দেশের
বুদ্ধিজীবীরা যে পরিমাণে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের
স্বার্থকে যুক্ত করতে পেরেছেন, সেই পরিমাণেই তারা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন
করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তুলতে। কিন্তু বলাই বাহুল্য,
বুদ্ধিজীবী সমাজের সব মানুষ সব সময়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকেননি। তারা
বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন নিজেদের স্বার্থকে জনসাধারণের স্বার্থ থেকে স্বতন্ত্র
হিসেবে দেখে। এটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত
পরিণত বয়সের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে। বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন এ দেশের উঠতি
মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি চিরদিনই আত্মস্বার্থসচেতন।
তরুণ বয়সে আত্মত্যাগের সাহস থাকে, পরিণত বয়সে আসে বিষয়বুদ্ধি। তাই পরিণত
বয়সের বুদ্ধিজীবীরা স্বভাবতই সজাগ ছিলেন, ছিলেন আত্মসচেতন। এর আরও একটা
কারণ ছিল।
উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভিত্তি ছিল অর্বাচীন ও দুর্বল। তাই
এই শ্রেণির লোকদের পক্ষে কোনো ঝুঁকি নেওয়া কঠিন ছিল। দেশ ভাগের আগে মুসলমান
মধ্যবিত্তরা দেখেছিল অবিভক্ত বাংলার তুলনায় অধিকতর পুরোনো ও প্রতিষ্ঠিত
হিন্দু মধ্যবিত্তের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে তাদের নিজস্ব শ্রেণিগত
বিকাশের সুযোগ খুব সংকীর্ণ: আশা ছিল পাকিস্তানে সেই বিকাশ অনেক সহজ ও দ্রুত
হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মধ্যবিত্তদের মধ্যে তাই একটা ব্যস্ততা
দেখা গিয়েছিল নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার।
বুদ্ধিজীবীরাও ব্যস্ত ছিলেন।
কিন্তু সুবিধা যতটা আশা করা গিয়েছিল ততটা পাওয়া যায়নি। সুযোগ অবাধ হয়নি,
কিছুটা দ্রুত হয়েছিল যদিও। হিন্দুরা চলে যাওয়ায় চাকরি খালি হয়েছিল, সেগুলো
পাওয়া গেল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। হিন্দু মধ্যবিত্তের জায়গায় নতুন প্রতিযোগী
এসে জুটেছে, পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত, যারা আগে থেকেই অনেকটা
প্রতিষ্ঠিত ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য তো বটেই, বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের প্রধান যে
অবলম্বন চাকরি, সেই চাকরির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে শক্তিশালী
প্রতিযোগী হয়ে দেখা দিল তা নয়, চাকরির তারা মালিকও হয়ে রইল। ছোট-বড় সব
রকমের চাকরির। স্পষ্ট সত্য হয়ে দাঁড়াল এই যে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের
অসন্তুষ্ট করলে জীবিকা অর্জনের পথ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে, তুষ্ট করলে
উন্নতি কিছু ঘটতে পারে। প্রধানত, এই অর্থনৈতিক কারণেই বাংলাদেশের
বুদ্ধিজীবী সমাজের একাংশ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল, সরে
গিয়ে পাকিস্তানের গুণগানে ব্রতী হয়েছিল। এই কাজ করে তাদের লাভ হয়েছে
ব্যক্তিগতভাবে। তা ছাড়া সামনে প্রত্যাশার একটা দিগন্তও দেখা যাচ্ছিল।
বুদ্ধিজীবীদের
প্রলোভন দেখানোর কাজ পাকিস্তান সরকার শুরু থেকেই করেছে। উদ্দেশ্যটা সহজ।
সরকার চেয়েছে জনসাধারণকে শোষণ করতে বুদ্ধিজীবীরা যদি জনসাধারণের অংশ হয়ে
যায়, জনসাধারণের সঙ্গে থাকে, তবে তারা মানুষের চোখ খুলে দিতে পারে, চোখ
খুলে দিলে শোষণ করতে অসুবিধা। আর যদি বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে পাকিস্তানের মহিমা
প্রচার করানো যায় তাহলে শোষণ কাজটা আরও নির্বিঘ্নে হতে পারে।
বুদ্ধিজীবীদের জীবনে যেহেতু অভাব ছিল সচ্ছলতার এবং লোভ ছিল স্বাচ্ছন্দ্যের,
তাই অল্পতেই তারা আকৃষ্ট হতেন। চাকরিতে উন্নতি, পুস্তকের জন্য পারিশ্রমিক
