়ানের সঙ্গে কবিতার সূত্রে আমার পরিচয় ঘটে-পিছনে ফিরে বুঝতে পারি সহপাঠীদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সেই আমি প্রথাসিদ্ধ পাঠের সরহদ্দ সীমানা অভ্যস্থ করতে শিখি। খেলাধুলায় আমার না ছিল আকর্ষণ না কোনো দক্ষতা- কল্পনার তনুভূত বায়ু সমবয়সীদের সঙ্গে আমার মানস ব্যবধান বাড়িয়ে চলেছিল।
যদিও আমি আশৈশব কবিতার প্রতি আসক্ত, কাব্যদেবী তাঁর এই দরিদ্র প্রেমিককে কচিৎ করুণা করেছেন। এক সময়ে আমিও নিতান্ত কম পড়া লিখি নি, কিন্তু যে হেতু সারা জীবনব্যাপী অনুশীলনের ফলে যথার্থ কবিতা বিষয়ে আমার মনে নির্ভরযোগ্য কিছুটা রুচি গড়ে উঠেছে, সে হেতু আমার অধিকাংশ পণ্ডরচনাই আমি অশ্রুরিক্ত নির্মমতায় অন্ধকার বিস্মৃতিস্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছি।' কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি নিজেকে কবি বলে ভাবতে পারি না। একটি কথার টুকরো, একটি ছবি, একটি অনুভব অর্থচেতনের অন্ধকারে দীর্ঘদিন ঘুরপাক খায়; যে শক্তির সামর্থ্যে একটি ক্ষুদ্র বীজ একদিন একটি পল্লবিত তরু হয়ে ওঠে, নিজের ভিতরে তাকে খুঁজে পাই না। বরং একটি চিন্তাকে অশিথিল যত্নে এবং অজিত দক্ষতায় পরিস্ফুট করে তোলা আমার কাছে সহজতর ঠেকে। মন মজানোর পর থেকে কবিতা অপাঙ্গে দৃষ্টিপাত করে দূরে দূরেই রয়ে গেলেন, আমার প্রণয়কে প্রশ্রয় দিলেন না-এ দুঃখ আমার অনেকদিনের। তবে ব্যর্থতাকে নিয়ে ঘুরপাক খাওয়া আমার স্বভাব নয়। জীবনে বৈচিত্রের অভাব নেই, কবিতাই ভাষার একমাত্র আশ্রয় বলে কখনো ভাবিনি, প্রেয়সীর জন্য অপেক্ষা করতে পারি, কিন্তু ভোগবৃত্ত অথবা মর্ষকামী হতে পারি না, গদ্যের অথবা তত্ত্বচিন্তার বৈভব আমার সুপরিচিত। কোলরিজের কুবলাই খানের মতো লিট্যারিয়া-ও আমার কল্পনাকে উজ্জীবিত ও ক্ষিপ্র করেছে। সফোক্লিস এবং প্লেটো, ইয়েটস্ এবং রাসেল ভিন্ন জাতের লোক বটে, কিন্তু এঁরা প্রত্যেকেই স্বয়ংসিদ্ধ শিল্পী, এবং এক পক্ষের অনুরাগী বলে অন্যপক্ষকে কম তারিফ করি না।
কলেজে পড়ার সময় থেকেই আমার লিখনপঠন ছুটি সমান্তরাল ধারায় বহমান। সম্ভবত ছাপার হরফে আমার প্রথম প্রকাশিত রচনার উপজীব্য ছিলেন আমার প্রিয় কবি উইলিয়াম বটলার ইয়েটস্ লেখাটি সসংকোচে ছদ্মনামে দশকের একটি বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকায় পাঠাই, এবং লেখার জন্য জীবনে সেই প্রথমবার যৎকিঞ্চিৎ পারিশ্রমিক উপার্জন করি। কবিতা, গল্প উপন্যাস, নাটক- গোয়েটে, হাইনে, রিলকে, বোদলেয়ার, র্যাঁবো, হুইটম্যান, ব্রাউনিং, জয়েস, কাফ্কা, প্রস্ত, পিরান্দেলো, স্ট্রিগুবার্গ, টলস্টয়-ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান- তরুণ বয়সের সেইসব অবিস্মরণীয় দিনে রাতে একটির পর একটি মহাদিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে-গ্রামের বাসিন্দা হয়েও আমি যুক্ত হয়ে চলেছি স্থানেকালে প্রকীর্ণ সেই মানস উত্তরাধিকারের সঙ্গে সারা জীবনভোর ভোগ করার পরও যা অসংকুচিত, অক্ষয়। এটি একটি ধারা। অপর পক্ষে ঐ একই সময়ে আমার অনুশীলনের দ্বিতীয় ধারাটি ছিল তত্ত্বগত বা দার্শনিক প্লেটো, ডেকার্ট, স্পিনোজা, কান্ট, হিউম, মিল, রাসেল, ফ্রয়েড প্রমুখ ভাবুকবৃন্দ বিশ্বজগৎ, মানবতা, সমাজ, নীতি এবং নিজের অন্তর্লোক সম্পর্কে আমাকে ভাবতে শেখাচ্ছিলেন, উপহার দিচ্ছিলেন চিন্তাতীক্ষè সব সাধিত্র এবং সুশৃঙ্খল প্রণালীপদ্ধতি। তবে সেই প্রথম যৌবনে আমার ধ্যানধারণার উপরে গভীরতম প্রভাব ফেলেছিলেন কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিশ এঙ্গেল্স।
