রাজা না হলে যেমন প্রজা হয় না,
প্রজা না হলে যেমন রাজা হয় না, তেমনি লেখক না হলে পাঠক হয় না, পাঠক না হলে
লেখক হয় না। লেখকের সঙ্গে পাঠকের একটি অদৃশ্য যোগসূত্র আছে। লেখকও সেটা
জানেন, পাঠকও জানেন সেটা কেউ কাউকে হয়তো চক্ষে দেখেন নি, দেখবেনও না
কোনোদিন। দেখবেন কী করে, যদি দু পক্ষের মাঝখানে হাজার হাজার মাইলের
ব্যবধানে থাকে। যদি থাকে শত শত বর্ষের ব্যবধান। তবু মানতেই হবে যে
যুগযুগান্তরের ও দেশদেশান্তরের লেখকের সঙ্গে যুগযুগান্তরের ও
দেশ-দেশান্তরের পাঠকের একটা অদৃশ্য যোগসূত্র আছে। একথা মনে রেখে লেখক শুধু
চেনা পাঠকগোষ্ঠীর সাময়িক চাহিদা মেটানোর জন্যে কলম ধরেন না। তাঁকে অচেনা
পাঠকসমূহের কালোত্তর পরিতৃপ্তির জন্যও যথাসাধ্য করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ যখন
শিলাইদাতে বসে লিখতেন তখন বাংলার বাইরে কেউ তাঁর লেখা পড়তেন না। পরে একদিন
পড়বেন, এটাও কি তিনি জানতেন? তা সত্ত্বেও তিনি এমনভাবে লিখে গেছেন যাতে
দেশবিদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎকালের পাঠকরা তাঁর লেখা পড়ে আনন্দ পান। সে
লেখা হয়তো অপর কোনো ভাষায় অনুবাদ। হয়তো মূল রচনার অল্পই তাতে মেলে। তবু
লেখকের সঙ্গে তাঁর দূরবর্তী পাঠকদের অন্তরের মিল হয়। সাহিত্য কথাটার ভিতরে
একটা সাহিত্যের ভাব আছে। সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে যাঁরা ব্যাপৃত তাঁদের সঙ্গে
তাঁদের পাঠকদেরও এক প্রকার সহিত অর্থাৎ সাহিত্যের ভাব। লেখা যদিও দৃশ্যত
একজনের কাজ তবু প্রকৃতপক্ষে দুজনের। রবীন্দ্রনাথ যথার্থ বলেছেন-
একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুইজনে।
গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেকজন গাবে মনে?
তেমনি
একাকী লেখকের নয় তো লেখা, মিলতে হবে দুইজনে। সেই দ্বিতীয় জনটির নাম পাঠক।
তাঁকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবার উপায় নেই। তাঁকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে।
কী করে সেটা সম্ভব, প্রত্যেক লেখককেই এর সমাধান খুঁজে বার করতে হবে।
খামখেয়ালিভাবে যা খুশি লিখে গেলেই চলবে না। তা যদি কেউ করেন তবে তাঁর
পাঠকের সঙ্গে তাঁর সাহিত্য থাকবে না। অপর পক্ষে এটাও ঠিক যে লেখক তাঁর
পাঠকের জন্যে অপেক্ষা করে জীবন ভোর করে দেবেন না। পাঠক হয়তো প্রস্তুত নন,
হতে সময় লাগবে। লেখক তা বলে লেখা বন্ধ করে বসে থাকবেন না, পাঠকের মুখ চেয়ে