পরবর্তীকালে তমঘা ও পুরস্কার, বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ এসবের সাহায্যে জনসাধারণ
থেকে বুদ্ধিজীবীদের বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস সরকার করেছে, সক্ষমও হয়েছে,
অনেক ক্ষেত্রে।
বুদ্ধিজীবী সমাজের, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক,
ব্যবহারজীবী- এদের মধ্যে বিশিষ্ট যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাদের প্রায়
সবার জীবনেই সমৃদ্ধি এসেছে। তাই পাকিস্তানের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতাবোধ না
থেকে পারেনি, তাদের জীবন ও সাধারণ মানুষের জীবন বিপরীত দিকে চলেছে,
অনিবার্যভাবেই। তুলনায় যারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন কম তাদের পক্ষেও সরকারি
বক্তব্য সমর্থন না করে উপায় থাকেনি। এর কারণ তাদের জীবনে অর্থনৈতিক
নিরাপত্তাবোধের অভাবটা ছিল আরও বেশি, তারা ভয় পেয়েছেন যে, সামান্য
ধাক্কাতেই তারা গড়িয়ে পড়বেন নিচের খাদে। এবং ধাক্কার আশঙ্কা সব সময়েই ছিল।
সরকার শুধু প্রলোভনই দেখায়নি, ভয়ও দেখিয়েছে। প্রলোভনের তুলনায় ভয় কিছু কম
শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেনি। ভয়ের জন্য ভুলকে ভুল, অন্যায়কে অন্যায় বলে
প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। মধ্যবিত্তের মনেও অর্থনৈতিক অসন্তোষ ছিল কিন্তু সেই
অসন্তোষ কিংবা তার চেয়েও বড় অসন্তোষ সাধারণ মানুষের অসন্তোষকে উন্মোচিত
করার মতো পর্যাপ্ত সাহস বুদ্ধিজীবীদের অনেকের মধ্যেই দেখা যায়নি। ভয়টা
কল্পিত ভয় ছিল না।
বামপন্থি বলে পরিচিত যারা, প্রয়োজনবোধে তাদের
কারাগারে নিক্ষেপ করার ব্যাপারে সরকার দ্বিধা করেনি। অন্যদিকে অবাধে চিন্তা
ও মতামত প্রকাশের সুযোগ বা স্বাধীনতা কোনো দিনই ছিল না বাংলাদেশে। যেমন,
পত্রপত্রিকা প্রকাশের কথা উল্লেখ করা যায়। এমনিতে এই কাজটা দুরূহ ছিল
অর্থনৈতিক কারণে। তদুপরি পত্রিকা প্রকাশ করতে হলে আগে অনুমতি নিতে হতো
সরকারের। সরকারের অপছন্দ হলে চালু পত্রিকা যেকোনো সময়ে বন্ধ করা হতো।
সম্পাদককে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়ার উদাহরণও অজানা নয়।
১৯৭১-এর গণহত্যা যখন
শুরু হয়, তখন বাংলাদেশের মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি মর্মান্তিকভাবে বেজেছে যে
ঘটনা, সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ড। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের মানুষ
যে যেখানে ছিল এই ঘটনার পর নিশ্চিত জেনেছে যে, পূর্ণ স্বাধীনতা ভিন্ন অন্য
কোনো পথে বাঙালির বাঁচার উপায় নেই।
বুদ্ধিজীবীদের যে অংশ জনতা থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়ে সরকারের তাঁবেদার হিসেবে কাজ করেছে, তাদের প্রতি সরকারি
পৃষ্ঠপোষকতা মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে। ৬৮ সালে অগ্রগতির ১০ বছরের গুণকীর্তন
করে যখন প্রায় প্রতিদিন সংবাদপত্রে একটি করে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত
হচ্ছিল, যখন প্রতিদিন মস্ত মস্ত ছবি ছাপা হচ্ছিল আইয়ুব খানের, তখন সেই
সমারোহ যেমন করে বিদ্বিষ্ট করে তুলছিল পাঠকদের (যার খবর প্রচারকরা রাখত
না), তেমনিভাবে প্রলুব্ধ ও স্তাবক বুদ্ধিজীবীদের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার
বর্ধিষ্ণু সমারোহও ঘৃণার সৃষ্টি করেছিল মানুষের মনে। বিশেষ করে আইয়ুব
রাজত্বকালে, কেননা সেই কালেই উদ্যোগ-আয়োজনটা বেড়েছিল সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ
মীরজাফরদের জন্ম যেমন দিয়েছে, তেমনি তাদের ঘৃণা করতেও কার্পণ্য করেনি।
তার
চেয়েও বড় কথা, এই সুবিধাভোগী ও ক্ষেত্রবিশেষে নির্বোধ, বুদ্ধিজীবীদের
লেখায়-বক্তৃতায় ফল হয়েছে হিতে বিপরীত। তারা যা ভালো বলেছেন, জনসাধারণ
নিশ্চিত জেনেছে যে, তা মন্দ না হয়ে যায় না। তারা যার পক্ষে থেকেছেন,
