বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫
২ মাঘ ১৪৩১
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য: বিব্রতকর সংকটের সমাধান হোক
ড. এ কে এম মাহমুদুল হক
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২৫, ১:১৮ এএম আপডেট: ১৪.০১.২০২৫ ২:০২ এএম |

 আন্তঃক্যাডার বৈষম্য: বিব্রতকর সংকটের সমাধান হোক


প্রশাসন শব্দের অর্থ আসলে কী? এটি কি শাসন কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তি বোঝায়? খেয়াল করলে দেখা যায়, শাসক শব্দের আগে “প্র” নামক একটি সংস্কৃত উপসর্গ যুক্ত হয়েছে। এভাবে যদি প্রাদি সমাসের সাহায্যে প্রশাসনের অর্থ নির্ধারণ করি, তাহলে তা দাঁড়ায় “প্রকৃষ্ট রূপে শাসন”। যারা এই কাজটি করেন, তাদের বলা হয় প্রশাসক।
এখন প্রশ্ন হলো, প্রকৃষ্ট অর্থ কী? আমরা জানি, উপসর্গের সরাসরি কোনও অর্থ থাকে না, তবে এটি অর্থের দ্যোতনা প্রদান করে। এখানে “প্র” উপসর্গটি শাসক বা শাসনের দ্যোতনা করছে। প্রকৃষ্ট শব্দটি শাসন শব্দের সম্প্রসারণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রকৃষ্ট শব্দের অর্থ বিভিন্নভাবে বোঝানো যায়। প্রথমত, এটি উৎকৃষ্ট অর্থে ব্যবহার হতে পারে। আবার এটি মারাত্মক বা প্রচণ্ড অর্থেও প্রযোজ্য হতে পারে।
তবে, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রকৃষ্ট শব্দটি উৎকৃষ্ট অর্থে ব্যবহার করা খুব কঠিন। দুর্নীতির অভিযোগে আলোচিত এই দেশে প্রশাসনের কিছু সদস্য যেভাবে অর্থলুণ্ঠন ও অর্থপাচারে বিরামহীন নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাতে স্পষ্ট যে এখানে “প্র” উপসর্গের প্রকৃত কার্যকারিতা কী।
আমরা যদি ২০২৩ সালের টিআইবির রিপোর্টের দিকে নজর দিই, সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে বাংলাদেশের প্রতি ১০টি পরিবারের মধ্যে ৭টি নিয়মিত দুর্নীতির শিকার হয়েছে। শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই দেশের মানুষ যে পরিমাণ টাকা ঘুষ দিয়েছে, তা দিয়ে যদি হাসপাতাল তৈরি করা হতো, তাহলে ২০০ থেকে ৩০০টি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করা যেতো।
যদি সেই অর্থ দিয়ে স্কুল তৈরি করা হতো, তাহলে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার আধুনিক শ্রেণিকক্ষ তৈরি সম্ভব হতো। আর যদি রাস্তা নির্মাণে বিনিয়োগ করা হতো, তাহলে প্রায় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করা যেত। এখানে পাঠকদের অংকে জড়ানোর পরিবর্তে ক্ষতির পরিমাণের একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
একটি বিষয় আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, তা হলো-দুর্নীতিগ্রস্ত আমলারা সামাজিক চুক্তি লঙ্ঘন করেছেন। তারা কি তাদের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে সামাজিক চুক্তি মতবাদটি কখনও পড়ে দেখার বা গভীরভাবে অনুধাবন করার সুযোগ পেয়েছেন? নাকি আদৌ তাদের মধ্যে সে সদিচ্ছার অভাব রয়েছে?