কুমিল্লা ভিক্টরিয়া কলেজের লাইব্রেরির বিরাট পাঠাগারে আমার বেশ কয়েকখণ্ড নোটবই মার্কস এঙ্গেল্সের রচনাবলী থেকে উদ্ধৃতি এবং তাদের সম্পর্কে আমার প্রশ্ন এবং মন্তব্যে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। র্মাক্সের প্রকৃতিবাদ, ডায়ালেকটিকস্, ধনতন্ত্র এবং বুর্জোয়া সভ্যতার বিশ্লেষণ এবং তীক্ষè সমালোচনা, সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা বিষয়ে নিশ্চয়তা-এ সবই আমার তরুণ জিজ্ঞাসু আদর্শবাদী মনকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। মার্কসের- ঊপড়হড়সরপ ধহফ চযরষড়ংড়ঢ়যরপধষ গধহঁংপৎরঢ়ঃং তখন পাওয়া সম্ভব ছিল না, কিন্তু ম্যানিফেস্টো এবং জার্মান আইডিয়লজি থেকে ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকনমি এবং ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ড বিশেষ যত্ন নিয়ে অধ্যয়ন করি। মার্কসের লেখা পড়েই প্রথম স্পষ্ট বুঝতে পারি যে সধহ রং ঃযব যরমযবংঃ নবরহম ভড়ৎ সধহ, ধহফ ঃযব পৎরঃরপরংস ড়ভ ৎবষরমরড়হ বহফং রিঃয ঃযব পধঃবমড়ৎু- পধষ রসঢ়বৎধঃরাব ঃড় ড়াবৎঃযৎড়ি ধষষ পরৎপঁসংঃধহপবং রহ যিরপয সধহ রং যঁসরষরধঃবফ, বহংষধাবফ, ধনধহফড়হবফ ধহফ ফবংঢ়রংবফ. পরবর্তীকালে মার্কসীয় চিন্তার অনেক অঙ্গই আমার বিচারে অগ্রহণীয় ঠেকেছে, কিন্তু তাঁর এই মানবতন্ত্রীপ্রতিন্যাস আজও আমাকে প্রেরণা যোগায়।
আমি নিজেও জীবনে অল্পস্বল্প কবিতা লিখেছি, কয়েকটি কবিতার বইও ছাপা হয়েছে, কিন্তু কেন লিখেছি, বা তাদের পিছনে কোনো উদ্দেশ্য ছিল কিনা, এ প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারব না। তবে বাঙালি পাঠকের কাছে আমার পরিচয় মুখ্যত প্রাবন্ধিক গবেষক এবং অনুবাদ হিসেবে এবং প্রবন্ধ আটঘাট বেঁধেই লিখতে হয়। অর্থাৎ সেখানে উদ্দেশ্যের প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক।নিজের প্রবন্ধ নিয়ে কিছুটা নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে গেলে দেখতে পাই সেখানে উদ্দেশ্য মুখ্যত একটাই, কিন্তু তাদের ধারা অন্তত দুটি। আমি যে জগতে জন্মেছি, যে সমাজে বাস করি, যে ভাষা ব্যবহার করি, যে সাহিত্য পাঠ করি, তার মধ্যে বিস্তর নিকৃষ্ট উপাদান এবং গভীর ত্রুটি আমাকে ক্রমাগত পীড়া দেয়। এই সব ত্রুটি, স্খলন, হীনতা, অপসারণ প্রচেষ্টা আমার করণীয় বলে মনে হয় এবং আমার প্রবন্ধে সেই চেষ্টা আকার পায়। আমাদের জীবনযাত্রার, সমাজব্যবহার, ধ্যানধারণার, ভাষা এবং সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধন আমার প্রবন্ধ-রচনার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। এই চেষ্টা দুটি ঢ়প্রধান ধারায় প্রবহমাণ। সংক্ষেপে তাদের কথা জানাই।
