আমি যে বিদ্যালয়ে পড়াশুনা
করে ১৯৬১ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করেছি, তার নাম বরকোটা উচ্চ ইংরেজি
বিদ্যালয় এখন এই বিদ্যালয়টি বরকোটা স্কুল ও কলেজ। কুমিল্লা জেলার
দাউদকান্দি উপজেলার দক্ষিণাংশে অবস্থিত এই বিদ্যালয় থেকে আমার বাবা ১৯৩৬
সালে কলিকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায়
উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। স্কুলটি ১৯৩০ খ্রি: স্থাপিত।
বরকোটা উচ্চ বিদ্যালয়ে
১১ বছর পড়েছি। প্রথম শ্রেণিতে দু’ভাগ ছিল- ছোট ওয়ান ও বড় ওয়ান। প্রাথমিক
বিদ্যালয়টি সরকারি হলেও বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত
হতো। ছাত্রজীবনে এ দু’ভাগের কথা জানতাম না। পরে জেনেছি- প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষক-স্বর্গীয় মনমোহন দাস (প্রধান শিক্ষক), মরহুম নূর
মিঞা, মরহুম আবদুল কাদের ও মরহুম আবদুর রেজ্জাক।
উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান
শিক্ষক স্বর্গীয় ললিত বিহারী সরকার, সহকারী প্রধান শিক্ষক মরহুম আবদুস
সামাদ (পরে প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন), সহকারী শিক্ষক হিসেবে ছিলেন-স্বর্গীয়
উপন্দ্রে চন্দ্র সাহা, আমার বাবা স্বর্গীয় ইন্দুভূষণ ভৌমিক (পরে প্রধান
শিক্ষক হয়েছিলেন), আরবী শিক্ষক মরহুম মৌলভী আবদুর রহমান, সংস্কৃত শিক্ষক
স্বর্গীয় সতীশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, কাব্যতীর্থ, স্বর্গীয় যতীন্দ্রনাথ ধর ও
স্বর্গীয় মেঘনাদ শামমহল। পর বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন মরহুম আবদুর
রশীদ, তিনি উচ্চ শিক্ষা নিতে চলে যাওয়ার পর স্বর্গীয় জগদীশ চন্দ্র দে
যোগদান করেন।
বলে রাখি- ১৯৫৬ সালে কে বা কারা স্কুলটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে
দেয়। ছিল বর্ষাকাল। এখন পর্যন্ত এ ঘটনার রহস্য প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।
স্কুল পুড়ে গেলেও একজন ছাত্রও অন্য কোনো স্কুলে চলে যায়নি। এই উত্তীর্ণ
হলেও কোনো ছাত্রী আর পড়তে আসত না। এটা অবশ্যই অভিভাবকদের সিদ্ধান্ত বা
মেয়েদের শিক্ষা প্রদানে অনীহা। তখন বুঝিনি, এখন মনে হয়েছে, এ সিদ্ধান্ত ছিল
ভ্রান্ত ও অবহেলা। সে সময় স্কুলে যারা পড়াশুনা করত না করতেন, তাদের বয়স
নেহাৎ কম ছিল না। ছয় বছরের আগে কেউ স্কুলে পড়তে আসত না। যারা স্কুল থেকে
ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিতেন, তাদের বয়স প্রধান শিক্ষকই নির্ধারণ করে
দিতেন। তবে বয়স নির্ধারণ হতো ১৮ অথবা তদুর্ধে। কারণ, ১৮ বছর না হলে চাকরি
পাওয়া যেত না। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সমর্থই বা কতজনের ছিল। সেজন্য আমাদের
সময়ে জন্ম তারিখ দুটি। একটি মূল বা আসল, অন্যটি সনদ অনুযায়ী। পরের তারিখটি
দিয়েই জীবনের সবকাজ চলত বা চলেছে। এ নিয়ে কেউ ততটা সচেতন ছিল না।
স্কুল
শিক্ষক ও ছাত্র। স্কুল পরিচালনার জন্য একটি কমিটি ছিল বা আছে। তখনকার সময়ে
প্রধান শিক্ষকই সর্বেসর্বা। তাঁর সিদ্ধান্তের উপর কারও কিছু বলার থাকত না।
কমিটির একজন সম্পাদক থাকতেন, তিনি প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে অনুকূল বা
সমর্থনমূলক আলোচনা করতেন। আমরা অর্থাৎ ছাত্ররা তাঁদেরকে চিনতাম না, জানতাম
না। আগেই বলেছি- প্রধান শিক্ষকই স্কুল পরিচালনায় সর্বেসর্বা। তাঁর
সিদ্ধান্ত শেষ কথা। তিনি শুধু স্কুলের প্রধান শিক্ষক নন, এলাকার প্রধান
শিক্ষক। তাঁর সম্মানের মাত্রাটা কতটুকু উচ্চতাবিশিষ্ট ছিল, তা পরিমাপ করার
যোগ্যতা কারও ছিল না। এ নিয়ে অনেক কাহিনি।
স্কুলে শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকগণ
পড়া দিতেন, পড়া নিতেন বা আদায় করতেন। পড়া ঠিকমত না করলে বা উত্তর দিতে না
পারলে শাস্তির ব্যবস্তা ছিল কঠিন- কঠিনতর-কঠিনতম। শিক্ষকগণ ক্লাসে যাওয়ার
সময় প্রায় সকলেই একটি বেত (বেত্রদণ্ড) নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করতেন। আমাদের
সময়ে প্রতিদিনই শিক্ষকদের দ্বারা লাঞ্ছিত হতে হতো। উল্লেখ্য পড়া আদায়ের
জন্য শাস্তি ছিল বহুমাত্রিক।
শাস্তির প্রকার ভেদ নিম্নরূপ-
১. বেত দিয়ে মারা। তা হাত পেতে বা কোনো কোনো শিক্ষক পিঠ বা পায়েও আঘাত করতেন।
২.
