নিজস্ব
প্রতিবেদক।। দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখর শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘরসহ
কুমিল্লার পুরাকীর্তির দর্শনীয় স্থানগুলো। ছুটির দিন হওয়ায় বেড়েছে
নারী,শিশুসহ নানান বয়সী মানুষের সমাগম। এছাড়া সারা বছরের তুলনায় শীত মৌসুমে
কুমিল্লার এ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোতে বাড়ে ভ্রমণপিপাসুদের ভিড়। এতে
বাড়ছে রাজস্ব আয়ও।
শালবন বিহার ও জাদুঘরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন,
নতুন অর্থ বছরের শুরুতেই কোটাবিরোধী আন্দোলন, এরপর বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন
এবং ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানসহ দেশের নানা সমস্যা, সংকটের কারণে
দর্শনার্থীদের উপস্থিতিতে একটু ভাটা পড়লেও আবারও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে
শালবন বিহার ও জাদুঘরে চিরায়ত পরিবেশ। এতে শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘরে
বেড়েছে রাজস্ব আয় ও দর্শনার্থী। এছাড়া বছরের চলতি মৌসুমের এ সময়টি জেলার
পুরাকীর্তির দর্শনীয় স্থানগুলোতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ঢল নামে। শালবন
বিহার ময়নামতি জাদুঘর ছাড়াও ইটাখোলা মুড়া, রূপবান মুড়াসহ সব
প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোতে একই অবস্থা বিরাজ করছে।
প্রত্নতত্ত্ব
অধিদপ্তর কুমিল্লার শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মোঃ শাহীন
আলম বলেন , বিশেষ করে স্বাভাবিক দিনগুলোর তুলনায় ছুটির দিন শুক্রবার ও
শনিবারে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। যেখানে প্রতিটি ছুটির
দিনে প্রায় এক লাখ টাকা করে রাজস্ব আয় হচ্ছে। যেটি স্বাভাবিক দিনগুলোর
তুলনায় প্রায় তিনগুণ। জুলাই থেকে দেশের নানা অস্থিরতা মধ্যেও গেল ছয় মাসে
৪৩ লাখ ৪৫ হাজার ৯৭৬ টাকার রাজস্ব আয় হয়েছে।
এদিকে পর্যটনের মৌসুমের এই
সময়টায় কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলা বা আশপাশের জেলা ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে
আসছেন দর্শনার্থী। এছাড়াও বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে
জেলার পুরাকীর্তির দর্শনীয় স্থানগুলোর ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে এবং
সৌন্দর্য উপভোগ করতে বাসে বাসে আসছেন শিক্ষার্থীরা।
জেলার লালমাই
ময়নামতি পাহাড়ে একটি সমৃদ্ধ প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন রয়েছে। এখানে রয়েছে
শালবন বিহার, চন্দ্রমুড়া, রূপবান মুড়া, রানীর বাংলার পাহাড়, নব শালবন বিহার
প্রভৃতি। এসব বিহার, মুড়া ও প্রাসাদ থেকে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে, যা ময়নামতি জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। কুমিল্লাতে
রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত বিভিন্ন দেশের সৈন্যদের কবর ও ওয়ার
সেমেট্রি । এখানে আছে ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমিসহ (বার্ড)
অনেক দর্শনীয় স্থান।
এছাড়া বেসরকারীভাবে বিশাল পরিসরে গড়ে উঠা লালমাই
পাড়ের উপরে লালমাই ল্যাক ল্যান্ড পার্ক। রয়েছে কোটবাড়িতে ম্যাজিক
প্যারাডাইস পার্ক, ব্লু ওয়াটার পার্ক, ডায়নারস পার্ক, ফ্যান টাউনসহ বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠান।
কুমিল্লা শহর থেকে আট কিলোমিটার পশ্চিমে কোটবাড়ি। এখানে
রয়েছে শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘর। প্রায় ৩৭ একর জায়গা জুড়ে শালবন বিহার
বাংলাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধবিহার। সমতল থেকে যার উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। বুদ্ধ
রাজাদের সময় সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীতে এ শালবন বৌদ্ধবিহার স্থাপিত হয়। আর
ময়নামতি জাদুঘরে রয়েছে অসংখ্য পুরাকীর্তি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের
প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় রয়েছে ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান দু’টি। প্রতিদিন
হাজারো দেশি পর্যটক-দর্শনার্থী ছাড়াও বিদেশি পর্যটকের সমাগম ঘটে ঐতিহাসিক
শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘরে।
টিকিট বিক্রি, গাড়ি পার্কি, ইজারাসহ
বিভিন্ন খাতে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে কুমিল্লা ময়নামতি যাদুঘর শালবন বিহার
প্রত্ন এলাকা থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ১ কোটি ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ টাকা। এ
সময়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে এ পর্যটন স্পটটি দেখতে এসেছেন প্রায় ৫
লাখ ২৮ হাজার ৭৬৫ জন দেশী-বিদেশী দর্শনার্থী।
এর আগে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে
কুমিল্লা ময়নামতি জাদুঘর শালবন বিহার প্রত্ন এলাকা থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ১