লেখার মান খাটো করতে পারবেন না। সব লেখা সকলের জন্য হলেও সালে সব লেখার
জন্য প্রস্তুত নন। যিনি যখন প্রস্তুত হবেন তিনি তখন উপভোগ করবেন। লেখক
আপাতত তাঁত সৃষ্টির দায় থেকে মুক্ত হতে চান, যে দায় তাঁকে লেখক হতে বাধ্য
করেছে।
পাঠকের প্রতি দায়িত্ব যেমন একটি দিক তেমনি আর একটি দিক হচ্ছে
সৃষ্টির প্রতি দায়িত্ব। কবিতা বা গল্প যখন যেটাই লিখি না কেন সব সময় আমার
একটি চোখ থাকে পাঠকের উপর আর একটি চোখ যা লিখছি তার উপরে। লেখাটি নিজেতে
নিজে সম্পূর্ণ হওয়া চাই, নিজেতে নিজে নিখুঁত হওয়া চাই। যেন একটি নিটোল
মুক্তা। প্রত্যেক সার্থক সৃষ্টির ভিতরে একটি সমগ্রতা আছে, আর আছে একটি
শিল্পগত উৎকার্য। কবিতা বা কাহিনী যদি আর্ট হিসেবে উত্তীর্ণ না হয় তা হলে
লেখকের দিক থেকে কিছু ত্রুটি হয়তো তখনই ধরা পড়ে না। পড়ে একদিন না একদিন
মেননশীলন্য লেখককে আগে থেকে হুঁশিয়ার থাকতে হয়। রস যেন গুরুত্বসম্পন্ন রূপই
তেমনি। রসের ওপর মনোযোগ দিতে গিয়ে রূপকে অবহেলা করা চলে না। অপরপক্ষে রূপও
যেন সর্বস্ব হয়ে না ওঠে।
উপনিষদে বিত্তময়ী সৃঙ্গার কথা বলা হয়েছে। যাতে
বহু মনুষ্য নিমজ্জিত হয়। আজকাল জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার হওয়ায়
সাহিত্যিকের পক্ষে ভয়ের কথা। বাঁধা আয় না থাকলে আর দশজন মানুষের মতো
সাহিত্যিকের ও জীবন যাত্রা দুর্বহ। লেখা থেকে যদি দুটো পয়সা ঘরে আসে তা হলে
তো ভালই হয়। কিন্তু তার জন্যে লেখা যদি বাজারের মুখ চেয়ে উৎপন্ন হয় তাবে
সে আর সাহিত্য পদ বাচ্য হতে পারে না। হয়ে দাঁড়ায় পণ্য। প্রায়ই নালিশ শুনতে
পাওয়া যায় যে একালের লেখকদের বই পড়ে সেকালের মতো তৃপ্তি হয় না। হবে কী করে?
লেখা যে এক প্রকার ম্যানুফ্যাকচার। ম্যানুফ্যাচার তো সৃষ্টি নয়। অপরপক্ষে
লেখক যদি খুঁতখুতে হন তবে তাঁর পক্ষে আজকালকার দিনে জীবনধারণ করা তো
দস্তুরমতো শক্তই, বইয়ের প্রকাশক পাওয়াও কম শক্ত নয়। সুতরাং পাঠকদের ও
প্রকাশকরে উচিত লেখকদের কর্তব্য করতে তাঁদের সাহায্যে করা। দায়িত্ব কখনো
একতরফা হয় না। লেখকের যেমন দায়িত্ব আছে লেখকের প্রতিও তেমনি দায়িত্ব আছে।
লেখকও তো নালিশ করতে পারেন যে পাঠক তাঁর বই কেনেন না, প্রকাশক তাঁর বই
ছাপেন না কিংবা ছাপলেও তাঁর প্রাপ্য দেন না। থাক, এসব কথা তুচ্ছ। আসল কথা
হচ্ছে, সৃষ্টির স্রোতকে বহতা রাখা। স্রষ্টার সৃষ্টির মতো সাহিত্যিকের
সৃষ্টিও বহতা থাকবে, এই সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব।
মননশীল লেখক মাত্রই অবশ্য
