সময়টা ১৯৯২ এর আগস্টের কোন এক সকাল। চাকরির সুবাদে কুমিল্লায় আমার অবস্থান। অফিসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি কাজ করছেনা। তালপাকা ভাদ্রের গরম। গ্রাহকদের চাপ শোরগোল আর গরমে অতিষ্ঠ কর্মকর্তা কর্মচারীদের হাঁসফাঁস ইত্যাদি কারণে একঝাঁক বিষণ্নতা মনে ভর করেছে। কাজে মন বসাতে পারছিনা। এরই মধ্যে দেখি জাকির ভাই বরাবরের মতো কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ নিয়ে আমার সামনে বসে।
আচমকা মনটা শান্ত হয়ে গেল। এমনিতেও জাকির ভাইয়ের সাহচর্য পেলে শত প্রতিকূলতার মাঝেও একটা প্রশান্তির ঝাপটা এসে আমার মনটা ভরে দিতো। ইতোমধ্যে দেখি জাকির ভাই কি যেন একটা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছেন না। একধরণের সংকোচ ও বিহ্বলতা যেন তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিচ্ছে। যেমনটি তাকে আগে কখনো দেখিনি। জাকির ভাইয়ের এ দশা দেখে আমার যেন বিস্ময় কাটছে না।
জানতে চাইলাম কিসে তাকে এমন অপ্রস্তুত করছে।
লাজুক চাহনিতে কেবল বললেন, তারেককে ফোন করো। তোমার সাথে তারেক সব বলবে। এডভোকেট আসাদুল্লাহ তারেক আমাদের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। হাইকোর্টে আইন ব্যবসা করেন। অগত্যা উনাকে ফোন করি। তারেক ভাই জানালেন তার কাছে জাকির ভাইয়ের জন্য বিয়ের একজন পাত্রীর খোঁজ আছে।
পাত্রী সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সম্ভ্রান্ত লোহানী পরিবারের আত্মীয়া। মনে পড়ে গেলো অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা গোলাম আম্বিয়া খান লোহানীর কথা। যিনি ব্রিটেনে আইন অধ্যয়ন করতে গিয়ে সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবে স্থানীয় শ্রমিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে একসময় কমিউনিজমে দীক্ষিত হয়ে ১৯২৫ সালে স্থায়ীভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়ায় বাস করতে চলে গিয়েছিলেন।সেখানে থাকাকালীন তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল আন্দোলনের সাথে কাজ করতে থাকেন। স্ট্যালিনের আমলে ১৯৩৮ সালে গুপ্তচরবৃত্তির মিথ্যা অভিযোগে স্ট্যালিন তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। তাৎক্ষণিক কোন কথা না ভেবে আমি তারেক ভাইকে বিয়ের বিষয়টি এগিয়ে নিতে সম্মতি দেই। মনে মগজে বোহেমিয়ান টাইপের আপাদমস্তক সমাজতান্ত্রিক ভাবনার মানুষ জাকির ভাইয়ের জীবনে একজন সমমনা নারীর খুব প্রয়োজন আছে বলে আমরা সকল বন্ধুরা অনুভব করতাম। কেননা ফয়েজ উল্যাহ, খলিলুর রহমান ফরিদ ভাই সহ আরো অনেক বাম ঘরানার বন্ধুদের ন্যায় জাকির ভাই চিরকুমার সভার সদস্য হন এমনটি আমরা চাইতাম না। আমার আগ্রহ দেখে জাকির ভাই কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন এই মিয়া বিয়ের খরচ,বিয়ের পরে বউয়ের খরচ তোমরা দিবা? তথাস্তু বলে সেদিন তাকে চা বিস্কুট খাইয়ে নানা আশ্বাস দিয়ে সেদিনের মতো বাসায় পাঠাই। আমার মতো বন্ধুস্থানীয় আরো অনেকের মত পেয়ে জাকির ভাই পারিবারিকভাবে বিষয়টি এগিয়ে নেন। অবশেষে উভয়পক্ষের সম্মতিতে আগস্ট মাস থাকতেই জাকির ভাই ও শারমিন কাদের গিনি বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। কুমিল্লার সকল স্তরের গণ্য মান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিয়ের বরযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। ঢাকার মতিঝিলের রদেভ্যু কমিউনিটি হলে সে এক এলাহি কাণ্ড। যথারীতি বিয়ের কাজ শেষে ঐ দিনই আমাদের ভাবী হিসেবে কুমিল্লায় শারমিন কাদের গিনির আত্মপ্রকাশ। এসে প্রথমদিনেই তিনি আমাদের মন জয় করে নিলেন। লাকসাম রোডের মাস্টার বাড়ির চেহারা ধীরে ধীরে পাল্টাতে লাগলো। ছন্নছাড়া বোহেমিয়ান জাকির ভাই ক্রমে ক্রমে গৃহমুখী হলেন। গিনি ভাবী পরম ভালোবাসায় জাকির ভাইকে তার জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলেন। গিনি ভাবীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একসময় দৃষ্টি নামে একটি এন জি ও প্রতিষ্ঠা হলো মাস্টার বাড়িতে। এরপর থেকে এ বাড়ির সকল যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠলো দৃষ্টি। মাস্টবাড়ি নামটা আড়ালে চলে গেলো। গিনি ভাবী গাড়ি কিনে দিলেন জাকির ভাইকে।