রোববার ৫ জানুয়ারি ২০২৫
২২ পৌষ ১৪৩১
নিভৃত ভাবনা ও কতিপয় প্রশ্ন
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২:৩০ এএম |

  নিভৃত ভাবনা ও কতিপয় প্রশ্ন
প্রত্যয় সরকার। বয়স ৫+। সে একটি লাল রঙের প্লাস্টিকের কৌটা কোথায় পেয়েছে। বললাম, ‘এটা দিয়ে কী হবে।’ জানাল- ‘মশা মেরে লুকিয়ে রাখবে। মশা বেশি করে কামড়ায়। মশা খারাপ।’ সত্যিই তো মশা খারাপ। কামড়ায়, কামড়ালে আগে ম্যালেরিয়া জ¦র হতো। কোনো চিকিৎসা ছিল না। পরে কুইনাইন জাতীয় টেবলেট বের হলো। রোগের উপশম হলো। ঔষধটি খুবই তিতা। অনেক লোক মারা যেত। এখন মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়, আরো ভয়ানক রোগ। যন্ত্রণা ও মৃত্যু অপ্রতিরোধ্য। কাজেই মশা খারাপ, মশা মানুষের শত্রু। প্রত্যয় সরকার স্বঘোষিত সংগ্রামে মশা মেরে কৌটায় বন্দি করে রাখবে। এভাবে যদি প্রতিটি মানুষ সচেতন হতো মশা মারার জন্য বৈধ প্রতিষ্ঠান যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করত, তাহলে বিষয়টি সহনীয় পর্যায়ে পৌঁছাতে পারত। কিন্তু প্রত্যয়ের মতো দায়িত্বশীল কাউকে যেন খুঁজে পেলাম না।
প্রত্যয় সরকার যে বাসায় থাকে, তার পাশে একটি দালানের সিঁড়ির নীচে কুকুরে বাচ্চা প্রসব করেছে। চারটি বাচ্চা, মা খাওয়া সংগ্রহের জন্য বের হলে এগুলো নিম্নসুরে কান্না করে। প্রত্যয় বন্ধ গেইটের ভেতর থেকে দেখে। তার কষ্ট হয়। তাদেরকে ডাকে। বাচ্চাগুলো একটু বড় হয়েছে, ডাকলে কাছে আসতে চায়। প্রত্যয় লুকিয়ে নিজের খাবার থেকে কিছুটা অংশ এগুলোর দিকে ছুঁড়ে ফেলে। বাচ্চাগুলো খায়। প্রত্যয়ের কী আনন্দ। মাকে বলে কুকুরের বাচ্চাগুলো পালন করবে। মা বারণ করে। নিরাশ করে। প্রত্যয় কষ্ট পায়। এ কষ্টটা যে কী রকম তা বর্ণনা চলে না। জীবের প্রতি জীবের মমতা। সহমর্মিতা। অথচ একই জীব হয়ে আমরা বড়রা কতটা নিষ্ঠুর তার ইতিহাস দীর্ঘ। স্বসমাজে, স্বদেশে, সমগোত্রীয় একই জীব হওয়া সত্ত্বেও দয়া-মায়া-মমতা-সহমর্মিতা তো নেই, বরং অন্য জীবের হিংস্রতাকেও হারিয়ে দেয়। প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- সবই স্বার্থপরতা, আধিপত্য বিস্তার, লোভ-লালসার জন্য হিংস্রতা, জাতিগত বৈষম্য, সম্প্রদায়গত সংকীর্ণতা ইত্যাদি।
প্রত্যয় সরকারের বয়স ৫+। সুতরাং উপর্যুক্ত বিষয়গুলো এখনও তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। কুকুরের ছানা মানব-শিশু সবই তার কাছে একসূত্রে গাথা। এমনটি হয়ত অন্তত মনুষ্যসমাজে প্রচলিত রীতি হওয়ার কথা ছিল। আমরা নিজেদের মানুষ বলি, কিন্তু মানুষ হতে কোথায় যেন বাধা। এ বাধাটা দূরত্ব সৃষ্টি করেছে প্রতিপদে।