ভিতরকার তাগিদে লিখে থাকেন: যা তিনি লেখেন তা না লিখে তাঁর শান্তি নেই;
লেখার মধ্যেই তাঁর মুক্তি। তবু এ কথাও সত্য যে শুধু লিখে তিনি সন্তুষ্ট হতে
পারেন না; সে লেখা অন্যের গোচরে আনার তাগিদও তাঁর মধ্যে সক্রিয়। শুধু
গোচরে আনা নয়, তাঁর স্বকীয় অভিজ্ঞতাকে অন্যের মনে সঞ্চারিত করতে পারলে তবেই
তিনি সুখী। সুরকার কিংবা চিত্রশিল্পী হয়তো-বা একেবারে অপর-নিরপেক্ষ হতেও
পারেন, কিন্তু সাহিত্যিকের পক্ষে এ বিশুদ্ধতা অকল্পনীয়। তার প্রধান কারণ
সাহিত্যের মাধ্যম হল ভাষা আর ভাষার প্রকৃতিই পরোক্ষ। ফলে পাঠকবিষয়ে চেতনা
সব লেখকের রচনাতেই কম বেশি প্রভাব ফেলে থাকে। এ প্রভাব হোমার, দান্তে থেকে
শুরু করে শেক্সপিয়র কি রবীন্দ্রনাথ কেউই এড়াতে পারেননি। র্যাম্বো এবং
রিল্কে-কেও তাঁদের কবিতা অপরবোধ্য ভাষায় লিখতে হয়েছে।
যদিও কোনও লেখকই
পাঠক-লাভের প্রত্যাশা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারেন না, তবু
মননশীল লেখক রসিক পাঠকের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। অর্থাৎ তাঁর দেশে কিংবা
তাঁর কালে যদি মনের মতো পাঠক নাও জোটে, তবু অর্ধশিক্ষিতের তারিফের লোভে
তিনি তাঁর বক্তব্য বা বাচনভঙ্গী বদলাতে প্রস্তুত নন। তিনি কল্পনা করে নেন
এমন যুগকাল যখন তাঁর লেখার যথার্থ সমঝদারেরা তাঁর এই অপেক্ষা করার দাম সুদে
আসলে পুশিয়ে দেবেন। অথবা যেটা আরও সচরাচর দেখা যায়, তিনি সংখ্যাগরিষ্ট
সাধারণের মনোরঞ্জনের চেষ্টা না করে তাঁর সমকালীন স্বল্পসংখ্যক বিদগ্ধ জনের
কথা স্বরণে রেখে সাহিত্যে রচনা করেন। তাতে সমালোচকরা তাঁকে যদি তাঁকে
বিদ্রপ করে তা তাঁর সয়, কিন্তু অরসিকদের দাবির কাছে নিজের কল্পনাকে খাটো
করতে তিনি একেবারেই নারাজ। ফলত মননশীল লেখক সহৃদয়হৃদয়সন্বাদী হতে পারলেই
চরিতার্থ; তার উপরে যদি তিনি সর্বহৃদয়সন্বাদী হতে পারেন, সেটা তাঁর হিসেবের
উপরিপাওনা।
তবে এ অভিমানের বিপদ আছে। লেখকের দিক থেকেও বটে, পাঠকদের দিক থেকে তো বটেই। কিন্তু লেখক এবং পাঠকের অনেক সময়ে সে কথা স্মরণে থাকে না।
প্রথমত,
সাহিত্যিক মাত্রেরই উপজীব্য হচ্ছে মানুষ-মানুষের সুখ-দুঃখ, ভাবনা-কল্পনা,
ক্রিয়া-কলাপ, অনুভূতি-অভিজ্ঞতার উপাদান ছাড়া সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব নয়। ইংরেজ
কবি জন ডান লিখেছেন, ‘কোনো মানুষই দ্বীপ নয়, প্রতি মানুষই মহাদেশের একটি
অংশ; সমুদ্র যদি একদলা মাটিও ধুয়ে নিয়ে যায় তবে ইউরোপ ততটুকু ক্ষুদ্রুতর
