ইউএনবি:
জানুয়ারির প্রথম সাত দিনে দেশে দুবার ভূমিকম্প অনুভূত হলো। এর মধ্যে আজ
মঙ্গলবার সকালে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্প ছিল তীব্র ধরনের। আর ৩ জানুয়ারি হওয়া
ভূমিকম্পটি ছিল মাঝারি মাত্রার। এটি দেশকে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে
থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
দুই ভূমিকম্পের অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো,
দুটোরই উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের বাইরে। আজকেরটির উৎপত্তিস্থল চীনের জিজাং
এলাকা। আর ৩ জানুয়ারির ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমারের হোমালিন
নামের একটি স্থান।
বাংলাদেশে কোনো হতাহতের খবর না পাওয়া গেলেও এটি
ভবিষ্যতে সম্ভাব্য বিপর্যয়কর ভূমিকম্প মোকাবিলায় দেশের প্রস্তুতির দিকে
নতুন করে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে,
সাম্প্রতিক নিদর্শনগুলো কেবল ২০২৪ সাল থেকে ৬০টিরও বেশি ভূমিকম্প রেকর্ড
করা হয়েছে। এসব ঘটনা ব্যাপক দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতির জরুরি প্রয়োজনের
প্রতিই ইঙ্গিত দেয়।
সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত
বাংলাদেশ ব্যাপক ভূমিকম্পের ঝুঁকির মুখোমুখি। এখানকার ঘনবসতি, পুরোনো
অবকাঠামো এবং বিল্ডিং কোডের দুর্বল প্রয়োগ এই বিপদগুলোকে আরো বাড়িয়ে
তুলেছে। অবিলম্বে পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ভবিষ্যতের জন্য একটি ভয়াবহ দৃশ্য
অপেক্ষা করছে।
নেপাল, ভারত, ভুটান ও চীনেও ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে, যা এই ধরনের দুর্যোগের আন্তঃদেশীয় মাত্রাকে তুলে ধরে।
ঝুঁকিতে দেশ:
বেশ
কয়েকটি সক্রিয় ফল্ট লাইনসহ টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ অঞ্চলে বাংলাদেশের
অবস্থান দেশটিকে উল্লেখযোগ্য ঝুঁকিতে ফেলেছে। ঐতিহাসিকভাবে, এই অঞ্চলে
বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছে, ১৮৬৯ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে পাঁচটি বড় ঘটনা
রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক শূন্যের ওপরে নিবন্ধিত হয়েছে। এরপর থেকে উচ্চ
মাত্রার ভূমিকম্প স্তিমিত হয়ে আসছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ভূমিকম্পের বিপর্যয়ের আগে এই নীরবতা থাকতে পারে।
সাম্প্রতিক
বছরগুলোতে ভূমিকম্পের আঘাত উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে দেখা গেছে। ২০২৪ সাল থেকে
রেকর্ড করা ৬০টি ভূমিকম্পের মধ্যে তিনটি ৪ দশমিক শূন্য মাত্রার ওপরে এবং
৩১টি ৩ দশমিক শূন্য থেকে ৪ দশমিক শূন্যের মধ্যে ছিল। এই ঊর্ধ্বগতি, শহর
এলাকায় বিস্তৃতি এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত জাতিকে
ঝুঁকিপূর্ণভাবে তুলে ধরে।
ঝুঁকিপূর্ণ শহর ঢাকা:
ভূমিকম্পে বিশ্বের
সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের তালিকায় ঢাকা অন্যতম। ২০১৩ সালের রানা প্লাজা
ধসের ঘটনা ঘটে। এতে ১ হাজার ১০০ জনেরও বেশি লোক প্রাণ হারায়। এই ঘটনাটি
দুর্বলভাবে নির্মিত ভবনগুলোর সৃষ্ট বিপদের একটি ভয়াবহ উদাহরণকে তুলে ধরে।
২০১৮
সালের এক জরিপে দেখা গেছে, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পল্লবী, রামপুরা, মতিঝিল ও
খিলগাঁওয়ের মতো এলাকার অনেক স্থাপনা কাঠামোগত ও নকশার মান পূরণে ব্যর্থ