সামাজিক চুক্তির ধারণাকে যদি আধুনিক গণতন্ত্র ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সাথে একীভূত করি, তাহলে এর সহজ ব্যাখ্যা দাঁড়ায়: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকরা তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে বিভিন্ন উৎপাদন ও সেবা কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকবেন। এ কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তারা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে অর্পণ করেছেন, যারা সরকার পরিচালনা করবেন। এই দায়িত্ব অর্পণের প্রক্রিয়াটিকেই বলা হয় সামাজিক চুক্তি।
এখানে সরকার ও তার প্রশাসনের সদস্যরা নাগরিকদের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত বা নির্বাচিত কর্মচারী মাত্র। তারা কোনোভাবেই নিজেদেরকে প্রশাসক বা শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অধিকার রাখেন না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, তাদের মধ্যে শাসক হওয়ার প্রবণতা এবং জনগণের সঙ্গে প্রভূসুলভ আচরণ সামাজিক চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি শুধু অনধিকার চর্চাই নয়, বরং গণতান্ত্রিক চেতনার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
তবে, এই বেপরোয়া মনোভাব একদিনে গড়ে ওঠেনি। ইতিহাস বলছে, এই প্রবণতার শিকড় গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে ব্রিটিশ আমল থেকেই। সেই সময় থেকেই প্রশাসনের একটি অংশ সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স নামক ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিল। আজ তার মাত্রা যেন ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
প্রশাসনের উৎপত্তি হয়েছিল মূলত খাজনা শোষণকে কার্যকর করার লক্ষ্যে, একটি অত্যাচারী সরকারি চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে। সেখান থেকে কতটা উন্নয়নমূলক বিবর্তন ঘটেছে, তা মূল্যায়ন করা অত্যন্ত কঠিন। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, সেই ঐতিহাসিক শোষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো পুরোপুরি বদলানো সম্ভব হয়নি।
একটি রাষ্ট্রে রাজনীতি, আইন, শাসন ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন কেন? দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বোঝা যায় যে, মানুষের মাঝে সৃষ্টিগত বা বিবর্তনগত যে ত্রুটি রয়েছে, তার ফলেই তারা সবসময় যৌক্তিক আচরণ করতে সক্ষম নয়। এই সীমাবদ্ধতার কারণেই আইন ও শাসনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। মানুষ যদি স্বভাবগতভাবে প্রাকৃতিক আইন মেনে চলতে পারত, তাহলে আমরা পৃথিবীতেই অগাস্টিনের বিধাতার রাষ্ট্রের প্রতিফলন দেখতে পেতাম। কিন্তু যেহেতু তা সম্ভব নয়, তাই রাজনীতি, আইন, শাসন এবং ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব অপরিহার্য।
অন্যদিকে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং অন্যান্য বস্তুগত প্রয়োজনীয়তা মানুষের জন্য অনিবার্য। আমাদের দেশের আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের যে চিত্র, তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট: যারা এই বৈষম্যের প্রতিবাদ করছেন, তাদের অধিকাংশই মৌলিক চাহিদা সংক্রান্ত বিষয়গুলোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আর যাদের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ, তাদের বেশিরভাগই রাজনীতি, আইন, শাসন এবং ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত।
এই বিভাজনই বৈষম্যের মূল শিকড়। এখানে দেখা যায়, জনগণের মৌলিক চাহিদার তদারকির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদেরকে বারবার অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। এর ফলে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে এবং সেবা প্রদান ব্যবস্থার প্রতি আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে।
 এই অবমূল্যায়নের চিত্র বিশদভাবে তুলে ধরার প্রয়োজন নেই, কারণ তাতে তুচ্ছ বিষয়গুলো-যেমন কে কত টাকা ভাতা পান, কার গাড়ির তেলের জন্য কত খরচ হয়, বা দুপুরের লাঞ্চে কত টাকা বরাদ্দ থাকে-এগুলো সামনে চলে আসবে। এমন বিষয়ে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে সভ্য রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বিতর্কের মধ্যে ফেলা কি লজ্জাজনক নয়?