হয়ে আসে। আমি মানবজাতির সঙ্গে জড়িত।’ এ হল যথার্থ সাহিত্যিকের কথা। এখন
অধিকাংশ পাঠক ইতরসাধারণ বলে মননশীল লেখক যদি তাদের দিক থেকে মুখ ফেরান, তবে
মানব জাতির সঙ্গে তাঁর সংযোগ যে সঙ্কীর্ণ এবং দুর্বলতার হয়ে আসবে এ আশঙ্কা
অযৌক্তিক নয়। তিনি যতই আত্মবিশ্লেষণ বা আত্মোপলদ্ধির দ্বারা এ অভাব পূরণ
করার চেষ্টা করুন না কেন, তাঁর পক্ষে উপজীব্য অভিজ্ঞতায় ব্যাপ্তি এবং
বহুমুখিতা কমে আসবে; উন্মুখ জীবনজিজ্ঞাসা অভিমানী আদর্শের আওতায় ক্রমে
শীর্ণতর হবে; এবং এ আশঙ্কাও কষ্ঠকল্পিত নয় যে, অবশেষে তিনি জীবনের চাইতে
প্রতীককে বড় চিন্তা করে ভাষাপ্রয়োগে নিপুণতা অর্জনের মধ্যেই সাহিত্যিক
চরিতার্থতা সন্ধান করবেন। এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য যে শব্দপ্রয়োগের নিপুণতার
দ্বারাই ভাষা সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ সহজ
কথাটিও স্মরণে রাখা দরকার যে ভাষা মাধ্যম মাত্র, তার নিজস্ব কোনও মূল্য
নেই, তার দ্বারা মানুষ আপন আপন অনুভুতি-অভিজ্ঞতাকে সাধারণবোধ্য রূপ দিতে
এবং ফলে পরস্পরের গোচর করতে পারে বলেই তা মূল্যবান। সাহিত্যিক এই সহজ কথাটি
ভুলে যখন সমাজের উপরে অভিমান করে শুধু রীতিপ্রকরণের চর্চাকেই সাহিত্যের
মুখ্য উদ্দেশ্য করে তুলতে চান, তখনই সাহিত্যের একেবারে গোড়াতে কোপ পড়ে।
ফলত
মননশীল লেখকদের সঙ্গে সাধারণ পাঠকের অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনের
মানসিক ব্যবধান যত বৃদ্ধি পায় ততই লেখকের ভাবনা-কল্পনা মানবজাতির সঙ্গে
সংযোগের কথা ভূলে এক দিকে আত্মকেন্দ্রিক, অন্য দিকে প্রকরণ প্রধান হয়ে ওঠে।
তাঁর কল্পনার প্রাণশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে, তাঁর রচনায় শূন্যগর্ভতা,
পুনরাবৃত্তি এবং আত্ম প্রবঞ্চনা একে একে প্রকট হয়ে ওঠে। তাঁর বক্তব্য যত
কমে, তাঁর বলার ঢঙ তত প্যাচাঁলো, তাঁর বাক্যগঠন তত জটিল, তাঁর শব্দপ্রয়োগ
তত অস্বচ্ছ হয়ে ওঠে। তখন যে শুধু পাঠক-পাঠিকারাই তাঁর লেখা দেখে ভয় পায় তা
নয়, রসিকজনদের পক্ষেও সে লেখা সম্ভোগ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। পটুত্ব,
অধ্যবসায় এবং আদর্শনিষ্ঠা সত্বেও তিনি লেখক হিসেবে সার্থক হয়ে উঠতে পারেন
না। যেহেতু তিনি বস্তুত মননশীল লেখক, তাঁর রচনায় অবশ্য বহু সম্পদ ইতস্তত
বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে; পরবর্তী লেখকেরা হয়তো তা থেকে অনেক মূল্যবান শিক্ষা
