২০২৪
সালটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য ছিল একটি অত্যন্ত ঘটনাবহুল বছর।
সারা বছর জুড়েই এই খাতটি যেমন নানাবিধ বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছে, ঠিক
তেমনিভাবে কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্যও রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি,
খেলাপি ঋণ, ব্যাংক ব্যবস্থার উপর সাধারন মানুষের আস্থার ঘাটতি ইত্যাদি যেমন
ছিল নেতিবাচক আলোচ্য বিষয়, ঠিক তেমনিভাবে সঞ্চয়, ঋণদান, রিজার্ভ
ম্যানেজমেন্ট ও ডিজিটাল ব্যাংকিং এর ব্যাপক প্রসার ছিল এ খাতে এ বছরের
বিশেষভাবে আলোচিত বিষয়।
এ বছরের শুরুতে প্রতিটি ব্যাংকেরই তারল্য
পরিস্থিতি, আমানত সংগ্রহ ও ঋণদানের প্রবৃদ্ধির হার ছিল বেশ সন্তোষজনক।
কিন্তু ৫ই আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের
চিত্র পুরোপুরি পাল্টে যায়। এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ব্যাংক সমূহ বিশেষ
করে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক,
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংকে
তারল্য সংকট তীব্র আকার ধারন করে। ব্যাংকিং সেক্টরে দীর্ঘ দিন ধরে সুনামের
সাথে ব্যবসা করা আইএফআইসি ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংকও সরকার পতনের সাথে
সাথেই তারল্য সংকটে পড়তে থাকে। কোন কোন ব্যাংক গ্রাহকের ১ হাজার টাকার চেকও
পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। সংকট এতটাই প্রকট ছিল যে এস আলমের মালিকানাধীন
৭টি ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক মিলিয়ে মোট ১২টি ব্যাংক প্রায়
দেওলিয়া হবার দাড়প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল। তবে ব্যাংকিং খাতের এতদ্
অস্থিরতা স্বত্বেও পূবালী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক,
ইবিএল, ব্যাংক এশিয়াসহ আরো কয়েকটি ব্যাংক উন্নত গ্রাহক সেবা, সুশাসন ও
প্রযুক্তির উৎকর্ষতা দেখিয়ে গ্রাহকের মাঝে বিশেষ স্থান অর্জন করতে সক্ষম
হয়। তারল্য সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সবল ব্যাংকসমূহের কাছে ঋণ
সহায়তার অনুরোধ জানিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পূবালী ব্যাংক, ব্র্যাক
ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক দুর্বল ব্যাংক সমূহকে ঋণ সহায়তা
করে। সবল ব্যাংকসমূহের এ সহায়তায় দুর্বল ব্যাংকসমূহের লাখো গ্রাহকদের মাঝে
স্বস্তি আনলেও প্রয়োজনের তুলনায় এই অর্থ সহায়তা ছিল খুবই অপ্রতুল।
ঋণ
বিতরণে ২০২৪ সাল ছিল বেশ মিশ্র। কৃষি ও শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ বাড়লেও এসএমই
খাতে এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে। এছাড়া, উচ্চ সুদ হার, শ্রেণিকৃত
ঋণের ঝুঁকি কমানো, সরকার পরিবর্তন ইত্যাদির কারণে ব্যাংক সমূহ ঋণ বিতরণে
সতর্কতা অবলম্বন করেছে। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ ঋণ বিতরণে অগ্রণী
ভূমিকা পালন করলেও রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ এদিকে বেশ পিছিয়ে
ছিল।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিম্ন হার ২০২৪ সালের অন্যতম আলোচ্য
বিষয় ছিল। রিজার্ভের স্বল্পতার কারণে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য
মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ
ক্রমান্বয়ে কমলেও, ৫ই আগষ্ট সরকার পতনের পর প্রবাসীদের রেমিট্যান্স
প্রেরণের গতি বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি, তৈরি পোশাক রপ্তানিতেও তেজীভাব
পরিলক্ষিত হয়েছে। বছর শেষে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন
ডলার।
সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তীব্র
আন্দোলনের মুখে সাবেক গভর্নর জনাব আব্দুর রউফ তালুকদার সহ কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের সকল ডেপুটি গভর্নরদের পদত্যাগ ছিল ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম
আলোচিত বিষয়। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে সাবেক গভর্নর দেশের সামগ্রিক
খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে মোটেও সফল ছিলেন না। বিশেষ করে, বিদায়ী গভর্নরের আমলে
খেলাপি ঋণের পরিমান ১২% এ দাড়িয়েছিল। বিদায়ী গভর্নরের ব্যর্থতার পেছনে
স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার অভার এবং বৃহৎ ঋণ খেলাপিদের লাগাম টানার ব্যর্থতা
ছিল অন্যতম প্রধান কারন। ড: ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার
পর পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক
চেয়ারম্যান জনাব ড: আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর করা হয়।
নতুন গভর্নর দায়িত্ব গ্রহণের পর অস্থির ব্যাংকিং সেক্টরকে স্থিতিশীল করার
প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। বিশেষ করে তিনি খেলাপি ঋণের লাগাম টানা, বৈদেশিক
মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ, ডিজিটালাইজেশন, তরুন