জাকির ভাইয়ের বেশভূষায়ও পরিবর্তন আনলেন গিনি ভাবী। পরিবর্তন আসলো জাকির ভাইয়ের চলন ফলনেও। অনেকদিন পরে একটি স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের আবহ বিরাজ করতে থাকলো বাড়িটিতে। যেমনটি ছিলো জাকির ভাইয়ের বাবার জীবদ্দশায়। শান্তি সাচ্ছন্দ্য যেন ফিরে পেলো পরিবারটি। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের আনাগোনায় মুখর হয়ে থাকতো বাড়িটি।কারোর ডাক্তার লাগবে ভরসা গিনি ভাবী।কারোর মেয়ের বিয়ে উপস্থিত থাকতে হবে গিনি ভাবীকে। ছেলে দেখতে আসবে ভরসা গিনি ভাবী।বাজার হাট অতিথি আপ্যায়নে গিনি ভাবীর কথাই শেষ কথা। দেখতে দেখতে গিনি ভাবী জাকির ভাইকে ছাপিয়ে আমাদের সবার অভিভাবক হয়ে গেলেন।
আমাদের পার্টির খারাপ সময় চলছে, কিংবা চলছে কোন ইনার পার্টি স্ট্রাগলজনিত সংকট গিনি ভাবীর শরণাপন্ন আমরা সবাই।কারণ রক্তে যে তার গোলাম আম্বিয়া লোহানীর বিপ্লবী রক্তস্রোত। ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সম্মুখসারির নেত্রী। মিটিং মিছিলে অগ্রগামী। হার মানা কাকে বলে জানতেন না। যেমনটি ছিলেন জাকির ভাই
আমাদের পার্টি ন্যাপের বিভিন্ন সংকটকালীন সময়ে। গিনি ভাবী যখনই আমার ব্যাংকে আসতেন আমি দেখে অবাক হতাম কি যেন এক অমোঘ আকর্ষণে কাছে টেনে নিতেন আমাদের কর্মকর্তা কর্মচারীদের। যেন সকলের আপনজন তিনি। এমনকি ব্যাংকের টি বয়টির মুখেও তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠতো তাকে এক কাপ চা দিতে পারলে। কিন্তু এতো সুখ বুঝি জাকির ভাইয়ের কপালে সইলোনা। সইলোনা আমাদের কপালেও। আজ থেকে ষোল বছর আগে এমন শীতের দিনে (৩ জানুয়ারি,২০০৮) অকস্মাৎ আমাদের ছেড়ে পর পাড়ে চলে যান গিনি ভাবী। সেদিন কুমিল্লার প্রথিতযশা সব চিকিৎসককে বোকা বানিয়ে গিনি ভাবী চলে গেলেন কাউকে কিছু না বলে।
উল্লাপাড়ার লাল দালানের বাড়ি থেকে কুমিল্লার গোমতীর পাড় পর্যন্ত আমার মতোএমন কত মানুষ তার ভালোবাসার কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছে সে কথার সাক্ষ্য বহন করছে এই বিশাল জনপদ আজো।গিনি ভাবীর প্রয়াণ দিবসটি এলে এমন হাজারো কথারা ভিড়ে আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। তাঁর একটি বিখ্যাত আবৃত্তি আজো স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে আমার বাসার খোলা ছাদে এক ফাগুন জোছনায় যেটি তিনি আবৃত্তি করেছিলেন তার স্বভাবসুলভ আবেগে খানিকটা উদাস কণ্ঠে। বলেছিলেন-
‘জানি, এই পৃথিবীতে কিছুই থাকেনা,
শুক্র কৃষ্ণ দুই পক্ষ বিস্তারিয়া মহা শূন্যতায়
কাল বিহঙ্গম উড়ে যায় অবিশ্রাম গতি।
পাখার ঝাপটে তার নিভে যায় উল্কার প্রদীপ
লক্ষ লক্ষ সবিতার জ্যোতি।
আমি সেই বায়ুস্রোতে খসে-পড়া পালকের মতো
আকাশের নীল শূন্যে মোর কাব্য লিখি অবিরত।’
সেকথা স্যরি গিনি ভাবীর মৃত্যু দিন এলে আমার মনোবীণায় বেজে উঠে কবিতার চরণধ্বনি-
ইচ্ছে ছিলো
তোমাকে সামনে রেখে সাম্রাজ্য বাড়াবো
সমাজতন্ত্রের লড়াইটা চালিয়ে যাবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে
কেবল তুমি নেই বলে লড়াইটা থেমে আছে।
থেমে আছে এখানে জীবনের কোলাহল।
লেখকঃ প্রেসিডিয়াম সদস্য ন্যাপ, কেন্দ্রীয় কমিটি।