এবং উপাদান সংগ্রহ করেন; তবু সে রচনা প্রাণবান সমগ্রতায় হৃদয়সম্বাদী হয়ে
ওঠে না।
ফলত মননশীল লেখকদের সঙ্গে সাধারণ পাঠকের ভাবনা-কল্পনা
মানবজাতির সঙ্গে সংযোগের কথা ভুলে এক দিকে আত্মকেন্দ্রিক, অন্য দিকে
প্রকরণপ্রধান হয়ে ওঠে। তাঁর কল্পনার প্রাণশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে, তাঁর রচনায়
শুন্যগর্ভতা, পুনরাবৃত্তি এবং আত্মপ্রবঞ্চনা একে একে প্রকট হয়ে ওঠে। তাঁর
বক্তব্য যত কমে, তাঁর বলার ঢঙ তত প্যাচাঁলো, তাঁর বাক্যগঠন তত জটিল, তাঁর
শব্দপ্রয়োগ তত অস্বচ্ছ হয়ে ওঠে। তখন যে শুধু সমালোচকরাই তাঁর লেখা দেখে ভয়
পায় তা নয়, রসিকজনদের পক্ষেও সে লেখা সম্ভোগ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।
পটুত্ব, অধ্যবসায় এবং আদর্শনিষ্ঠ সত্বেও তিনি লেখক হিসেবে সাথক হয়ে উঠতে
পারেন না। যেহেতু তিনি বস্তুত মননশীল লেখক, তাঁর রচনায় অবশ্য বহু সম্পদ
ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে; পরবর্তী লেখকেরা হয়তো তা থেকে অনেক মূল্যবান
শিক্ষা এবং উপাদান সংগ্রহ করেন; তবু সে রচনা প্রাণবান সমগ্রতায়
সহৃদয়হৃদয়সম্বাদী হয়ে ওঠে না।
কিন্তু মননশীল লেখকের সঙ্গে সাধারণ
পাঠকের বর্ধিষ্ণু ব্যবধানের ফলে শেষোক্তের ক্ষতির সম্ভাবনা আরও বেশি। লেখক
ক্ষতিকেও সৃজনসামর্থ্যে ফলপ্রসূ করে তুলতে পারেন; মনোজগতের কোনও সঙ্কটই
তাঁর পক্ষে একেবারে অনতিক্রম্য নয়। ফলে যে সব বিপদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে
শক্তিমান লেখকের পক্ষে তার কোনওটিই অবশ্যম্ভাবলী বলা চলে না। সমকালীন
অনাত্মীয়তার গ্লানি সত্ত্বেও তিনি মনের ভারসাম্য এবং উম্মুক্ততা নাও হারাতে
পারেন; সৃষ্টির দুর্লভ আনন্দ তাঁর কল্পনাকে নিতান্ত প্রতিকূল অবস্থাতেও
সরস রাখতে পারে। মন্টেইনের মানসিক নিঃসঙ্গতার কথা কে না জানে? অথচ পশ্চিম
ইউরোপের সাহিত্যে এই স্থিতধী মানুষটির কৌতুকপ্রোজ্জ্বল প্রবন্ধাবলীর তুলনা
মেলা কঠিন। গ্যোয়েটেকে আপনজন বলে জার্মানি কোনও দিনই গ্রহণ করতে পারেনি।
তাতে জার্মান জাতির অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে-সে ক্ষতি যে কত বড় সে-দেশের
অধিকাংশ স্ত্রীপুরুষ আজও তা বুঝতে শিখল না কিন্তু তার ফলে গ্যোয়েটের
মানবতন্ত্রী প্রত্যয় এবং জীবন জিজ্ঞাসা এতটুকু শিথিল কি অবসাদগ্রস্ত হয়নি।
সাহিত্যিক হচ্ছেন শিল্পী, স্রষ্টা; তিনি সেই দুর্লভ ক্ষমতার অধিকারী যার
বীজ নৈঃসঙ্গের বন্ধ্যাভুমিতেও ফসল ফলাতে সক্ষম। তাই স্বদেশত্যাগি জেম্স