হয়েছে।
চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের জৈন্তাপুর চরম
ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় একটি উচ্চমাত্রার
ভূমিকম্প ঢাকায় অকল্পনীয় মাত্রার বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
আন্তঃদেশীয় ভূমিকম্প ঝুঁকি মূল্যায়ন:
২০২৪
সালের মার্চে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় (এমওডিএমআর)
বাংলাদেশে আন্তঃদেশীয় ভূমিকম্প ঝুঁকি মূল্যায়ন চালু করে। যা জাতিসংঘের
দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কার্যালয় (ইউএনডিআরআর) এবং গ্লোবাল ভূমিকম্প মডেল
(জিইএম) ফাউন্ডেশনের সহায়তায় একটি কার্যকর পদক্ষেপ।
এই উদ্যোগটি
দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করতে এবং কার্যকরী কৌশলগুলোর সুপারিশ করার জন্য
উন্নত সম্ভাব্য ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ ধরণ, ভবনের ঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং
ভঙ্গুরতার মূল্যায়নকে তুলে ধরে।
ঢাকায় চার দিনব্যাপী প্রচার অনুষ্ঠানে
প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যে গুরুতর দুর্বলতার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তা, মানবিক সহায়তা সংস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের
ঐতিহাসিক ভূমিকম্প, কাল্পনিক পরিস্থিতি এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা সম্পর্কে
অবহিত করা হয়। ৩৫ জন শিক্ষার্থীকে ভূমিকম্পের ধরনের ওপর কারিগরি প্রশিক্ষণ
দেওয়া হয়, যা পরবর্তী প্রজন্মকে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় প্রস্তুত করে।
দুর্বলতা প্রকাশ:
মূল্যায়ন থেকে মূল অভ্যন্তরীণ উল্লেখযোগ্য ত্রুটিগুলো প্রকাশ করে-
ভঙ্গুর
অবকাঠামো- হাসপাতাল, জরুরি প্রতিক্রিয়া কেন্দ্র এবং সরকাররি দপ্তরগুলো এমন
কাঠামোর মধ্যে রয়েছে, যা ভূমিকম্পের ধাক্কা সহ্য করার জন্য জরুরি
পুনর্র্নিমাণের প্রয়োজন।
নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি- বিল্ডিং কোডের দুর্বল
প্রয়োগ এবং দ্রুত অপরিকল্পিত নগরায়ণ ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষ করে ঢাকার মতো
ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়।
জনসচেতনতার ঘাটতি- জরুরি প্রটোকলগুলোর বিষয়ে কম বোঝার কারণে অনেক নাগরিক ভূমিকম্প পরিস্থিতির জন্য অপ্রস্তুত থাকেন।
কার্যকর উদ্যোগের আহ্বান:
আন্তঃদেশীয়
মূল্যায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে চিহ্নিত হলেও বিশেষজ্ঞরা ঝুঁকি
কমাতে একটি সমন্বিত, বহুমাত্রিক ক্ষেত্রভিত্তিক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার ওপর
জোর দিয়েছেন। মূল সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে:
* শক্তিশালী বিল্ডিং কোড ও প্রয়োগ করা।
* ভূমিকম্প প্রস্তুতি সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো।
* গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো পুনর্র্নিমাণের জন্য সম্পদ বরাদ্দ করা।
* দক্ষতার সঙ্গে বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য বেসামরিক-সামরিক সমন্বয় বৃদ্ধি করা।
আন্তঃদেশীয়
মূল্যায়নের সুপারিশগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার
দুর্বলতাগুলোকে ভূমিকম্পের হুমকির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষায়
রূপান্তর করতে পারে।