যার
চারপাশ সাগর আর আকাশের নীল অন্ধকার মিশে একাকার। সমুদ্র সৈকত আর সাগরের
পানির বিরামহীন গর্জন নীল মনমাতানো নয়নাভিরাম পরিবেশ প্রবাল দ্বীপ
সেন্টমার্টিন। প্রাকৃতিক স্বর্গ পরিচিত এই দ্বীপে সারি সারি নারিকেল গাছ
রয়েছে, তবে প্রায় গাছে নারিকেল নেই বললেই চলে, ডাব ও নারিকেল অনেক দামও।
সমুদ্র সৈকতে স্নিগ্ধ বাতাসে গা জুড়ে যায়, সেখানের বন আর সাগরের মায়াময়
স্নিগ্ধ মন জুড়িয়ে যায় নিমিষে। বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল ধ্রুবতারা নন্দিত
কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এর অবকাশের জন্য পছন্দের শীষে। আমার কাছে পরম
ভাললাগার একটি পর্যটন গন্তব্য হচ্ছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। যেখান থেকে
সূর্যাস্তের অপরূপ সৌন্দর্য, স্নিগ্ধ বাতাস আর সাগরের স্বচ্ছ জল দেখা যায়।
বর্তমানে
সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য যেতে হবে কক্সবাজার। কুমিল্লা থেকে বাসে করে
রাতে কক্সবাজার যাওয়া সহজ। পাঁচ ঘণ্টার এই ভ্রমণে বাস ভাড়া ৭০০ থেকে ১
হাজার টাকায় যাওয়া যায়। তবে আমরা কুমিল্লা থেকে রাত সাতটায় পদুয়ার বাজার
বিশ^রোড থেকে তিশা প্লাস বাসে রাত দশটায় চট্রগ্রাম নেমে মেজবানি খাবারের
প্যাকেজ জন প্রতি ২৫০ টাকা দিয়ে রাতের খাবার খাই কুটুমবাড়ি রেস্তোরায়।
তারপর রাত ১২টায় সেন্টমার্টিন পরিবহনে সকালে পৌঁছ কক্সবাজার। আমাদের
পরিচিত হোটেলে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সকালে নাস্তা খেয়ে আমাদের
পূর্বে বুকিং করা জাহাজে কেয়ারি ক্রুজ এন্ড ডাইনে উঠি, সকাল সাড়ে আটটায়
আমাদের জাহাজ ছাড়ে সেন্টমার্টিন যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। প্রথম
ঘন্টা দুয়েক ভালো লাগলেও পরবর্তী চার ঘন্টা ছিল বিরক্তিকর জাহাজের ভ্রমণ।
এই
বিরক্তির কারন মায়ানমার আভ্যন্তরিন ঝামেলায় টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন
জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে এজন্য কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন যেতে হয়।
কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন প্রায় ছয় ঘণ্টার ভ্রমণ। আমরা হালকা শুকনা
খাবার নিয়ে যাই, জাহাজের খাবারের ওপর নির্ভর করে ডাবল দামে খাবার খেতে হয়।
জাহাজের ক্যান্টিনে পপকন, স্যান্ডউইচ, বার্গার, কফি ও আইসক্রিম পাওয়া যায়।
কিছু খাবার কাগজের ঠোঙায় দেওয়া হলেও বেশির ভাগ খাবার দেওয়া হচ্ছিল
প্লাস্টিকের প্যাকেট ও কফি ওয়ানটাইম কাপে। দ্বীপে পলিথিন ও প্লাস্টিক
ব্যবহার সরকারি ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে জাহাজে কয়েকবার ঘোষণা করা হয়। কে
শুনে কার কথা সবাই প্লাষ্টিকের পানির বোতল ব্যবহার করছেন।
কক্সবাজার
থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য জাহাজের সীট ভেদে ভাড়া জনপ্রতি ২৩০০ থেকে
৪৫০০ টাকার মধ্যে থাকে। তবে জাহাজের সীটে বসে যেতে হলে অগ্রিম টিকেট কেটে
যেতে হবে। যদিও কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন সকল জাহাজ ছাড়ে সকাল ৭টা থেকে
সাড়ে আটটার মধ্যে।
বর্তমানে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনে ৬/৭ টি জাহাজ
যায়। তার মধ্যে কেয়ারি সিন্দাবাদ, কেয়ারি ক্রুজ এন্ড ডাইন, আটলান্টিক,
কর্ণফুলি, গ্রীন লাইন অন্যতম। এছাড়াও সমুদ্র রুটে বেশ কিছু ট্রলার ও
স্পিডবোট রয়েছে। ট্রলার ও স্পিডবোট সেন্টমার্টিনের স্থানীয় লোকজন ব্যবহার
করে থাকেন।
সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় আমাদের জাহাজ সকাল সাড়ে
৮টায় ছেড়ে পৌঁছে বিকাল ৩টায়। সেন্টমার্টিনে থাকার জন্য বেশ উন্নতমানের
হোটেল ও কটেজ রয়েছে। আমরা জাহাজ থেকে নেমেই পূর্বে পরিচিত সেন্টমার্টিন
ময়নামতি হোটেলের সাথে সম্পৃক্ত কুমিল্লা ইনসাফ গ্রুপের জসিম ভাইয়ের সাথে
দেখা। জসিম ভাই ময়নামতি হোটেলের পাশের হোটেল ফারিয়া রিসোটের্র মালিককে ফোন
করে আমাকে মোবাইল নম্বর দেন সাথে স্থানীয় একটি ছেলেকে দিয়ে হোটেল পাঠালেন,
হোটেলের মালিককে রুমের ভাড়ার কথা জানতে চাইলে তিনি জানান, প্রতি রুম ভাড়া ১
হাজার টাকা। আমরা ৮শত টাকা দিব বলে উঠে যাই। আমার সফর সঙ্গী ছিলেন
কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজের সহকারী অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা, মো. ইমতিয়াজ
মজুমদার, মো. আদনান ছাত্তার মজুমদার, সিনিয়র প্রভাষক মোহাম্মদ ইমরান
হোসাইন, প্রভাষক মো: হাসান ভূইয়া ও প্রবাসী সাইফুল ইসলাম।
আমরা ফারিয়া
রিসোটের্র দুইটি রুমে উঠে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার তৃপ্তি রেস্তোরাঁয়
সুন্দরী মাছের ফ্রাই, আলুর ভর্তা, শুঁটকীর ভর্তাও ডাল দিয়ে জন প্রতি ২৫০
প্যাকেজ খাই। তারপর সরাসরি চলে যাই দ্বীপের সমুদ্র সৈকতে। সেন্টমার্টিন
দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা সবাই হারিয়ে যাই মনের অজানাতে।
রাতের
খাবার খাওয়ার জন্য আইকনিক সাঁকো ঘাটে রাত দশটায় সবাই একসাথে হওয়ার পূর্বে
নির্দেশনা ছিল। সে মোতাবেক সবাই একসাথে হয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে তাজা সাগরের
মাছও তেলে ভাজা মাছের সুগন্ধে মৌ মৌ উপভোগ করি। রাতে প্রায় সব হোটেলের
আঙিনায় মাছের বারবিকিউ পার্টি হয়। আমরাও চার কেজি ওজনের কুড়াল মাছ ২৪০০
টাকা দিয়ে ক্রয় করে রেস্তোয় বারবিকিউ আয়োজন করি। খাবারের চেয়ে বেশি মজা
হয়েছে কোরাল মাছের বারবিকিউ জন্য অপেক্ষা।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের তিন
দিকের ভিত্তি শিলা যা জোয়ারের সময় তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে উঠে। জানা
যায় এক সময় সেন্টমার্টিন দ্বীপের চতুর্দিকে পাহাড়ের মত মাটির ভরাট ছিল। যা
স্থানীয়ভাবে ডেইল বলা হয়। বছরের পর বছর সেই ডেইলগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যা
বর্তমানে নাই বললে চলে। আছে শুধু অল্পখানেক যা দ্বীপের পশ্চিম এবং দক্ষিণ
প্রান্তের দিকে। তাও স্থানীয় লোকদের বিরামহীন চেষ্টায় রক্ষা পায়। এই
দ্বীপটি একটি ইউনিয়নও যা কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার অন্তর্গত এবং
বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম ইউনিয়ন। এক সময় এই ইউনিয়নটি টেকনাফ থানার
অন্তর্গত সাবরাং ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। পরবর্তীতে ১৯৮৩ইং সালে
বাংলাদেশ সরকার এই সেন্টমার্টিন দ্বীপটিকে একটি ইউনিয়ন হিসেবে ঘোষণা করেন,
যা বর্তমানে ৬ নং সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ নামে পরিচিত। এই ইউনিয়নে প্রায়
দশহাজার জনসংখ্যা রয়েছে।
মূলদ্বীপের পাশেই ১০০ থেকে ৫০০ বর্গ মিটার
আয়তনের একটি ছোট দ্বীপ রয়েছে, সেটাকে স্থানীয়ভাবে ছেড়াদ্বীপ নামে অভিহিত
করা হয়। যার অর্থ বিছিন্ন দ্বীপ। ছেঁড়া দ্বীপের আর কোনো ভূখণ্ড নেই।
মূলদ্বীপ থেকে ছেড়া দ্বীপের সংযোগস্থল দেখতে নিচু হওয়ায় জোয়ারের সময় এটি
প্রায় তলিয়ে যায়। তাই নৌকা নিয়ে যেতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় উত্তর থেকে