জয়েসের পক্ষে ‘ইউলিসিস’-এর মতো এপিক উপন্যাস লেখা সম্ভব হয়েছিল। বুলভার
হাউজ্মান-এর জানালাবন্ধ কর্কমোড়া ঘরে জীবন কাটিয়েও মার্সেল প্রস্ত এ যুগের
শ্রেষ্ট ফরাসি উপন্যাস লিখতে পেরেছিলেন। অভিযুক্ত আসামী জাঁ-জেনে কারাগারে
বসে মানুষের সর্বাত্মক ব্যর্থতা নিয়ে মহৎ নাটক লিখে গেছেন। জার্মানী ছাড়তে
বাধ্য হয়েও টমাস মান কলম ছাড়েননি; ‘ডক্টর ফাউস্ট’-এর কাহিনীতে জার্মান
সভ্যতার ট্রাজেডির মহত্তম বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।
কিন্তু সাধারণ
পাঠক সে ক্ষমতার অধিকারী নন। মননশীল লেখকের মনোজগতে যদি তিনি প্রবেশ করতে
অসমর্থ হন, তবে তাঁর যে লোকসান তা পূরণ করা তাঁর সাধ্যের বাইরে। মননশীল
সাহিত্য আমাদের অনুভুতিকে সূক্ষ্মতর করে, আমাদের বোধে গভীরতা আনে, আমাদের
বুদ্ধির পরিুশীলন ঘটায়, আমাদের বিচিত্র এবং অনেক সময়ে পরস্পরবিরোধী
চিত্তবৃত্তির মধ্যে সঙ্গতি আনে, অভ্যাসের আড়ষ্ট সঙ্কীর্ণতা দূর করে
মনুষ্যত্বের অমিত সম্ভাবনা বিষয়ে আমাদের জাগ্রত করে তোলে। সাহিত্যপাঠে
আমাদের মন সরস হয়, আমাদের বিচারে ঔদার্যের সঞ্চার ঘটে, আমরা সব দেশের সব
কালের মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপনের শক্তি অর্জন করি। সব চাইতে বড় কথা,
সাহিত্যসম্ভোগের মধ্য দিয়ে আমরা কিছুমাত্রায় সাহিত্যিকের সৃজন-অভিজ্ঞতার
স্বাদ পাই; এবং যেহেতু সৃজনের মধ্যেই মানুষের মুক্তি, সে কারণে মানুষের
জীবনে এ অভিজ্ঞতা অমূল্য। তাই সাহিত্যের এই দুর্লভ সম্পদে যে মানুষ অংশীদার
হতে পারল না, তাকে নিতান্ত হতভাগ্য বলা ছাড়া উপায় দেখি না।
আধুনিক
কালে কমবেশি প্রায় সব দেশেই মননশীল লেখক এবং সাধারণ পাঠকের মধ্যে বর্ধিষ্ণু
ব্যবধানের সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। এ সমস্যার মূল সুদূরপ্রসারী; তার শুধু
সাহিত্যের ক্ষেত্রে আবদ্ধ নয়। আধুনিক সমাজে জনসাধারণের অধিকার একদিকে যেমন
স্বীকৃতিলাভ করেছে, অন্যদিকে তেমনি জনমর্থনের সুযোগ নিয়ে মুষ্টিমেয় লোকের
হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ বেড়ে চলেছে। বিত্তবান এবং দরিদ্র সম্প্রদায়ের
মধ্যে ব্যবধান যেমন কমছে, তেমনি উৎপাদন এবং বন্টন ব্যবস্থার উপরে রাষ্ট্রের
একচেটিয়া দখল ক্রমেই সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। শিক্ষার দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটছে
ঠিকই; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে, শিক্ষাপদ্ধতির