মূল সমস্যাটি আসলে আরও গভীর, যা কেবল ভাতা বা সুবিধাদি কমানো-বাড়ানোর মাধ্যমে সমাধানযোগ্য নয়। এর মূলে রয়েছে আমাদের ব্যবস্থাপনার বিকেন্দ্রীকরণের অভাব। একটি টেকসই সমাধান হতে পারে, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ক্যাডারদের নিয়োগ থেকে অবসর পর্যন্ত সব কার্যক্রম ওই মন্ত্রণালয়ের অধীনেই রাখা। এর ফলে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমে আসবে এবং কাজের স্বচ্ছতাও বৃদ্ধি পাবে।
মন্ত্রণালয়গুলোর আরও বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে কথিত প্রশাসনিক আধুনিকায়নও সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, জেলা প্রশাসক পদাধিকারবলে যে বিপুলসংখ্যক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন এবং প্রভাব বিস্তার করেন, তা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শের সঙ্গে খাপ খায় না। এই ধরনের ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বা সাংবিধানিক পদাধিকারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত।
তাই, ক্ষমতার পুনর্বণ্টন এবং নীতিমালার সংস্কার নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। এটি শুধু প্রশাসনের আধুনিকায়নই করবে না, বরং বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে একটি টেকসই ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার পথও সুগম করবে।
একজন সাধারণ ও সচেতন নাগরিকের কাছে সচিব পদের শ্রেণিবিভাগ অত্যন্ত বিরক্তিকর। একইভাবে, উপসচিব পদের ২৫ ও ৭৫ শতাংশের মধ্যে বৈষম্য করা, তা আরও বেশি ভয়াবহ। জনসেবায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের কাজ হলো জনগণের সেবা প্রদান, কিন্তু বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, প্রলম্বিত পদসোপান এবং বিতর্কিত কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে মূলত আত্মসেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
একজন সচেতন নাগরিকের কাছে এই ধরনের ঝগড়া-বিবাদ অত্যন্ত বিব্রতকর এবং এসবের দ্রুত সমাধান প্রয়োজন।
জনসেবায় নিয়োজিত কর্মীদের মনে রাখতে হবে যে, তারা কখনোই শাসক বা শাসকের সমমর্যাদার কেউ নন। তাদের আরও মনে রাখতে হবে, আধুনিক জনকল্যাণমূলক প্রজাতন্ত্রে শাসক বা শাসনের ধারণা বৈধ নয়। এই কথিত প্রশাসনে অবস্থান করে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগের প্রচেষ্টা কোনোভাবেই সভ্য আচরণ হিসেবে গণ্য করা যায় না। জনকল্যাণের কাজেই তাদের মনোনিবেশ করতে হবে, যেখানে শাসকত্বের ধারণা নয়, সেবকত্বই প্রধান।
বাংলাদেশের প্রশাসন আসলেই আধুনিকায়িত হয়নি। এখানে আজও জেষ্ঠ্যতার ভিত্তিতে সুবিধা ভাগ করা হয়। এখনও টপ-ডাউন ব্যবস্থাপনা এবং পরিচালনা বিদ্যমান। ব্যবসা, প্রযুক্তি, উদ্ভাবনী, শিক্ষা-গবেষণা, চিকিৎসা ও প্রকৌশল অঙ্গনের তুলনায় কথিত জনপ্রশাসন এখনও অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণ ও আকর্ষণীয় হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি কোনও সমৃদ্ধশালী দেশের লক্ষণ হতে পারে না। যদিও বর্তমানে আমরা সমৃদ্ধশালী নই, তবে আমাদের সম্ভাবনা আছে, এবং আমরা সেই সম্ভাবনাকে জোড় গলায় দাবি করে বেড়াচ্ছি।
তাহলে, এই প্রশাসনিক প্রভাব, প্রতিপত্তি, প্রতিহিংসা, প্রতারণা বা পরশ্রীকাতরতা কতটুকু প্রাসঙ্গিক? এগুলো কি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘প্র’ উপসর্গের আসল অর্থের প্রতিফলন? প্রশ্ন রইলো, প্রকৃষ্ট শাসকদের কাছে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়












সর্বশেষ সংবাদ
পদত্যাগ করলেন টিউলিপ
কুমিল্লার দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’অন্যতম সদস্য মাইনুদ্দিন আটক
দুটি পিস্তল ও ধারালো অস্ত্রসহ দুই সন্ত্রাসী আটক
কুমিল্লায় দুই নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা
কুমিল্লা মেডিকেল ছেড়ে কোথায় গেলো শিশুটি?
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় তিন প্রতিষ্ঠানকে ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে পুলিশে সোপর্দ
প্লাস্টিক জমা দিন গাছের চারা নিন
কুমিল্লায় ‘প্রেমিকের’ সাথে দেখা করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার দুই নারী
কুমিল্লার দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’অন্যতম সদস্য মাইনুদ্দিন আটক
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২