রোববার ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪
১৫ পৌষ ১৪৩১
রাজনৈতিক দল ছাড়া দেশ এগোবে না
আবুল কাসেম ফজলুল হক
প্রকাশ: শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২:০৩ এএম |

  রাজনৈতিক দল ছাড়া দেশ এগোবে না
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার অল্প কিছুদিনের জন্য ক্ষমতায় এসেছে। বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কারের পরিকল্পনার সুযোগ তারা নিতে পারে না। দেশে নির্বাচিত সরকার হলে তারা সংবিধান সংস্কার করতে পারবে। এই সরকার সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব পেশ করতে পারে। এমন অবস্থা যদি হয় যে, নির্বাচন হওয়ার পর নির্বাচিত সরকার সংবিধান সংস্কার করে পুনরায় আগের অবস্থায় নিয়ে আসে, তাহলে তা হবে দুঃখজনক। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, নির্বাচিত সরকার আসলে সংবিধান পুনরায় সংস্কার করে আগের অবস্থায় নিয়ে যায়। সংবিধান সংস্কার হলেও তা আগের মতো ফিরে আসুক তা আমরা চাই না। নির্বাচিত নতুন সরকার আসতে যদি একটু সময়ও লাগে তাতে সমস্যা নেই। সরকার হোক জনগণের আস্থার। আমরা চাই রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের স্বার্থে কাজ করুক। জনগণকে জানিয়ে যেকোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসুক। 
সংবিধান সংস্কার নির্বাচিত সরকার এসে করবে। শেখ হাসিনা ১৫ বছর দেশে রাজত্ব করেছেন এবং নির্বাচনি ব্যবস্থাকেই ভেঙে দিয়েছেন। জনগণকে জানিয়েই নির্বাচন করতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার বিগত নির্বাচনগুলোয় অনেক ভুল করেছে। আমরা সেই অন্যায়গুলো সম্পর্কে সচেতন হতে পারি, যাতে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আমরা সার্বিক সংস্কার চাই। সার্বিক সংস্কার ওপরের কোনো নির্দেশে করে দিলেই কি সুফল হবে? জনগণের ভেতর থেকে সংস্কার আসতে হবে। যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে জনগণের ভেতর থেকেই সংস্কার আসতে হবে। ১৯৭২ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের রাজনীতি নিচের দিকেই যাচ্ছে। দেশকে ভালো কীভাবে করা যাবে, অতীতের ভুলগুলো কীভাবে শোধরানো যেতে পারে, সে ব্যাপারে কোনো চিন্তাভাবনা নেই। বাংলাদশের কোনো রাজনৈতিক দলই শোধরানোর সুযোগ দিচ্ছে না।
গত ১০০ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতা থেকেও অনেক কিছু পরিবর্তন করা যায়। জনগণ যদি মনে করে আগের অবস্থাই ভালো ছিল, তাহলে সেভাবেই হবে। আর জনগণ যদি মনে করে অনেক পরিবর্তন হওয়া দরকার, তাহলে পরিবর্তন হতে হবে। জনগণের ইচ্ছার বাইরে কখনোই যাওয়া যাবে না। 
সংবিধান সংস্কার করা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। তাদের কাজ হলো কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যায়। এর অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে কোনো কাজ করতে গেলে তার বৈধতা পাবে না। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল মাঝে মাঝেই আমাদের সতর্ক করেছে যে, অন্তর্বর্তী সরকার দল করতে গেলেই অনৈক্য দেখা দেবে এবং সেটা ভুল করবে। অন্তর্বর্তী সরকার দল গঠন করতে পারে না। তারা কী জনগণের ভেতর থেকে এসেছে? এরা তো বাইরে থেকে একটা কৌশলের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। 
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কি কোনো বুদ্ধিজীবী, জ্ঞানী মানুষ ও কোনো রাজনৈতিক নেতা গঠন করেছে? বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরোপিত একটি আদর্শ নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করা যাবে না। তারা বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় সাময়িকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি করতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার দিয়ে রাজনীতির কোনো উন্নতি হবে না। তত্ত্বাবধায়কের ধারণাটাও ভুল। রাজনীতি রাজনীতিবিদদেরই করতে হবে। যে রাজনীতিবিদরা ব্যর্থ হয়েছেন তাদের ভোট না দিয়ে নতুন রাজনীতিবিদদের ভোট দেবেন। রাজনীতিবিদদের চিন্তা ও আদর্শকে যাচাই করেই ভোট দিতে হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই জাতির অর্থনীতি ও রাজনীতির উন্নতি করতে হবে। রাজনীতির উন্নতি হলে অন্যান্য উন্নয়নের পথও সুগম হয়ে যায়। 
২০২৫ সালের শেষ বা ২০২৬ সালের শুরুতে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা এখনো অস্পষ্ট। ১৯৭২ সালের পর থেকেই আমাদের দেশে ভালো কোনো রাজনৈতিক দল গঠিত হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলের নামে যারা কাজ করছে তারা রাজনীতি পরিত্যাগ করে ভগ্ন ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে। জিয়াউর রহমান জনপ্রিয় হয়েছিলেন, কিন্তু কেন জনপ্রিয় হয়েছিলেন? আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষ বিরাগভাজন হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বৈরী মনোভাবের কারণেই জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা বেড়েছিল। সে কারণেই বিএনপি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। 
