বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫
২ মাঘ ১৪৩১
গোয়েটের ফাউস্ট
জুলফিকার নিউটন
প্রকাশ: বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫, ১:১৬ এএম আপডেট: ১৫.০১.২০২৫ ২:২২ এএম |

 গোয়েটের ফাউস্ট
আমার জীবন এবং চিন্তার পোষণে এবং বিবর্তনে আজ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে যে সব ভাবুক এবং বিশ্বসাহিত্যিক অকুণ্ঠভাবে সহায়তা করে আসছেন মানবতন্ত্রী যোহান ভলফগাঙ্গ গোয়েটে (২৮ আগস্ট ১৭৪৯ - ২২ মার্চ ১৮৩২) তাদের ভিতরে প্রায় প্রধানতম। প্রায় লেখার কারণ, অন্তত আরও কয়েকজনের কাছেও আমার মানসিক ঋণ অপরিুশাধ্যে।
গোয়েটেকে আমি আবিষ্কার করি যখন আমার বয়স পনেরো কি যোলো। আমার বিশেষ প্রিয় একজন সহপাঠিনীর পিতা ভাইমার রিপবলিকে গিয়েছিলেন রসায়ণ শাস্ত্রে ডক্টরেট অর্জনের উদ্দেশ্যে ডক্টরেট মিলল, কিন্তু অকালমৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন মহাকবির ঈড়ষষবপঃবফ ড়িৎশং ড়ভ এড়বঃযব-এর সংকলন, সুটগার্ট থেকে ১৮৬৫ সালে পুরোনা গথিক অক্ষরে ছাপা ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর আমি ফরাসি এবং জার্মান দুটি ভাষাতেই অল্পস্বল্প পাঠ নিতে শুরু করেছিলাম। আমার সহপাঠিনী আমাকে সেই দুর্লভ কাব্যগ্রন্থ, দুখণ্ড জার্মান-ইংরেজি অভিধান এবং একটি জার্মান ব্যাকরণ তার পিতার সংগ্রহশালা থেকে উপহার দেন। আমার গ্রন্থসংগ্রহে এই উপহার কটি আজও সযত্নে সংরক্ষিত। অভিভাবকদের অনুমতি নিয়েছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু তার সেই প্রীতি-উপহার গ্রহণে আমার কিছুমাত্র সংকোচ হয় নি।
আর তার পরেই অভিধান এবং শিক্ষিকার সহায়তায় আমার প্রবেশ ঘটল আকাশের মত বিরাট, গ্রোতস্বিনীর মত বহমান, কল্পনার বৈচিত্র্য অফুরন্ত সেই কবিতার ভুমণ্ডলে। মনে পড়ে প্রথম পাঠেই কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের কবিতা আমাকে এতটা আলোড়িত করে যে দুর দুর বুকে তাদের অনুবাদের অক্ষম চেষ্টা করি। তাদের কাব্যগ্রন্থের একটি হচ্ছে “ঞযব ঝড়ৎপবৎৎবং অঢ়ঢ়ৎবহঃরপব, ডবষপড়সব ধহফ ঋধরৎবিষষ, ডধহফবৎং হরমযঃংড়হম, চৎড়সবঃযবঁং, জড়সধহ ঊষবমু, ঐবৎসধহ ্ উড়ৎড়ঃযবধ, ডরহঃবৎ ঔড়ঁৎহু রহ ঃযব ঐধৎু.  এখনও গোয়েটের গড়যধসসধফ ংড়হমং  পড়বার সময়ে আমার কখনো কখনো রবীন্দ্রনাথের “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’-এর কথা স্মরণে আসে। উল্লসিত নির্ঝর পাথরের ভিতর দিয়ে নক্ষত্রালোকের মত বহমান, নানা রং-এর নুড়ির পিছু ছুটতে ছুটতে এসে পড়েছে উপত্যকায়, রৌপ্যকরাজ্জ্বেল তার স্রোতে সাড়া দিয়ে পাহাড়প্রান্তরের স্রোতস্বিনীরা তাকে আকুল আহ্বান করছে, বলছে, আমাদেরও বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাও তোমার গন্তব্য সেই দিগন্তবিহীন মহাসমুদ্রে। এটি যৌবনের রচনা, গোয়েটের বয়স তখন সম্ভবত চব্বিশ, বহমান উল্লাস আমাকেও ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এখন অবশ্য জানি রবীন্দ্রনাথ এবং গোয়েটের কবিতা দুটির ভিতরে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য আছে। রবীন্দ্রনাথ মহম্মদকে নিয়ে