আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। তাৎক্ষণিক যে রাজনৈতিক ঐক্যের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, সেটিও অটুট থাকছে না। বরং অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভেদ বা দূরত্বই ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। সন্দেহ, অবিশ্বাস ক্রমেই বাড়ছে।
এই অবস্থায় রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার দাবি ক্রমেই প্রবল হচ্ছে। অন্তর্র্বতী সরকারের পক্ষ থেকে নানা রকম সংস্কারের গুরুত্ব তুলে ধরা হলেও রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, নির্বাচনসংক্রান্ত অতি জরুরি কিছু সংস্কার করে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দিতে হবে। অন্য সব সংস্কার করবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সরকার। তাদের মতে, অনির্বাচিত সরকারের সংস্কারমূলক সব সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।
সংস্কারের সিদ্ধান্ত হতে হবে নির্বাচিত জাতীয় সংসদে।
দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি সাধারণ মানুষ ক্রমেই ক্ষুব্ধ করে তুলছে। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সংগতি না থাকায় দেশে পুনরায় দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নানামুখী অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।
ডলারের বিপরীতে ক্রমাগতভাবে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত শিল্পোদ্যোক্তারা নানামুখী হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে শিল্প-কারখানা ধুঁকছে।
কয়েক শ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরো অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। বেকারত্ব বাড়ছে। বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ। রাজপথের উত্তেজনাও ক্রমেই বাড়ছে। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারেরও অনেকে ভাবতে শুরু করেছেন, দ্রুত রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই শ্রেয়। অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরো এক মাস আগেই বলেছেন, ‘আমাদের এই সরকার খুবই স্বল্পকালীন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আগামী বছরই (২০২৫ সাল) আমরা একটি রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার দেখব। জানি না কী হবে।’
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করে ১৮ মাস বা দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে যেকোনো পরিস্থিতিতে পূর্ণ সহায়তা করা হবে। তখন একাধিক উপদেষ্টা বলেছিলেন, সংস্কারের জন্য প্রয়োজন হলে আরো বেশি সময় নেওয়া হবে। ক্রমে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি প্রবল হতে থাকে। বিএনপির অনেক নেতা অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডে এক-এগারোর নীলনকশা কিংবা ‘মাইনাস টু’ ধরনের ষড়যন্ত্র দেখতে পান। এমন পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা ২০২৫ সালের মধ্যে বা ২০২৬ সালের শুরুতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আভাস দেন। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছিলেন, নির্বাচন ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে হতে পারে। তিনিও পরে বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো কতটুকু সংস্কার চাইবে, তার ওপর নির্ভর করে ২০২৫ সালেও নির্বাচন হতে পারে।
বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে একমত পোষণ করে আমরাও মনে করি, দেশের স্বার্থে দ্রুত রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসা প্রয়োজন। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা প্রয়োজন।