পশ্চিম বিচ ধরে সম্পূর্ণ পথ পায়ে হেঁটে। নির্জন এই পথটা সুন্দর।
সেন্টমার্টিন দ্বীপটির ভূপ্রকৃতি প্রধানত সমতল।
সেন্টমার্টিন প্রবাল
দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির
সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক
মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর ও শতাধিক প্রকৃতি প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। এছাড়াও
রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে-
লইট্যা, ছুড়ি, সুরমা, লাক্ষা, টুনাফিশ, লাল চিংড়ী, রিটা, রুপ চাঁন্দা, কাল
চাঁন্দ, পোয়া,আঁইর, লাল কোরাল, শিল কাঁকড়া, লবস্টার ইত্যাদি। মাছের মধ্যে
রয়েছে- পরী মাছ, প্রজাতির মাছ, বোল করা, রাঙ্গা কাই, রূপচাঁদা, সুঁই মাছ,
লাল মাছ ইত্যাদি।
দ্বীপের বালির মধ্যে দেখা যায় গোলাকার পাতার আইপোমিয়া
লিতা। প্রতিকূল পরিবেশে প্রথম প্রাণের স্পন্দন কেন্দ্রকারী এই উদ্ভিদে
ফানে আকৃতির সাদা-গুনি ফুল দেখা যায়। অন্যান্য উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে- কেয়া,
শ্যাওড়া, সাগরতা, বাইন গাছ ইত্যাদি। বৃক্ষ জাতীয় গাছের মধ্যে নারিকেল গাছ।
আরও রয়েছে- শিমুল, আম, সুপারি, বাবলা, কড়ি ইত্যাদি। দ্বীপের দক্ষিণ দিকে
কোলে কেওড়ার ঝোপ-ঝাড়সহ কিছু ম্যানগ্রোভ গাছও দেখা যায়। সৈকতের সামনে আরও
দেখা যায় বেশ কিছু ঝাউ গাছ। এখানে-মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে মাছ ধরে,
শুটকি প্রক্রিয়াকরণ, পর্যটন সেবার মাধ্যমে। প্রতি বছর পর্যটন মৌসুমে
দ্বীপটি কর্মচঞ্চল থাকে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের মানুষ সহজ-সরল, উষ্ণ
আতিথেয়তা তাদের বৈশিষ্ট্য।
সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল,
থাইল্যান্ডের মতো পর্যটনের কৌশল অবলম্বন করে দেশি পর্যটক ধরে রাখা এবং
বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে পর্যটন শিল্পের প্রতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নজর দিতে
হবে। পর্যটকদের নিরাপত্তা, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ, জিনিসপত্রের
দাম সীমিতকরণ, স্বল্প খরচে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো
সব গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার, পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন
প্রজন্মকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
দ্বিতীয় দিন রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে
গিয়ে ঘুম। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে বাইসাইকেলে প্রতি ঘন্টা ৪০ টাকা
করে ভাড়া নিয়ে বিচে ইচ্ছেমত চালাই। সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮.১৩
বর্গ কিলোমিটার প্রায় পুরোটাই বাইসাইকেল চালিয়ে দল বেঁধে ঘুরি, তখন স্কুল
জীবনের বাইসাইকেল চালানোর দুরন্তপনার কথাই বেশি মনে পড়ে। দুপুরের খাবার
খেয়ে এবার ফেরার পালা বিকাল সাড়ে তিনটায় জাহাজ সেন্টমার্টিন থেকে ছেড়ে রাত
সাড়ে আটায় পৌঁছে কক্সবাজার। রাতের খাবার খেয়ে রাত সাড়ে দশটায় সেন্টমার্টিন
পরিবহনে স্লিপার আসনে কঠিন ঘুম, এক ঘুমে শ^শুর বাড়ি। মানে আমার শশুর বাড়ি
বুড়িচং উপজেলার শোভারামপুরে ক্যান্টনমেন্ট এ বাস থেকে নেমে যাব সেখানে
গিয়েছি আর কি। অবশেষে সেন্টমার্টিনের ভ্রমণ শ^শুর বাড়ি দিয়ে সমাপ্ত।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।