আমাদের সমাজব্যবস্থা এবং তার পিছনে যে জীবনদর্শন সক্রিয় তা যে কত মনুষ্যত্ব বিরোধী খুব অল্প বয়সেই নিজের অভিজ্ঞতার সূত্রে সে বিষয়ে সচেতন হই। এই চেতনা প্রথম যৌবনে প্রবলতর হয় রাসেল, মার্কস এবং ফ্রয়েডের রচনাবলী পড়ে। যে জগতে আমার বাস সেখানে প্রায় সর্বত্র দেখতে পাই একদিকে কায়ক্লেশে অর্ধাহারে অনাহারে বহুমানুষের টিকে থাকবার দুর্মর প্রয়াস, অন্যদিকে কিছু বিত্তবান মানুষের অপর্যাপ্ত ভোগবিলাস এবং সম্পদের অপচয়। একদিকে জমিজমা কলকারখানার মালিক, সরকারি আমলা-পুলিশ, নানাসূত্রে প্রতিপত্তিশালী ও সংগঠিত মুষ্টিমেয় মানুষের অত্যাচার, অন্যদিকে অসহায় নিরীহ, দরিদ্র, দুর্বল বহুমানুষের মুখ বুঁজে এই অত্যাচার সহ্য করা। দেখি পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েদের দূরবস্থা অন্তহীন। দেখি দীর্ঘদিনের নিষ্পেষণে, দারিদ্র, শিক্ষাহীনতায় কী ভাবে অধিকাংশ মানুষ আত্মপ্রত্যয়হীন, দৈবনির্ভর, যুক্তিবিমুখ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। আর তারই সঙ্গে লক্ষ করি যারা শিক্ষিত, এই অসম ব্যবস্থায় যারা নানা রকমের সুযোগসুবিধার অধিকারী, যাদের কর্তব্য ছিল এই ব্যবস্থার কুৎসিত স্বরূপ উদ্ঘাটন করে সাধারণ মানুষের মনে সামাজিক রূপান্তরের অভীপ্সাকে জাগিয়ে তোলা, সেই বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর অনেকেই কী ভাবে নানা চতুর উপায়ে এই ব্যবস্থাকেই টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগী। এইসব দেখেশুনে অল্প বয়সেই মনস্থির কবি আমার কলম এই অসাম্য, অন্যায়, অত্যাচার এবং সব কিছু মুখ বুঁজে সয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে লেখায় নিয়োজিত হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের সততায় আমার আস্থা নেই-তাদের একমাত্র সাধনা ক্ষমতা অর্জন, ক্ষমতা লাভের আগে অথবা পরে কোনো সময়েই তারা ন্যায়নীতির নির্দেশ গ্রাহ্য করে না। সুতরাং কোনো দলে যোগ না দিয়ে আমি নিজের র্যাডিক্যাল ভাবনাচিন্তার কথা নিজের মতো করেই লিখেছি। শুধু বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থা এবং তাকে ধারণ করে আছে যে দর্শন দৃষ্টিভঙ্গি তাকেই নানাদিক থেকে সমালোচনা করিনি; তার বিকল্প রূপে কোন ধরনের সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভবপর তাও শব্দ দিয়ে আকবার চেষ্টা করেছি। আমার শিল্পের নন্দনতত্ত্ব- (১৯৮৮), মরমী লালন ফকির- (১৯৯০), খরনবৎধঃরড়হ ্ জবাবষধঃরড়হ (১৯৯২), গঁশঃরলঁফফযঁ ্ গঁশঃরনধযরহর (১৯৯৩), সাহিত্যের সৌন্দর্য- (১৯৯৪), বঙ্গবন্ধু গান্ধী লেনিন- (১৯৯৫), বাংলা গদ্যের গন্তব্য- (১৯৯৮), মুক্তচিন্তা ও মুক্তসমাজ- (২০০১), বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ-(২০০৫), সংগীত সংস্কৃতি- (২০০৬), বাউল লালন রবীন্দ্রনাথ- (২০০৭), মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্ব- (২০০৭), কবিতার শিল্পতত্ত্ব- (২০০৮), রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন- (২০০৯), সুস্থ সমাজের সন্ধানে- (২০১০), সংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব- (২০১১), বাংলার