জনসাধারণ তার বিপক্ষে গেছে। অবশ্য এরা পক্ষে যত না বলেছেন, বিপক্ষে বলেছেন
তার চেয়ে বেশি। কেননা, এদের প্রধান চরিত্র হচ্ছে বর্জনবাদীর। এরা বলেছেন,
ইকবাল অতি মহৎ কবি, বাংলাদেশের মানুষ সেই মহত্ত্ব দেখতে পায়নি। এরা বলেছেন,
রবীন্দ্রনাথকে বর্জন কর। যত বলেছেন এই কথা, তত জনপ্রিয়তা বেড়েছে
রবীন্দ্রনাথের, তত বেশি দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশের মানুষ আঁকড়ে ধরেছে রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ কবি থাকেননি, তিনি জাতীয় বীরে পরিণত হয়েছেন, তার গান
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এরা বলেছেন, বাংলা ভাষাকে
ইসলামি করো। যত বলেছেন, তত বেড়েছে সমগ্র বাংলা ভাষার প্রতি মানুষের প্রীতি ও
আকর্ষণ।
হরফ বদলানোর পরামর্শ সবাই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। এরা
বলেছেন, নজরুল ইসলামের সংস্কার আবশ্যক, সাধারণ মানুষ বলেছে, নজরুল ইসলাম
আমাদের একান্ত আপনজন। এরা বলেছেন, পুথিসাহিত্যই আসল সাহিত্য, সাধারণ পাঠক
বুঝে নিয়েছে পুথিসাহিত্যের পক্ষে ওই প্রচারে ফাঁকি আছে। মোটকথা, এদের কাজ
সম্পূর্ণ বিপরীত ফল উৎপাদন করেছে। তার কারণ এই যে, সাধারণ মানুষ জানত এরা
তাদের স্বার্থের শত্রু, এরা তাদের বন্ধু নন, এদের উদ্দেশ্য পশ্চিমাদের
শোষণব্যবস্থাটাকে কায়েমি করে রাখা।
এভাবে জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন
যেসব বুদ্ধিজীবী, তারাও নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, পরোক্ষে জনতার উপকারই
করেছেন। জনতার দৃষ্টি খুলে দিতে তারাও সাহায্য করেছেন, এই করে জনতার
আন্দোলনকে তারাও এগিয়ে দিয়েছেন।
বুদ্ধিজীবী সমাজের যে অংশ সাধারণ
মানুষের সঙ্গে ছিল, তারা বিবেকবান ছিলেন সত্য, কিন্তু তারাও আসলে নিজেদের
স্বার্থেই কাজ করেছেন, তবে তফাৎ এই যে, তাদের স্বার্থকে তারা জনসাধারণের
স্বার্থ থেকে ভিন্ন করে দেখেননি। এবং উভয়ের স্বার্থ যেহেতু ছিল এক ও
অভিন্ন, তাই তাদের কাজের ফলে জনসাধারণের আন্দোলনের উপকার হয়েছে।
পাকিস্তান
আন্দোলনের পেছনে কোনো দার্শনিক প্রস্তুতি ছিল না, যদিও পরবর্তীকালে প্রচার
করা হয়েছিল যে, বিশিষ্ট জীবনদর্শনের প্রয়োজনেই স্বতন্ত্র রাষ্ট্র
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের আন্দোলনও কোনো গ্রন্থপাঠ থেকে শুরু হয়নি।
কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা এই আন্দোলনে ছিলেন। এই আন্দোলনে তারা সরাসরি নেতৃত্ব
দেননি, আন্দোলন যখন এগিয়ে গেছে তখন তার গতির সঙ্গে সমতা রক্ষা করতেও হয়তো
তারা পারেননি, পিছিয়ে পড়েছেন। তবুও তারা সঙ্গেই ছিলেন, তাদের প্রত্যক্ষ ও
পরোক্ষ উভয় ভূমিকাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময়
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সভা করে গুলিবর্ষণের নিন্দা করেছেন। ফলে তাদের
ভেতর থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। উনসত্তর এবং একাত্তরের আন্দোলনের সময়
শিক্ষকরা রাজপথে শোভাযাত্রা করেছেন।
এসব ঘটনা ছোট ঘটনা। কিন্তু এগুলোর
তাৎপর্য আছে। তাৎপর্য এই যে, বোঝা গেছে বিক্ষোভ সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। তার
চেয়ে বড় কথা, বোঝা গেছে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব মানুষ এক হয়ে গেছে। সেই একতার
দরুনই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
জনতার সঙ্গে চলা বুদ্ধিজীবী সমাজ জনতার
অগ্রবর্তী অংশ হিসেবেই কাজ করেছে। পাকিস্তানের ব্যর্থতার লক্ষণ প্রথম ধরা
পড়েছে তাদের কাছেই, পরে তারাই প্রমাণ পেয়েছেন সেই ব্যর্থতার। তারাই বুঝেছেন
ভাষার ওপর আক্রমণের অর্থ কী, অর্থনীতির গতি কোন দিকে। সেই জ্ঞানকে তারা
সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। বাকি কাজটা সাধারণ মানুষ নিজেরাই
করেছে। বাংলাদেশকে তারা স্বাধীন করে নিয়েছে নিজের হাতে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়