বৈচিত্র্য কমছে, শিক্ষকের স্বাধীনতা লোপ পাচ্ছে। এযুগে সাহিত্যের সঙ্কট এই
সর্বব্যাপী সঙ্কটের একটা দিক। সাহিত্যের পাঠক বেড়ে চলেছে, কিন্তু তাদের
সাহিত্যবোধ গড়ে উঠছে না। ফলে যাঁরা অভিমানী সাহিত্যিক তাঁদের মধ্যে অনেকেই
সাধারণ পাঠকের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তাঁদের সাহিত্যসৃষ্টিকে ক্রমেই আরও
জটিল, আরও দুর্বোধ্য করে তুলছেন। অপরপক্ষে অধিকাংশ সাধারণ লেখক পাঠক
সম্প্রদায়ের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে সচেতনভাবে সাহিত্যে স্থলতার আমদানী করে
চলেছেন। তাঁদের ভাষা অমার্জিত, প্রকাশরীতি ব্যঞ্জনা বিহীন, মানুষের আদিম
পাশব প্রবৃত্তির করে তাঁদের আবেদন।
এ সমস্যার সমাধান কোন পথে সে কথা
বলা শক্ত। কেননা এ সমস্যার স্বরূপ নিয়ে এখনও কোনও স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে এ সমস্যা নিয়ে পশ্চিমী মনীষীরা বিস্তারিতভাবে
আলোচনা শুরু করেছেন; তার ফলে এর ব্যাপকতা এবং ভয়াবহতা সম্বন্ধে বোধ ক্রমেই
গভীর হয়ে উঠছে। এসব আলোচনা থেকে সমাধানের একটা সম্ভাব্য সূত্র চোখে পড়ে!
সাধারণ মানুষ আজ যে-সব অধিকার পেয়েছে, বা পেতে চলেছে, তা থেকে তাদের বঞ্চিত
করা সম্ভব নয়, এবং সে চেষ্টা কোনও বিবেকবান ব্যক্তির পক্ষে সমর্থনযোগ্য
নয়। আসল কাজ হল সাধারণ মানুষের অনুভূতি, সুকুমারবৃত্তি এবং মননশক্তির
বিকাশসাধনের ব্যবস্থা করা। আজকের লেখক কখনই আর রাজা কিংবা অভিজাত
সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতার যুগে ফিরে যাবার কথা ভাবতে পারেন না। কিন্তু তিনি
যদি অক্ষরপরিচয়প্রাপ্ত পাঠকপাঠিকার অনুশীলনহীন ভোগসামর্থ্যরে স্তরে নেমে
এসে প্রতিষ্ঠা অর্জনের প্রয়াসী হন তাতে শিল্পী হিসেবে তাঁর নিজের সমূহ
ক্ষতি তো হবেই, পাঠক সম্প্রদায়েরও তাতে কোনও লাভ হবে না। মননশীলসাহিত্যিকের
কাছে মননশীলপাঠকের ন্যূনতম প্রত্যাশা, তিনি কখনও করুণা অথবা লোভের বশে
তাঁর শিল্প-বিবেককে দুর্বল হতে দেবেন না। অপর পক্ষে আজকের যুগে এই
প্রত্যাশা পূরণের প্রধান শর্ত হল মননশীলপাঠকের সংখ্যা বাড়ানো। সাধারণ
পাঠকের একটা বড় অংশকে মননশীলপাঠকে পরিণত করতে না পারা পর্যন্ত সাহিত্যের
বর্তমান সঙ্কটের কোনও সমাধান অকল্পনীয়। এবং একাজে সাহিত্যিকের দায়িত্ব
কতটুকু তা নির্ণয় করা কঠিন হলেও, শিক্ষক, সমালোচক এবং সমাজ-সংস্কারকের
দায়িত্ব যে অনেকখানি সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।