বাউল ফকির-(২০১২), নোবেল বিজয়ী সাহিত্য (২০১৩), বিশ্বের বরেন্য সাহিত্য (২০১৩), নজরুল ও নক্ষত্রলোক- (২০১৪), মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু- (২০১৬), বঙ্গবন্ধু : রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনীতি (২০১৭), স্বাধীনতা ও সুভাষচন্দ্র- (২০১৭), রাজনীতির হাজার বছর- (২০১৮), নারীবাদ ও নারীমুক্তি-(২০১৮), মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তচিন্তা- (২০১৯ ঋৎববফড়স ড়ভ ঝঢ়ববপয - (২০২০), শিক্ষাতত্ত্ব ও শিক্ষাচিন্তা- (২০২১) জীবনবোধ ও জীবনদর্শন (২০২২), মানবচিন্তা ও মানবমুক্তি (২০২৩), চড়বঃ ্ চড়বঃৎু (২০২৪) ইত্যাদি বইতে এবং রচনায় আমার চিন্তার এই ধারাটির কিছুটা পরিচয় মিলবে। আমার এই র্যাডিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি একসময়ে যেমন আমাকে কার্ল মার্কসের রচনাবলীর প্রতি আকৃষ্ট করেছে, পরবর্তীকালে তেমনি বঙ্গবন্ধুর চিন্তাও আমার ওপরে প্রভাব ফেলে। কিন্তু ক্রমেই আমার চিন্তা নিজস্বতা অর্জনের দিকে চলেছে-আমার সদ্যপ্রকাশিত রাজনীতির হাজার বছর বইটিতে তার কিছু আভাস আছে। আমি নিজেকে মার্কসপন্থী বা লেনিন অনুগামী মনে করি না।
কিন্তু আমার মূল উদ্দেশ্য-সংস্কারের, রূপান্তরের, জীবনের সব ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রকর্ষ অর্জন ও প্রতিষ্ঠার-দ্বিতীয় আরেকটি ধারাতেও প্রবাহিত। শিশুকাল থেকেই আমার মন সাহিত্যপাঠের দ্বারা পুষ্ট হয়েছে। আমার ধারণা, মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্ভাবন তার ভাষা এবং ইতিহাসের সব চাইতে বড় বিপ্লব ঘটে অক্ষর বা বর্ণমালার উদ্ভাবনের ফলে। ভাষা মানুষকে মুক্তি দেয় নির্দিষ্ট বিশেষ থেকে অফুরন্ত নির্বিশেষে। আর এই নির্বিশেষ থেকেই উদ্ভূত হয় বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা। অক্ষরের সূত্রে মানুষ দেশকালকে জয় করে, অমরত্ব অর্জনের চাবিকাঠি খুঁজে পায়। প্রাণীমাত্রেই মৃত্যুর অধীন; তবু প্রাণী অমরত্ব খোঁজে সঙ্গমসূত্রে বীজের বপনে; ব্যক্তিমরে, কিন্তু প্রজাতি অনেক ক্ষেত্রেই টিঁকে থাকে। মানুষও অমরত্বের জন্য নির্ভর করে অন্য প্রাণীর মত জননকোষের ওপরে-কিন্তু অন্য প্রাণীদের তুলনায় তার একান্ত স্বকীয় আর একটি চাবিও আছে। পৃথিবী থেকে মনুষ্য সভ্যতার বিলোপ না ঘটা পর্যন্ত সৎসাহিত্য অমর।
আজও আমার গভীর ভাবে প্রাণিত হই যখন পড়ি সফক্লিস অথবা কালিদাস, দান্তে অথবা শেক্সপীয়র, টলস্টয় কিংবা গ্যোয়েটে, গালিব অথবা রবীন্দ্রনাথ। আমরা নিজেরা অমরত্ব অর্জন করতে না পারলেও এইসব ক্লাসিক্স্-এর অন্তরঙ্গ আবেদন আমাদের সচেতন করে তোলে মানুষের ভাষা এবং অনুভূতি, ভাবনা এবং কল্পনা জীবনকে কতখানি সমৃদ্ধ করতে সক্ষম না সম্পর্কে। অমরত্বের স্বাদ যা বহুজনের উপভোগের দ্বারা খর্বিত হয় না, যা ভূগোল এবং সময়ের ব্যবধান অতিক্রম করে ভবিষ্যৎকালেও পৌঁছতে পারে তা মেলে সৎসাহিত্য থেকে।
