সোমবার ৬ জানুয়ারি ২০২৫
২৩ পৌষ ১৪৩১
কর্মজীবি মা-বাবাদের বিপদ
শ্যামল আতিক
প্রকাশ: শনিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২৫, ১২:৩০ এএম |

  কর্মজীবি মা-বাবাদের বিপদ
শিশুকে কে লালন করবে? মা-বাবা নাকি অন্য কেউ? বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজনের উপার্জনে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করা বেশ কঠিন। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, পড়াশোনা, বিনোদন, সামাজিকতা রক্ষা ইত্যাদি খরচের অর্থ সংস্থান করতে গিয়ে পরিবারের কর্তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাধ্য হয়েই অনেক গৃহিণীকে উপার্জনের জন্য কাজ করতে হচ্ছে। 
দৃষ্টিভঙ্গিতেও এসেছে পরিবর্তন। একটা সময় মনে করা হতো, ঘর সামলানো, সন্তান মানুষ করা, রান্না-বান্না - এই কাজগুলো শুধু স্ত্রীরা করবে। এখন সময় পাল্টেছে। পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও ঘরের বাইরের কাজে অংশগ্রহণ করছে। অনেক ক্ষেত্রে স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীরাও উপার্জন করে পরিবারে সমান অথবা বেশি অবদান রাখছে। এই বিষয়গুলো নিঃসন্দেহে সামাজিক অগ্রগতির লক্ষণ। 
কিন্তু বিপত্তি ঘটে শিশুর লালন নিয়ে। পরিবারে শ্বশুর-শাশুড়ি অথবা বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ থাকলে, খুব বেশি একটা বেগ পেতে হয় না। তবে পরিবার যদি একক হয়, অনেক মা-বাবা বাসায় গৃহকর্মী রেখে সাময়িক সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন। অথচ এর ফলে শিশুর যত্ন ও বিকাশে কী ক্ষতি হচ্ছে, তা কি কখনো ভেবে দেখেছি? 
মা-বাবার অনুপস্থিতিতে শিশু গৃহকর্মীর কাছে বড় হচ্ছে। গৃহকর্মীর ভাষা, আচরণ এবং দৃষ্টভঙ্গি রপ্ত করছে। গৃহকর্মীদের অধিকাংশই কম বয়সী। হয়ত শিশুকে কোলে নিয়েই সারাদিন টিভি দেখছে। এমনিতেই টিভি শিশুদের জন্য ক্ষতিকর। তার ওপরে গৃহকর্মী যদি অসুস্থ ও অশ্লীল প্রোগ্রাম দেখে, তা শিশুর জন্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সহজেই অনুমেয়। 
গৃহকর্মীর যত্নে যদি মমতা ও আন্তরিকতার অভাব থাকে, তাহলে শিশুর আবেগীয় চাহিদায় এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। ক্রমাগত স্নেহ মমতা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে, মা-বাবার সঙ্গে শিশুর দূরত্ব বাড়তে থাকে। পরিবারে বাস করেও সে বিচ্ছিন্ন মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে। এই শিশুরা যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের অসংগতিপূর্ণ আচরণ করতে পারে। 
এ ছাড়াও পেশাজীবি মা-বাবার মধ্যে সবসময় এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করে। তারা মনে করেন, শিশুর জন্য কিছুই করতে পারছেন না। এই বোধের কারণে তারা শিশুর সব আবদার পূরণ করার চেষ্টা করেন, আচরণগত ত্রুটিগুলোকে সহ্য করেন এবং সব কিছুতেই সায় দেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বস্তু (অর্থাৎ খেলনা, খাবার, কাপড়চোপড় অথবা টাকা) দিয়ে শিশুকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন। এভাবে শিশু প্রতিনিয়ত প্রশয় পেতে থাকে, যা শিশুর সমস্যাপূর্ণ আচরণকে বাড়িয়ে তোলে। 
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কর্মজীবি মা-বাবা সারাদিন কাজ সেরে বাসায় ফিরে একটু বিশ্রাম প্রত্যাশা করেন। বাসায় এসে শিশুকে যতটুকু সময় দেন তাতেও মনোযোগের যথেষ্ট ঘাটতি থাকে। শিশু প্রশ্ন করলে ঠিক মতো উত্তর দিচ্ছেন না, চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন না, মোবাইল ফোন বা টিভির দিকে তাকিয়ে থাকছেন- এই বিষয়গুলো শিশু বুঝতে পারে। মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা অথবা প্রতিশোধ হিসেবে শিশু তখন নানা ধরনের সমস্যাপূর্ণ আচরণ করে। অনেক ক্ষেত্রে এই শিশুরা অবাধ্য হয়ে যায় অথবা মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে। 