কানমলা। অনেক সময় পড়া জিজ্ঞেস করা হয়েছে, না পারলে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। একে
একে জিজ্ঞাসা করে যে ছাত্র সঠিক উত্তর দিতে পারত, তাকে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা
ছাত্রদেরকে কানমলা দিতে শিক্ষক আদেশ দিতেন।
৩. বেঞ্ছির উপর দাঁড়া করিয়ে রাখা।
৪. নিম্নশ্রেণি ছাত্ররা পড়া না পারলে বাগানে নিয়ে কপালে একটা কিছু দিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা।
৫. ডিটেইন অর্থাৎ স্কুলে ছুটি হলেও পড়া শিখে তারপর বাড়ি যাওয়ার আদেশ দেয়া হতো।
৬. পড়া না পারলে বা অন্যকোনো অন্যায় কাজ করলে কান ধরে উঠা-বসা করানো হতো।
৭. কেউ যদি ধূমপান করত, তার শাস্তি ছিল অমানবিক।
একালে
ছাত্ররা তা ভাবতেও পারবে না। প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বর্গীয়
মনমোহন দাস বেত ব্যবহার করতেন না। তিনি কিল-ঘুষি-কনি অর্থাৎ হাত ব্যবহার
করতেন। চুলের মুঠি ধরে উগ্রমূর্তি ধারণ করে শাস্তি দিতেন। এই স্যারের জন্য
মাথার চুল ছোট রাখতে বাধ্য হতো ছাত্ররা।
প্রধান শিক্ষক স্বর্গীয় লালিত
বিহারী সরকারের টেবিলে দুটি বেত ছিল। কোনোদিন ব্যবহার হতে দেখিনি, শুনিনি।
তবে এমনভাবে বকনি দিতেন, মনে হতো বেত দিয়ে মারলেই ভালো হতো।
স্কুলের
দপ্তরী ছিলেন মহরম আলীদা (ভাই বলতাম না)। তিনি আমাদের শিক্ষক না হয়েও
অভিভাবক ছিলেন, াামরা তাঁকে সম্মান করতাম, আমাদের ভুল ত্রুটিগুলো শুধরিয়ে
দিতেন।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। ফার্স্টবয় মনিরুল হক ভূঁইয়া। শিক্ষকের নাম
উল্লেখ করলাম না। তিনি আমাদের পড়া নিচ্ছেন। যারা উত্তর দিতে পারছে না, তারা
দাঁড়িয়ে আছে। মনিরুল হক উত্তর সঠিক দেয়ার পর স্যার নির্দেশ দিলেন দাঁড়িয়ে
থাকা ছাত্রদের কানমলে দিতে। মনিরুল হক দাঁড়িয়ে আছে, নির্দেশ মানছে না।
স্যার তাকে ধমক দিয়ে কাজটি করতে বললেন। মনিরুল হক মাথা নীচু করে বলল- সে এ
কাজটি করতে পারবে না। তারা সহপাঠী ও বন্ধু। স্যার রেগে গেলেন এবং মনিরুল
হককে বেত দিয়ে মারতে যাবেন, হঠাৎ থেমে গেলেন। আমরা ভয়ে প্রায় আড়ষ্ট। একথাটি
সম্ভবত মহরম আলীদার মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক জানতে পেরেছেন। তারপর থেকে এরূপ
শাস্তিবিধান বন্ধ হয়ে গেল। মনিরুল হক এ ঘটনার পর দু’দিন স্কুলে আসেনি,
স্যার তার বাড়িতে গিয়েছিলেন-শুনেছি।
একদিন প্রধান শিক্ষক দেখলেন ৪/৫জন
ছাত্র বাগানে দাঁড়িয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি মহরম আলীদাকে বিষয়টি
কী জানতে পাঠালেন। মহরম আলী দা এসে শাস্তির অভিনব বিষয়টি প্রতিবাদী ভাষায়
ব্যক্ত করলেন। তাও বন্ধ হয়ে গেলো।
সহকারী প্রধান শিক্ষক জনাব আবদুস
সামাদ বি,টি ডিগ্রি নিয়ে পুনরায় স্কুলে যোগদান করলেন। তিনি প্রধান শিক্ষককে
জানালেণ যে ট্রেনিং-এ স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কোনো অবস্থায় ক্লাশে
ছাত্রদের প্রতি বীতি প্রদর্শন করা হবে না। ক্লাশে বেত নে য়া যাবে না,
শারীরিক কোনো শাস্তি দেয়া যাবে না। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল
শিক্ষক মহলে। শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে পড়া আদায় করা যাবে না ইত্যাদি।
প্রধান শিক্ষক বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করলেন এবং বেত্রদণ্ড বিষয়টি
সহনশীল পর্যায় নিয় এলেন শিক্ষক পরিষদে দীর্ঘ আলোচনার পর॥ এভাবে ধারাবাহিক
আমাদের স্কুলগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম চলে এসেছে। তবে যুগের বিবর্তনে
লেখাপড়ার মান-পাঠদানের পদ্ধতি-পড়া আদায়ের কৌশল-শিক্ষক-ছাত্রদের সম্পর্ক
ইত্যাদি বিষয়গুলো অবশ্যই যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে। যে বিষয়টি উল্লেখ
করতে হয়- ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটি এখন অনেকটাই ম্রিয়মান এবং ধারাবাহিকতায়
দুর্বল হয়ে গেছে। শিক্ষকও আর নিজের অবস্থানে নেই, ছঅত্ররাও তেমনভাবে
শিক্ষখদের প্রতি শ্রদ্ধা ধরে রাখতে পারছে না।
পেশা ও চাকরি সমার্থ হলেও
মৌলিক পার্থক্য আছে। শিক্ষকতা একটি সম্মানীয় পেশা, চাকরি হিসেবে বিবেচনা
করলে অথবা আচরণ করলে শাশ^ত গৌরবটা আর থাকে না। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা
যায়। রাষ্ট্রিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের যে মৌলিক স্বরূপ বা
বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তা যদি যথাযথ মর্যাদা না দেয়া হয়- তখন প্রতিটি ক্ষেত্রই
বিতর্কিত হয়ে যায়।
শিক্ষক হিসেবে ভাবছি। ভাবনটা ছিল মরার আগে মরতে চাই
না, এখন আগেই মরতে চাই। কেন ? আমাদের কালে অথবা তারও আগে আমাদের দেশে
শিক্ষা প্রদানে তেমন শৃঙ্খলা ছিল না, ছিল মান্যতা ও পরম্পরা। মূলত
ব্রিটিশরা আসার পর শিক্ষা প্রদান ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ
নিতে থাকে। সেখানে শিক্ষা প্রদানই ছিল মুখ্য বিষয়। পরম্পরা বিষয়টি ছিল
সম্মানিক এবং স্লোগান ছিল- ‘শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদণ্ড।’ এই মেরুদণ্ড
রক্ষাকর্তা শিক্ষক। তার প্রাপ্তি হলো সম্মান-শ্রদ্ধা। তিনি গুরুকুলের
শিরোমনি। তাঁকে সামাজিক-রাষ্ট্রিকভাবে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে বসানো
হয়েছে। রাজা সিংহাসনে বসে আছেন, তাঁর শিক্ষক রাজসভায় প্রবেশ করলে রাজা
সিংহাসন থেকে নেমে এসে প্রণাম করবেন। উপযুক্ত সম্মানিক স্থানে আসনের
ব্যবস্থা করতেন। তাতে রাজার গৌরভ বেড়েছে, শিক্ষক সম্মানিত হয়েছে, এটাই
পরম্পরা।
এত কথা কেন ? জানি না। জানার প্রয়োজনবোধ করিনি। দু:খ এই, এখন
কি দেখছি জীবিত অবস্থায় দেখে গেলাম ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষককে আর সেআসনে বা
অবস্থানে রাখছে না। হাতে ধরে- ঘাড়ে ধরে-টেনে চেয়ার থেকে নামিয়ে উল্লাস
করছে, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বাহবা নিচ্ছে। অভিভাবকসহ নষ্টরা উল্লাস করছে।
এইজন্য কি বেঁচে আছি তা দেখার জন্য ?
বলতে দ্বিধা নেই। বনের পশু শিক্ষিত
হবে, লোকালয়ের মানুষ পশু হবে- সময় সমাগত। মানুষ নামটিই থাকবে, মনুষ্যত্ব
বলে কিছুই থাকছে না, থাকবে না। অভিশপ্ত হবে মানুষ জাতি। এটাই নৈরাজ্য।