উদ্যোক্তা ও নারী উদ্যোক্ত সৃষ্টির প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। এদিকে গত
সরকারের আমলে নিয়োগকৃত বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা
পরিচালকদেরকে সরিয়ে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। অনেক ব্যাংকের
পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়।
নতুন গভর্নর
দায়িত্ব গ্রহনের পর নতুন টাকা না ছাপাবার কথা বললেও পরে তিনি তার অবস্থান
থেকে সরে আসেন। বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকগুলো যখন সাধারণ গ্রাহকদের চাপে
হিমশিম খাচ্ছিল, তখন উপায় না দেখে নতুন করে ২২,৫০০ কোটি টাকা ছাপিয়ে দুর্বল
ব্যাংক সমূহকে তারল্য সুবিধা দেবার ঘোষণা দেয় কেন্দ্রিয় ব্যাংক।
অথনীতিবিদদের মতে এই বিশাল অর্থের যোগানের ফলে কতিপয় দুর্বল ব্যাংক সমূহ
সাময়িকভাবে লাভবান হবে, কিন্তু পাশাপাশি এর ফলে আগামী বছর মূল্যস্ফীতি অনেক
বৃদ্ধি পাবে।
এদিকে, দুর্বল ব্যাংকের সাথে সবল ব্যাংকের একত্রিতকরনের
সংবাদটি ছিল এ বছরের অন্যতম প্রধান আলোচিত বিষয়। বিগত সরকারের কতিপয় কর্তা
ব্যাক্তিদের লাগামহীন দুর্নীতি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে আর্থিক অবস্থা
ক্রমশ খারাপ হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক উপায়ান্ত না দেখে কয়েকটি দুর্বল
ব্যাংককে ইন্ডাস্ট্রির সবল ব্যাংকের সাথে একত্রিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহন
করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের পর পুরো ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে
মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে, দীর্ঘ দিন ধরে সুনামে সাথে
ব্যবসা করা ব্যাংকসমূহ দুর্বল ব্যাংকের সাথে একত্রিত হতে এবং তাদের
দুর্নীতির ভাগিদার হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তবে সরকার পতনের পর এই
একত্রিকরণ প্রক্রিয়াটি অনেকাংশেই স্থিমিত হয়ে যায়।
ডিসেম্বর মাসে
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংক সমূহের আলটিমেট বেনিফিশিয়ারি ওনার কারা, এই
সংক্রান্ত তথ্যাদি জানতে চেয়ে একটি সার্কুলার ইস্য করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের
এই সার্কুলারটি নি:সেন্দহে আগামীতে সমগ্র ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও
জবাবাদিহিতা নিশ্চিতকরণে বিশেষ ভুমিকা রাখবে। এদিকে করোনা মহামারির পর
বাংরাদেশ ব্যাংক অনলাইন ও হাইব্রিড প্লাটফর্মে বোর্ড ও অন্যান্য কমিটি সভার
করার অনুমতি প্রদান করেছিল যা এ বছর বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার দিয়ে বাতিল
করে দিয়েছে। সরকার পতনের পর আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ
রহমান ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের
গ্রেপ্তারও ছিল ২০২৪ সালে ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম গরম খরব।
তবে,
এতদ্ নেতিবাচক সংবাদ স্বত্বেও টেকসই ব্যাংকিং এ ২০২৪ সালে বেশ কিছু ব্যাংক
যথেষ্ট অগ্রগতি লাভ করেছে। ব্যাংকিং সেবাকে গ্রাহকের দৌড়-গোড়ায় পৌঁছে
দেবার ক্ষেত্রে এ বছর বেশ কয়েকটি ব্যাংক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
শক্তিশালী প্রায় প্রতিটি ব্যাংকেরই শাখা ও উপ-শাখার সংখ্যা অনেক বিস্তৃতি
লাভ করেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তা ও নারী উদ্যোক্তা বৃদ্ধির জন্য
প্রায় প্রতিটি ব্যাংকই বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। ব্যাংকগুলোতে প্রযুক্তির
ব্যবহারও আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই
ধারাবাহিকতায় বেশ কয়েকটি ব্যাংক ব্লক চেইন প্রযুক্তির ব্যবহার করে লেনদেনের
নিরাপত্তা বিধানের উদ্যোগ নিয়েছে। বছরের শুরুতে গত সরকার কয়েকটি
প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করেছিল। মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান “নগদ” সর্বপ্রথম ডিজিটাল ব্যাংকের
লাইস্যান্স লাভ করে, যদিও সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক এই লাইস্যান্স
বাতিল করে দেয়।
পরিশেষে, যদিও ২০২৪ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য
মিশ্র অভিজ্ঞতার বছর ছিল। এই একটি বছর এই সেক্টরে যে পরিমানে উত্থান-পতন
দেখা গেছে তা দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে অদ্যাবধি এমন পরিস্থিতি এর আগে কখনো
দেখা যায় নি। এ বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীতে শক্তিশালী
ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বছরের শুরু থেকেই কাজ করতে হবে। তবে যাই
হোক, সর্ব ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরন তথা উন্ন্য়ন
এবং চ্যালেঞ্জ এই দুই এর যুগল উপস্থিতি এবং কার্যকর নীতিমালা গ্রহনের
মাধ্যমে এই খাতের সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
লেখক: সহযোগী সদস্য, দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)
আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, কুমিল্লা।