রাজনৈতিক দল বলতে যেটাকে বোঝায়, বিএনপি এখনো সেটা অর্জন করতে পারেনি। শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা ভাসানী পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কিছুটা দল হয়ে উঠেছিল। পরে তা আর রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ধরে রাখতে পারেনি। রাজনৈতিক দল গঠন করা এত সহজ জিনিস নয়। আমরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো রাজনৈতিক দল চাই না। যে রাজনৈতিক দল জনগণের পক্ষে  কাজ করে ধীরে ধীরে দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে, আমরা সেই রাজনৈতিক দল চাই। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মনোভাব কোনো রাজনৈতিক দলেরই নেই। রাজনীতিতে সক্রিয় যেসব বুদ্ধিজীবী তাদের মধ্যেও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা নেই। বুদ্ধিজীবীরা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে এখন অনেকটাই বিরক্ত। এই দেশে ভালো কিছু করতে হলে ভালো রাজনীতি দরকার। 
আধুনিক রাষ্ট্রে অবশ্যই রাজনৈতিক দল দিয়ে সরকার গঠন করতে হবে। ইরানের মতো দেশ; যারা একান্তভাবে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের জন্য নিবেদিত, তাদের মতো দেশেও রাজনৈতিক দল আছে। বাংলাদেশের মতো দেশে রাজনৈতিক দল না থাকলে কি দেশ এগিয়ে যাবে? রাজনৈতিক দল বাদ দিয়ে দেশে কি কখনো গণতন্ত্র হয়? রাজনৈতিক দল বাদ দিয়ে রাষ্ট্র কল্যাণকর হবে? কখনোই হবে না। রাজনৈতিক দল গঠন ও সঠিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নেতাদের ঠিক থাকতে হবে। পৃথিবীর সব জায়গাতেই নতুন চিন্তাভাবনা তরুণদের মধ্যে জগ্রত হয়। তরুণদের চিন্তাও তরুণ ছাত্রদের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। রাজনৈতিক দলের যত ছাত্রসংগঠন, যেমন-  ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন; তাদের মধ্য থেকে কোনো নতুন চিন্তার বিকাশ দেখি না। 
২০২৪ সালের জুন-জুলাইয়ে যে কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছে তা ছিল যুক্তিসংগত আন্দোলন। এবারের গণ-অভ্যুত্থানে যে আন্দোলন হয়েছে তাতে কি কোনো ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল ছিল? এরা কি আদৌ কোনো রাজনৈতিক দলের সংগঠন? এখানে ছিল সাধারণ ছাত্র এবং তাদের অদম্য ইচ্ছা। বাংলাদেশের রাজনীতির উন্নয়ন কীভাবে হবে? 
বাংলাদেশ অনেক সম্ভাবনাময়। কারণ এ দেশে খনিজ সম্পদ, কৃষিসম্পদ ও মানবসম্পদের অভাব নেই। কিন্তু যারা ক্ষমতায় আসেন, তারা এগুলো বোঝেন না। অনেক সময় বুঝলেও না বোঝার ভান করেন। রাজনৈতিক দল অবশ্যই দরকার। দেশে রাজনৈতিক দলের যে কি গুরুত্ব তা কেউ বোঝার চেষ্টা করেন না। 
আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল নিয়ে সরকার গঠন করতে হবে। দেশে গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দলের বিশেষভাবে দরকার। ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করতে গেলেও রাজনীতি দরকার। রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। দল গঠন না করে রাজনীতি বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা ঠিক নয়। বাংলাদেশে বর্তমান যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্র, আইএমএফ বা ড. ইউনূসের কাছ থেকে এসেছে। 
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর পার হয়েছে, কিন্তু আমাদের রাজনীতির কি কোনো উন্নয়ন হয়েছে? স্বাধীন রাষ্ট্রকে কি রক্ষা করার সব ব্যবস্থা হয়েছে? আমাদের যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, দেশের বুদ্ধিজীবীরা কি তা পূরণ করতে পারছেন? বুদ্ধিজীবীদের আরও চিন্তাশীল হওয়া দরকার। অল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবী হলেও তাদের জাতীয় চিন্তা মাথায় আসা উচিত। আগের দিনে জনগণ কিছু মানুষের ওপর আস্থা রেখেছিল, যেমন- আহমদ শরীফ, বদর উদ্দিন উমর, মানিক মিয়া, মনসুর আহমেদ; এ রকম আরও অনেকেই ছিলেন। এখন সেই রকম মানুষের খুব অভাব, যারা দেশকে নিয়ে চিন্তা করেন। তাহলে কী করে আমাদের দেশ ভালো হবে? দেশকে ভালো করতে হলে বুদ্ধিজীবীদের সাহসের সঙ্গে কথা বলতে হবে এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।  
লেখক: রাষ্ট্রচিন্তক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও  বাংলা একাডেমির সভাপতি  













সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লায় আবাহনী ও গাজীপুরে রহমতগঞ্জ জয়
জিন্স পরে আসায় টুর্নামেন্ট থেকেই বাদ ৫ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন
হকির ফাইনালে মুখোমুখি নৌবাহিনী-বিমানবাহিনী
নিতীশের অভিষেক সেঞ্চুরি, সুন্দরের ফিফটিতে ভারতের স্বস্তি
শাহিন আফ্রিদির চোখে বাংলাদেশিরাই বড় তারকা
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লার সাবেক এমপি বাহারের বিরুদ্ধে আরেক মামলা
কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও হিসাব রক্ষকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ এর মামলা
২৫ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা মহানগর বিএনপির প্রথম সম্মেলন
জেল-জরিমানায়ও থামছে না ফসলি জমির মাটি কাটা
৫ হাজার ইয়াবা পাচারকালে একই পরিবারের ৩ জন আটক
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২