এখন আমার প্রবন্ধটির একটি ধারা যেমন সমাজের সমালোচনা, বিশ্লেষণ এবং রূপান্তরের উদ্দেশ্যে বহমান, অন্য ধারাটি তেমনি ভাষা এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রে উৎকর্ষের সাধনায় নিয়োজিত। পশ্চিমি সাহিত্য নিয়ে যখন আলোচনা করি তখন মুখ্যত আমার বিচার্য হয় কী ভাবে নিজের জীবনে বিষপান করেও মহৎ সাহিত্যিক তাঁর অভিজ্ঞতাকে অমরত্ব দান করেন। অথবা কী কী কারণে কোনো ভাষায় তথা সাহিত্যে আপজাত্য ঘটে। আমার প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থে শিল্পের নন্দনতত্ত্ব (১৯৮৮) এই আপজাত্যের কারণ বিশ্লেষণ ছিল। বস্তুত দীর্ঘ দিন যাবৎ লিখলেও আমি জনপ্রিয় লেখক নই; আমি কখনো শাস্ত্র অথবা জনমতের অণুসরণ করি না; আমি অধিকাংশ সময়েই নিজের যুক্তি, অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাস অনুযায়ী যা লিখি তা স্রোতের বিরুদ্ধে যায়। তা সত্ত্বেও আমি গত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে অপরিসীম ধৈর্য এবং অধ্যবসায়ে চেষ্টা করে আসছি যাতে বাংলা ভাষার ত্রুটি এবং দুর্বলতা হ্রাস পায়-রবীন্দ্রনাথ বাংলা গদ্যের ভাষাকে যে উঁচু তারে বেঁধে দিয়ে গিয়েছিলেন বাংলা গদ্যের ভাষা যেন অন্তত সেখান থেকে স্খলিত না হয়, এই ভাষা যেন আরো সবল, সমৃদ্ধ, প্রকাশময় হয়ে ওঠে। আমার বিশ্বাস ভাষার সমৃদ্ধায়নের সঙ্গে সমাজ সংকৃতির বিকাশের অচ্ছেদ্য যোগ আছে।
মুস্কিল হল, যেমন ব্যক্তি এবং সমাজের জীবন তেমনি ভাষা এং সাহিত্যের বিকাশ নিয়ম অনুশলীনসাপেক্ষ। কোনো কিছুই ঠিক এক জায়গায় স্থির নেই, ভাঙন এবং মৃত্যু অস্তিত্বে অনিবার্য। কিন্তু আমরা বাঁচতে চাই, সুস্থ ভাবে, মাথা উঁচু করে, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার সূত্রে, স্বাধীন আত্মপ্রকাশের অধিকার ব্যক্তিজীবনের ভোগ করে। কিন্তু তার জন্য চাই নিরন্তর প্রয়াস, সমস্যার সমাধানে বুদ্ধির প্রয়োগ, জ্ঞানের চর্চা, পারস্পরিক সহযোগ এবং সৌহার্দ্য। আমি কেন লিখি? লিখি একদিকে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির গলদ উদ্ঘাটন করে তার বিরুদ্ধে অত্যাচারিত স্ত্রী পুরুষদের মনে ব্যাপক বিপ্লবের ইচ্ছাকে জাগ্রত এবং প্রবলতর করতে; অন্যদিকে যে ভাষা এবং সাহিত্যের সূত্রে মানুষের মন অমৃতের স্বাদ পায় তাকে বলিষ্ঠ, গতিশীল, সমৃদ্ধতর করতে। এই চেষ্টার পথে আমার নিজের ভাষায় বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু সে আর এক কাহিনী।
মোদ্দা কথা আমি জানিয়ে যেতে যাই যে ষাট বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও আমি এখনো পুরোপুরি মানবতন্ত্রী, যুক্তিবাদী, ত্রুটিশীল এই মনুষ্যজাতির অপরিসীম সম্ভাবনায় বিশ্বাসী। আমি জীবনে কখনো শক্তিমান বা বিত্তবানের কাছে মাথা নত করি নি, যাতে মানুষকে স্তোক দেওয়া যায় এমন কোনো কথা লিখি নি বা বলি নি, জনপ্রিয়তা, সামাজিক সম্মান বা পুরস্কার ইত্যাদির চাইতে নিজের বক্তব্যে এবং জীবনে সততাকে অনেক বেশি মূল্য দিয়েছি। শুনেছি অনেকেই আমাকে অহংকারী বলে। আমি অহংকারী, কিন্তু স্বার্থসিদ্ধির জন্য কলম ধরিনি। আমার অস্মিতাকে আমি বহু বাধা বিপত্তি সংকট সত্ত্বেও কখনো খর্ব হতে দিই নি। আমার আশা মৃত্যু পর্যন্ত যেন লেখক, গবেষক এবং মানুষ হিসেবে এই অহংকার বজায় রাখতে পারি।