আমার বন্ধু মতীন্দ্র সরকার। ৮৪/৮৫ বয়স। নেলী বড়ুয়া তাঁর স্ত্রী। দু’জনেই সরকারি কলেজে চাকরি করতো। সন্তানাদি নেই। এ দম্পতি কয়েকটি কুকুর ও বিড়াল সন্তানভাবে প্রতিপালন করে। সেজন্য কোথাও তাঁরা বেড়াতে যেতে পারে না। মায়ার টান। সবচেয়ে প্রিয় কুকুরটি যখন মারা যায়, তখন মতীন্দ্র দুঃখ-কাতরে ভেঙে পড়ে। নেত্রকোণা থাকে, বাড়ি সেখানে। তাঁর বড় ভাই খ্যাতিমান অধ্যাপক যতীন সরকার। কুকুরটির মৃত্যুর পর আমাকে চিঠি লিখে দুঃসংবাদটি জানায়। লিখেছে- ‘পিতৃ বিয়োগে এতটা কাতর হইনি।’ আমি বিস্মিত ও তাঁর দুঃখে হতবাক।
কলিকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের খ্যাতিমান অধ্যাপক ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় স্ত্রী শ্রীমতী পরিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো এক মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। তাঁরা নি:সন্তান। ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় পুত্রজ্ঞানে একটি কুকুর পালন করত। কুকুরটি মারা যাওয়ার পর তিনি চারদিন বিশ^বিদ্যালয়ে যাননি। কাছের লোকদের বলতেন- ‘সুবল’ চলে গেছে। কুকুরটির নাম ছিল ‘সুবল’। 
শুনেছি জেনারেল এম এ জি ওসমানির একটি কুকুর ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ কুকুরটি তাঁকে প্রাণে বাঁচিয়েছিল। চিরকুমার ওসমানি সাহেব কুকুরটিকে অত্যন্ত স্নেহ-আদর করতেন।
কুকর পোষা যে মহৎ কাজ, তা বলছিনা। তবে এখন বিশ^স্থ পশু দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার জানা নেই।
আমার সম্বন্ধীর ছেলে ১২/১৪টি বিড়াল পালত। তাদের খাওয়া-দাওয়া, থাকবার জন্য ছাদে ঘর তৈরি করে শীতকালে গরম কাপড়ের ব্যবস্থা সবই করে দিত। যখন সে আমেরিকা চলে যায়, তখন এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিল, আমরা তার দু:খে ব্যথিত হয়েছিলাম।
মৌলভীবাজার কলেজে চাকরি করতে গিয়ে আমার বিভাগের সহকর্মী মজিবুর রহমানের বাসায় দেখলাম দুটি শালিক পাখি। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছে। কোনো ভয় বা আতঙ্কের ভাব তাদের দেখিনি। এগুলো হয়ত ব্যতিক্রম ঘটনা হিসেবে আমরা  দেখি। কিন্তু তার অন্তরালে একটি দর্শন তো আছে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ, অন্য জীবের প্রতি দয়া বা মায়া থাকা তেমন কোনো আহামরি বিষয় নয়। কিন্তু এই মানুষই যখন স্বজাতির সঙ্গে পশুসুলভ আচরণ করে, তখন তা মানতে পারি না। মানুষ কীভাবে পশু হয়ে যায়, তা দেখে এখন আর অবাক হই না। তবে মানুষরূপী পশু চিনতে একটু সময় নেয়। পশুর হিংস্রতা ঘোষিত, তা আমার জানি এবং আচরণে দেখি। অথচ দয়ামায়া সমৃদ্ধ মানুষ যখন পশুর চেয়ে হিংস্র হয়ে উঠে, তখন হিংস্র পশুরাও অবাক হয়, লজ্জা পায়। 
অনেক ভেবেছি। কেন এমনটা হয়। কেন মানুষ এতটা হৃদয়হীন দানব হয়ে যায়। এতে আনন্দ কতটুকু, প্রাপ্তি কতটুকু, স্বস্তি কতটা- হিসাব মেলাতে পারি না। যখন দেখি- শুধু স্বার্থের জন্য নয়, মানবিক শুদ্ধাচারের দোহাই দিয়ে এ কাজ করা হয়?