কখনোই এমন কবিতা লিখতে পারতেন না-ইসলামের প্রবর্তকপুরুষকে মহাসমুদ্র অভিসারী নিঝর রূপে কল্পনা করবার মানসিক প্রস্তুতি তিনি তখন পাবেন কোথা থেকে? রবীন্দ্রপূর্ব বাংলা সাহিত্যে কোথায় সেই মুক্তবুদ্ধি ভলতেয়ার, মহম্মদ ঐতিহাসিক অর্থপূর্ণতা যাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভব, এবং যে ভলতেয়ার-এর ‘মোহাম্মদ’-এর জার্মান ভাষায় অনুবাদ করবেন স্বয়ং গোয়েটে অনেক দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথের নিঝর কারাগারে বন্দীত্বের। যন্ত্রণায় ভুগছে-মুক্তি তার কামনা। আর গোয়েটের নির্ঝর যেন তাজা তরুণ (ঔঁহমষরহমভৎরংপয), মেঘের দেশ থেকে নাচতে নাচতে বেরিয়ে এসেছে। 
গোয়েটের জন্ম ১৭৪৯ সালে। জার্মানির সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবন তখনও গাঢ় তমসাচ্ছন্ন। তাঁর বয়ঃপ্রাপ্তির যুগে জার্মানির সাংস্কৃতিক জীবনে ইউরোপীয় রেনেসাঁস আন্দোলনের কিছু কিছু প্রভাব পরিস্ফুট হয়ে উঠতে থাকে। কান্টের যুক্তিবাদী দর্শন, হিঙ্কেল্মানের শিল্পতত্ত্ব, লেসিঙ্-এর সাহিত্যবিচার এবং হের্ডার-এর ইতিহাসতত্ত্বের মারফত প্রাচীন গ্রিস এবং আধুনিক ইংলন্ড, ফ্রান্স ও ইটালি জার্মান মানসে প্রবেশ লাভ করে। রিফর্মেশন জার্মানিকে রেনেসাঁসের মহৎ উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। এঁদের প্রয়াসে আঠারো শতকে জার্মানিতে সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এঁদের কর্ষিত জমিতে ফসল ফলালেন গোয়েটে। তিরাশি বছরব্যাপী দীর্ঘজীবনের প্রচেষ্টায় জার্মানিকে তিনি রেনেসাঁসের উত্তরসাধকদের মধ্যে প্রধান করে তুললেন। তাঁর পূর্বে জার্মানিতে সাহিত্য বলতে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না; যেমন দরিদ্র ছিল জার্মান ভাষা তেমনি অপুষ্ট ছিল জার্মান মানস। গোয়েটে জার্মান সাহিত্যকে প্রাদেশিকতার স্তর থেকে বিশ্বসাহিত্যের স্তরে পৌঁছে দিলেন; দেখা গেল প্রকাশক্ষমতায় জার্মান ভাষা অন্যান্য প্রধান ইউরোপীয় ভাষার চাইতে খুব খাটো নয়। তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে জার্মান মন ইউরোপীয় সংস্কৃতির উত্তরাধিকারে সমৃদ্ধ এবং পরিপুষ্ট হয়ে উঠল। রেনেসাঁসের মানবতন্ত্রী ঐতিহ্য যখন ইয়োরোপের অন্যান্য দেশে ক্ষীণ হয়ে আসছিল গোয়েটে তাতে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করলেন। শুধু জার্মানিরই উজ্জীবন ঘটালেন না, নিয়ে এলেন ইয়োরোপের পূনরুজ্জীবনের প্রতিশ্রুতি।
পশ্চিমী রেনেসাঁসের ইতিহাস যাঁরা পাঠ করেছেন, তাঁরা জানেন রেনেসাঁসি দৃষ্টিভঙ্গিতে যুক্তিবাদ এবং ব্যক্তির স্বতঃসিদ্ধ মূল্য বিষয়ে বোধ অচ্ছেদ্য সম্বন্ধে জড়িত। ব্যক্তিমাত্রই অনন্য; প্রতি ব্যক্তির মধ্যে যে মুক্তিস্পৃহা বর্তমান, তার স্ফুরণ ছাড়া সমাজের অগ্রগতি অসম্ভব, ব্যক্তির বিকাশ সর্ববিধ কল্যাণের মূল উৎস। গোয়েটের প্রথম বয়সের খণ্ড রচনা “মোহাম্মদের গান” এবং “প্রমিথিয়ুস” থেকে শুরু করে শেষ বয়সের রচনা “ফাউস্টের” দ্বিতীয় খণ্ড পর্যন্ত সর্বত্রই ব্যক্তিসত্তার মুক্তিতৃষ্ণা প্রবল প্রাচুর্যের প্রকাশ পেয়েছে। অন্যদিকে ডরষযবষস গবরংঃবৎং