আরেকটি বিপত্তি ঘটে, শিশুর সামাজিক বিকাশে। সারাদিন বাসায় একা থাকার ফলে, টিভি মোবাইল বা কম্পিউটারের সামনে বেশি সময় কাটায়। যা শিশুকে সামাজিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন করে তোলে। কারও সঙ্গে মিশতে পারে না অথবা মিশতে চায় না। এভাবে কিছুদিন চলার পরে একটা সময় আসে যখন শিশু পুরোপুরি স্ক্রিনে আসক্ত হয়ে যায়। স্ক্রিনের ভার্চুয়াল জগতটাকেই শিশু জীবন মনে করে।  
এসব চ্যালেঞ্জ থেকে মুক্তির জন্য আমাদের কী করণীয়? কর্মজীবি মা-বাবার জন্য পরামর্শ হচ্ছে বাসায় ফিরে শিশুকে পনের মিনিট বিশেষ সময় দিন। এটা পারিবারিক সময় থেকে ভিন্ন। আসলে পারিবারিক সময় আর বিশেষ সময় এক জিনিস নয়। পারিবারিক সময়ে আপনি সবার সঙ্গে থাকছেন ঠিকই, কিন্তু কারও প্রতি পরিপূর্ণ মনোযোগ দিচ্ছেন না। কিন্তু বিশেষ সময়ে শিশুর প্রতি কিছুক্ষণের জন্য পূর্ণ মনোযোগ দিচ্ছেন। এই ব্যাপরটি দারুণ কাজ করে। এর ফলে শিশু নিজেকে সম্মানিত মনে করে, অনেক সমস্যা এমনিতেই কেটে যায়। 
আরেকটি কাজ করতে পারেন। বাসার কাছে কোনো ডে-কেয়ার সেন্টার থাকলে, শিশুকে সেখানে দিতে পারেন। শহর কিংবা গ্রাম যেখানেই হোক না কেন, শিশুর সামাজিকীকরণে এর প্রভাব অনস্বীকার্য। ডে-কেয়ারে শিশু অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পায়, খেলাধুলা করতে পারে, কিছুটা আত্মনির্ভরশীল হতে শেখে। স্কুলে ভর্তির সময় এই শিশুরা খুব দ্রুত নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়। আর ডে-কেয়ারে যদি শিষ্টাচার, আদব কায়দা, এবং প্রাথমিক কান্ডজ্ঞান শেখানো হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তা বাড়তি পাওয়া। 
তবে ডে-কেয়ারে দেওয়ার আগে অবশ্যই খোঁজখবর নেবেন। কারণ ডে-কেয়ারের কর্মীদের যদি শিশু লালন ও প্যারেন্টিং সম্পর্কে প্রশিক্ষণ না থাকে, তাহলে তা হীতে বিপরীত হতে পারে। অনেক সময় আমরা শুনতে পাই, টিভিতে কার্টুন ছেড়ে সারাক্ষণ শিশুদের বসিয়ে রাখা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধমক দিয়ে, ভয় দেখিয়ে অথবা প্রহার করে শিশুদের শান্ত রাখার চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের ডে-কেয়ারে শিশুকে না রাখাই ভালো। 
সবচেয়ে ভালো হয়, যদি শিশুকে ডে-কেয়ার ও পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে সমন্বয় করে রাখতে পারেন। দিনের কিছুটা সময় (৩-৪ ঘন্টা) ডে-কেয়ারে, বাকী সময়টা দাদা-দাদি, নানা-নানির কাছে রাখা যেতে পারে। দিনশেষে মা-বাবা বাসায় ফিরে শিশুকে একান্তে সময় দেবেন। ঘরে যতক্ষণ থাকেন শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন, প্রশ্নের উত্তর দেবেন এবং শিশুর সঙ্গে খেলা করবেন। আর ছুটির দিনগুলোতে অবশ্যই শিশুকে নিয়ে ঘুরতে বের হবেন। 
মনে রাখতে হবে, শিশুরা আমাদের ভবিষ্যত। ক্যারিয়ার বা অন্য কোনো কারণে যদি শিশুর যত্ন বা মমতায় ঘাটতি থাকে, তার খেসারত আমাদেরকে দিতে হবেই। একবার শিশু বিগড়ে গেলে বা বিপদ্গামী হলে, জাহান্নাম আপনি জীবদ্দশায় দেখতে পাবেন। তাই সময় থাকতে শিশুর প্রতি মনোযোগ দিন। 
লেখক- ‘প্যারেন্টিং কলাম’ বইয়ের লেখক












সর্বশেষ সংবাদ
বাপে-মেয়ে মিল্লা পালাইছে কোথায় বাহার-লোটাস
কুমিল্লা মহানগরীর ৪ওয়ার্ডে বিএনপি’র কমিটি
বেদখল হয়ে আছে কুমিল্লার সড়ক-মহাসড়কের যাত্রীছাউনি
বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের দায়ে দুই ভারতীয় নাগরিক আটক
কুমিল্লায় ফসলের মাঠজুড়ে সাদা বকের মিলন মেলা
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কেন ভাঙলো কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি ?
অবিলম্বে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা ও কুমিল্লা-৯ নির্বাচনী এলাকা পুনর্বহালের দাবীতে জনসভা আজ
কুমিল্লায় শীতে কাবু শিশুরা
কুমিল্লা জেলা ব্রেড, বিস্কুট প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির ত্রি-বার্ষিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত
এড. নাজমুস সা’দাত বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়নের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২