যারা শান্তির বাণী প্রচারক, মানুষকে নৈতিক শিক্ষা দিতে জীবনবাজী রেখেছে, তারাই প্রধান ভূমিকা পালন করে। তারাই জোট বেঁধে সম্প্রদায় সৃষ্টি করে পশু-আচরণে প্রধান ভূমিকা পালন করে। মানুষ তো মানুষই, কুকুর তো কুকুরই- এরূপ প্রতি প্রাণির নিজস্ব সত্তা রয়েছে। এ সত্তার স্বরূপ যখন পরিবর্তিত হয়ে যায়, তখন সৃষ্টিকর্তা হিসাব মিলাবেন কেমনে ?
এক ব্যাধ পশু শিকার করে। বনে গেলে পশুরা ভয়ে পালায়। একবার এক গভীর বনে ঢুকে দেখে একজন জটাধারী লোক গাছতলায় বসে ধ্যানমগ্ন, পশু-পাখিরা তাঁর কাঁধে বসে আছে, সামনে দিয়ে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যাধ তখন ভাবল- এত সহজে যখন পশু-পাখি কাছে পাওয়া যায়, তবে তীর ধনুক নিয়ে ঘোরাঘুরি কেন? সেও গাছতলায় চক্ষু বুজে বসে গেলো, দু’দিন পর যখন কিছু পশু-পাখি কাছে আসতে লাগল, তখন আর তাদের হত্যা করতে মন চাইল না। এ পরিবর্তন এমনিতো আসেনি? চৈতন্যলাভে বিবেক সাড়া দিয়েছে বলেই ব্যাধের হিংস্রতা দূর হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের তিনটি বাণী উচ্চারণ করতে চাই।
১.    দেবতা কে ? মন্দিরে যাঁকে পূজা দেয়া হয়- সেই-ই দেবতা। পূজক ধার্মিক বলে নিজেকে মনে করে। স্বামীজি বলেছেন- যে মানুষের পূজা বা সেবা করে, সে-ই দেবতা। সুতরাং মন্দিরের পূজার চেয়ে জীবন্ত মানবসেবাই তো দেবতা- পূজা।
২.    ধর্ম কি? পরোপকারই ধর্ম, পরপীড়াই অধর্ম। তাহলে ধর্ম নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন? আমরা যে তথাকথিত ধর্ম পালন করি, এটা যদি কল্যাণকর হয়, হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়, তা-ই তো ধর্ম। এজন্য মোটা মোটা বই পড়ার দরকার কি? এত জ্ঞানগর্ভ কথার প্রয়োজন কি? তাহলে মানুষের মধ্যে যে বিভেদ, বিচ্ছিন্নতা তা কীভাবে দূর হবে?
৩.    স্বামীজি বলেছেন- ‘বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাব গ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি’।
আসলে পৃথিবীটা ছোট, জগৎটা মাঝারি, মনটাই বড়। মনটা যদি বড় করা যায়, তাহলে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। মানুষকে মানুষ হতে হবে। মনটা ভালো নেই। কারণ, শুনলাম- প্রত্যয় সরকারকে পালিত বিড়াল নাকি আঁচড় দিয়েছে। বিড়াল তো কোনোদিন মানুষ হতে পারবে না। তাকে যতই আদর যত্ন করা হোক, স্বভাব বা ধর্ম তো পরিবর্তন করা যাবে না।
‘যা হবার তা হবে।
যে আমারে কাঁদায়
সে কি অমনি ছেড়ে রবে।’













সর্বশেষ সংবাদ
কেন ভাঙলো কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি ?
কুমিল্লায় শীতে কাবু শিশুরা
অবিলম্বে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা ও কুমিল্লা-৯ নির্বাচনী এলাকা পুনর্বহালের দাবীতে জনসভা আজ
এড. নাজমুস সা’দাত বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়নের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত
কুমিল্লা জেলা ব্রেড, বিস্কুট প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির ত্রি-বার্ষিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
হঠাৎ আসিফ আকবরের বাসায় কুমিল্লার সাবেক মেয়র সাক্কু
কেন ভাঙলো কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি ?
শহরে আবারো কিশোর গ্যাং গ্রুপের অস্ত্রসহ মহড়া
কুমিল্লা মহানগর ১১ নং ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠন
কুমিল্লায় মাদক পরিবহনে বাড়ছে নারীদের সম্পৃক্ততা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২