আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ বিষয়ে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও লক্ষ করা যাচ্ছে। সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সংস্কার প্রস্তাব অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছে। এরই মধ্যে নির্বাচন কখন হবে, কীভাবে হবে, সেই আলোচনা চলছে। মোটাদাগে বলা যায়, মূলত নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষা লক্ষণীয় মাত্রায় সামনে আসছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সময় নিয়ে একটা ধারণা দিলেও তাতে সন্তুষ্ট হয়নি কোনো কোনো রাজনৈতিক দল।
সন্তুষ্ট না হওয়া রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে, নির্বাচনের বিষয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে যে সময়ের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, সেটি তাদের সঙ্গে আলাপ না করেই হয়েছে। ফলে সংস্কার নাকি নির্বাচন- এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্ন চিন্তাও আসতে শুরু করেছে। কোনো কোনো দল দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। আবার কোনো দল প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন চায়। বিএনপি এবং অন্যান্য দল বলছে, নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য না দেওয়ায় সরকারের সঙ্গে তাদের দূরত্বও তৈরি হচ্ছে। ইতোমধ্যেই আমরা লক্ষ করেছি যে, অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়েও নানা আলোচনা-সমালোচনা বিএনপির ভেতরে।
মূলত তারা দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকায় এই মুহূর্তে সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিবেশকে দ্রুত কাজে লাগাতে চায়। তারা মনে করে, এ সরকার ব্যর্থ হলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে। এতে বিএনপি আবার ক্ষতিগ্রস্তও হয়ে উঠতে পারে। আবার অন্য কোনো মেরূকরণ তৈরি হলে বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ চলে আসতে পারে। বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কিছু কর্মকাণ্ড ও নির্বাচন নিয়ে অস্পষ্টতায় সন্দেহ, অবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে বিএনপি নেতাদের মধ্যে। আবার সম্প্রতি দি ইকোনমিস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি তার নিজের কাজে ফিরতে চান। কাজেই আমার কাছে মনে হচ্ছে নির্বাচনি রোডম্যাপ স্পষ্ট না হলেও মোটামুটি নিশ্চিত যে নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এর আগেও প্রধান উপদেষ্টা তার দেওয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণে উল্লেখ করেন যে, নির্বাচনি যাত্রা শুরু হয়েছে। এমনকি সে ক্ষেত্রে তিনি প্রসঙ্গক্রমে জানান, স্টেশন বসানোর কাজ চলছে। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশনও জানিয়েছে, তারা কাঙ্ক্ষিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য প্রস্তুত এবং সেটি তাদের পক্ষে সম্ভব হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্রনেতৃত্বের কয়েকজন সরকারে রয়েছেন। তাদের পক্ষ থেকে নতুন দল গঠনের কথা বলা হচ্ছে। এর পেছনে রাষ্ট্র ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আছে কি না, সেই সন্দেহ তৈরি হয়েছে কোনো কোনো মহলে। বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা একটি দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকের কাছে বলেন, ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ প্রধান অংশীজন রাজনৈতিক দলগুলোকে আঘাত করে বক্তব্য দিচ্ছেন। অভ্যুত্থানের একক কৃতিত্ব তারা নিতে চাইছেন। কখনো কখনো অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডও বিএনপির কাছে বিরাজনীতিকীকরণের চিন্তা বলে মনে হচ্ছে। সরকার দলগুলোকে প্রতিপক্ষ ভাবছে কি না, সেই প্রশ্নও আছে। কারণ, সরকার রাজনৈতিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে না। তাদের পক্ষ থেকে নতুন দল গঠনের পেছনে রাষ্ট্র ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আছে কি না, সেই সন্দেহ তৈরি হয়েছে বিভিন্ন মহলে।
যে টানাপোড়েনই হোক না কেন, যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সবার সহযোগিতা থাকা উচিত। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বিদ্যমান থাকলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সংশয় এবং জীবনযাত্রার সংকট ক্রমেই বাড়তে থাকবে। স্বাধীনতার পর বিগত প্রায় ৫৩ বছরে বাংলাদেশে ১২টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি রাজনৈতিক সরকারের অধীনে, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থটি যথাক্রমে জেনারেল জিয়া ও এরশাদের সামরিক সরকারের অধীনে। ষষ্ঠ, দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দলীয় সরকারের অধীনে। পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ভিন্ন মডেলের সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এমনকি আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকারের অধীনে।
এ কথা বললে ভুল হবে না যে, বাংলাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সূত্রপাত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধান থেকে মুছে যাওয়ায়। ওই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে পুনর্বহালের দাবিতে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ছিল। তাদের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে একাত্ম ছিল জামায়াত। এ অবস্থায় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিরোধী দলকে সংসদে এসে সব সংকট নিরসনের আলোচনা করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সেটির সুষ্ঠু সমঝোতা তখন ঘটেনি এবং পরিস্থিতি অমীমাংসিতই থেকে যায়। এরপর বিএনপির পক্ষ থেকে সংসদ নির্বাচন ও রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে একাধিকবার সংলাপের আহ্বান জানানো হলেও তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে খুব বেশি সাড়া পাওয়া যায়নি।
নব্বইয়ের দশকে দেশে সামরিক শাসনমুক্ত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে তিন জোটের রূপরেখায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- এমন একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানে উল্লেখ হওয়ার পরও বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি সরকারের শেষে নির্বাচন-পূর্ব নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন প্রশ্নে সংকট স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছিল। কখনো সংকট থেকে সুষ্ঠু উত্তরণ ঘটেছে আবার কখনো রাজনৈতিক ঘোলাটে পরিবেশ জাতির জন্য চরম দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। এমনকি রাজনীতিবিদরা তাদের প্রদত্ত গণতন্ত্র কায়েমের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকার করা হয় কিন্তু গণতন্ত্র কিংবা গণতান্ত্রিক পরিবেশে কোনোটাই রক্ষিত হয় না।
বাংলাদেশে নির্বাচনের উদ্দেশ্য হলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পুনঃপ্রবর্তন। কারণ গণতন্ত্র আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। সত্যিকারের গণতন্ত্র তথা গণতান্ত্রিক শাসনের কার্যকারিতা বহুলাংশে নির্ভর করে নিয়মিত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমার আহ্বান, নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সমঝোতা এবং পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে পুনরায় ক্ষমতা ধরে রাখার নতুন ফন্দি করতে সচেষ্ট না হয়ে বাস্তবিক অর্থে আইনের শাসন এবং গণতন্ত্র রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিন। আমরা চাই সত্যিকার নির্বাচন এবং সত্যিকার গণতন্ত্র। এ জন্য শুধু নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার নয় বরং নির্বাচন-পরবর্তী করণীয় তথা দেশ কীভাবে চলবে, কী ধরনের উন্নয়ন এবং নাগরিকবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে- সেসব আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে সবাইকে ইতিবাচক অঙ্গীকার রক্ষা করার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যাল