কোটি ৪ লাখ ১৩ হাজার ৩৪৯ টাকা। এ সময়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে এ
পর্যটন স্পটটি দেখতে এসেছেন প্রায় ৫ লাখ ২৮ হাজার ৭৬৫ জন দেশী-বিদেশী
দর্শনার্থী।
এ বছর দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় দর্শনার্থীর সংখ্যাও
বাড়বে। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে রাজস্ব আয় প্রায় দেড় কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে জানান
ময়নামতি জাদুঘর শালবন বিহার কতৃপক্ষ।
ময়নামতি জাদুঘর দেখতে আসা পাবনা জেলার বাসিন্দা ফরহাদ হোসেন জানান, অনেক দিন থেকে শুনেছি। আজ আসলাম ভালো লেগেছে।
বগুড়া
থেকে আসা ডাক্তার সিয়াম হোসেন জানান, জীবনে প্রথম আসলাম। এটি একটি
ঐতিহাসিক স্থান। ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পকে জানতে হলে বুঝতে হলে সবারই একবার
হলেও আসা উচিত।
কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থেকে আসা মুরাদ হোসেন জানান,
ময়নামতি জাদুঘরে এসে আগেরকার সময় রাজা বাদশার জীবন যাপনের কিছু চিত্র আমরা
দেখলাম। তাদের ব্যবহত অনেক তৈজসপত্র বিবরণসহ লেখা আছে। প্রাচীন অনেক পূর্তি
আছে। বিভিন্ন যুগের লেখাপড়ার ধরন থেকে বর্তমান যুগরে একটা ধারাবাহিকতা
আমরা দেখলাম। আমাদের ভ্রমণও হলো জানাও হলো।
নরসিংদী থেকে আসা শিক্ষার্থী
মোস্তাক আহম্মেদ জানান,কুমিল্লায় ঘুরতে এসে প্রাচীন সভ্যতার বিষয়ে নিজের
জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি পাহাড় বন, দীঘি, মসজিদ মন্দিরসহ বিভিন্ন
স্থান ঘুরে অনেক ভাল লাগলো। সব কিছুরই সমন্বয় আছে এখানে।
ঢাকা থেকে আসা
লামিসা তাবাসুম বলেন, আগে স্কুল থেকে একবার বনভোজনে এখানে এসেছিলাম। আজ
একটি চাকুরীর প্রশিক্ষণে কুমিল্লা বার্ড এ আসলাম। সেখান থেকে ময়নামতি
জাদুঘরে ঘুরতে আসি। এ জাদুঘর আগে অন্ধকার ছিলো। এখন দেখলাম এর সংস্কার কাজ
চলছে। ভিতরে আলোকিত করা হচ্ছে। এছাড়া প্রাচীন যুগের বস্তুর সঙ্গে বর্তমান
যুগের বস্তু রাখা হয়েছে। ফলে আমাদের সহজেই বুঝতে অনেক সুবিধা হয়েছে। এছাড়া
কিউআর কোড এ বিস্তারিত আমরা স্ক্যান করে জানতে পারছি। এ উদ্যোগ অনেক ভালো
লেগেছে।
টুরিষ্ট পুলিশ কুমিল্লা জোনের উপ-পরিদর্শক এহতেশামুল হক জানান,
টুরিষ্ট পুলিশ কুমিল্লার বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় পোশাকধারীর পাশাপাশি সিভিল
পোশাকে দায়িত্ব পালন করছে। আমাদের কড়া নজরদারি আর নিরাপত্তা ব্যবস্থা
জোরদার হওয়ায় শালবন বিহার এলাকায় নেই ছিনতাই ও চোরের উৎপাত। নির্বিঘ্নে
দর্শনার্থীরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর আনন্দ উল্লাস করছেন।
কুমিল্লার অধিদপ্তর
কুমিল্লার শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মোঃ শাহীন আলম
জানান, প্রাচীন জনপদের মধ্যে অন্যতম সমতট। সমতটের রাজধানী বা প্রাচীন
কেন্দ্র বলা হয় লালমাই ময়নামতিকে। লালমাই ময়নামতিতে এ পর্যন্ত খনন করে
অনেকগুলো প্রত্নতত্ত্ব সাইড উন্মোচন হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও
গুরুত্বপূর্ণ সাইড হলো শালবন বিহার। বিহারের পাশে রয়েছে ময়নামতি জাদুঘর।
প্রতি বছর শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘর দেখার জন্য প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ
দর্শনার্থী আসে। দর্শনার্থীদের চাহিদা প্রেক্ষিতে প্রতিবছরে আমরা কিছুনা
কিছু পরিবর্তন আনি এবং সেবা বৃদ্ধির চেষ্টা করি। এর মধ্যে আমরা ময়নামতি
জাদুঘরের প্রদর্শনী কেন্দ্রটিকে আগের চেয়ে আরো আধুনিককায়ন করছি। প্রদর্শিত
প্রত্যেকটি প্রচীন ও পূরাকীর্তির মূর্তি , বস্তুর সঙ্গে কিউআর কোড সংযুক্ত
করা হয়েছে। ফলে যে কেউ চাইলে স্ক্যান করে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবে। আগের
মত কাগজে হাতে লিখতে হবে না। এছাড়া কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাপ বিভিন্ন স্থানে
স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পুরো পর্যটন এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার বিষয়ে
বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন দর্শনার্থীরা। এছাড়া এ অঞ্চলের তথ্য জানতে
একটি বই বিক্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য সৌচাগারের সংখ্যা
বাড়ানো হয়েছে। গাড়ি পার্কিং এর সঙ্গে সঙ্গে মোটর সাইকেল পার্কিং এর
ব্যবস্থা করা হয়েছে। চারস্তর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া শালবন
বৌদ্ধ বিহার ও ময়নামতি জাদুঘর অরো উন্নয়ণে বিভিন্ন পরিকল্পনা করে অধিদপ্তরে
পাঠানো হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, দর্শনার্থীদের সংখ্যা আমাদের পূর্ব থেকে
বেড়েছে। গত অর্থ বছর ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বেশি রাজস্ব আয় হয়েছে। যা এর আগের
বছরের তুলনায় ৩৫ লাখ টাকার বেশি। এ অর্থ বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার উপরে
রাজস্ব আয় হবে বলে আশা করছি।