অঢ়ঢ়ৎবহঃরপবংযরঢ় -এর মহাকাহিনীতে গোয়েটে সন্দেহাতীতভাবে দেখিয়েছেন, প্রতি মানুষই বিচিত্র সম্ভাবনার আকর এবং চরিত্র মাত্রই, প্রধান হোক বা অপ্রধান হোক, আপন প্রাতিস্বিকতায় অনন্য। “একরমানের সঙ্গে আলাপে” তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, “আমি চিরদিন প্রত্যেক মানুষকে একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে জ্ঞান করেছি, বুঝতে চেয়েছি কোথায় তার স্বকীয়তা, সামান্যের মধ্যে তাকে মিশিয়ে দিতে চাইনি।” অন্যত্র লিখেছেন, “এই জগৎ এমন আশ্চর্যভাবে তৈরি যে প্রত্যেকটি মানুষ তার আপন স্থান-কালে অন্যসব মানুষের চাইতে বড়।” কান্টের মতো গোয়েটেও জানতেন, প্রতি মানুষ নিজেই একটি চরম উদ্দেশ্য-তাকে অন্য কোনও উদ্দেশ্যের উপায় হিসেবে ভাবলে তার চাইতে মারাত্মক ভুল আর কিছু হতে পারে না। গোয়েটে তাই ঈশ্বর, জাতি, সমাজ, রাষ্ট্র, সব কিছুর উপরে প্রধান করে ধরেছেন মানুষকে, ব্যক্তি-মানুষকে, যে ব্যক্তি-মানুষ সমাপ্তিহীন বিকাশের অভীপ্সায় নিত্য সক্রিয়। “হিল হেল্থ্ মাইস্টারের ভ্রমণকাহিনীতে” গোয়েটে যাকে “দার্শনিকের ধর্ম” বলেছেন, তার মূল কথা হল সব মানুষকে আপন মূল্যে মূল্যবান বলে ভাবতে শেখা। এই দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তিতেই গোয়েটে পেরেছিলেন কান্টের সঙ্গে দিদরোকে মেলাতে, পেরেছিলেন একই সঙ্গে লিখতে “ ডরষযবষস গবরংঃবৎং অঢ়ঢ়ৎবহঃরপবংযরঢ় এবং ঐবৎসধহ ্ উড়ৎড়ঃযবধ কাব্য-কাহিনী।
গোয়েটে অবশ্যই জার্মানিকে ভালবাসতেন, কিন্তু দান্তের মতো তাঁরও দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সমস্ত পৃথিবীই তাঁর স্বদেশ। জার্মানির চিৎ-প্রকর্ষের জন্য ইংরেজ, ফরাসি, ইটালীয়, গ্রিক কারও কাছ থেকে সম্পদ সংগ্রহ করায় তাঁর সংকোচ হয়নি। “একরমানের সঙ্গে আলাপ”-এ তিনি বলেছেন, “কবির মন কোনো ভৌগোলিক সীমার মধ্যে বাঁধা থাকতে পারে না; যেখানে তার কাব্যের উপাদান মিলবে, সেখানেই তার দেশ। ঈগল পাখির মত আকাশ থেকে সে পৃথিবীকে দেখেছে- শিকার পাওয়া নিয়ে তার ভাবনা, সে শিকার প্রশিয়ায় মিলল না সাক্সনিতে তাতে কি আসে যায়।
গোয়েটে কান্টের কাছ থেকে শিখেছিলেন মানুষ নিজেই নিজের উদ্দেশ্য, তার মূল্য স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু কান্ট যখন নিয়মানুগত্যের উপরে অতিরিক্ত জোর দিয়ে রেনেসাঁসি সম্ভোগতত্ত্বের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান নিগ্রহতত্ত্বকে সমর্থন করলেন, তখন গোয়েটে তাঁর গুরুর নির্দেশ অস্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেননি। জীবনের সার্থকতা বিকাশে এবং সম্ভোগ ছাড়া বিকাশ অসম্ভব-এ প্রত্যয় গোয়েটের জীবনশিল্পের একটি প্রধান সূত্র, তাঁর সমস্ত রচনার একটি মূল সুর। তাঁর তরুণ বয়সের অসমাপ্ত রচনা ‘প্রমিথিয়ুস'-এ এ প্রত্যয়কে তিনি আশ্চর্য কাব্যরূপে ঘোষিত করেছিলেন; তারপর তাঁর বিরাট আত্মজীবনীতে (যার নাম দিয়েছিলেন ডবংঃ ঊধংঃবৎহ উরাবহ, এবভঁহফবহ তাঁর “ জড়সধহ ঊষমু, ঞযব ঝড়ৎৎড়ংি ড়ভ ণড়ঁহম বিৎঃযবৎ, ডরষযবষস গবরংঃবৎং অঢ়ঢ়ৎবহঃরপবংযরঢ় -এর দুখণ্ডে, “হিঙ্কেল্মানের জীবনী”-তে, “ফাউস্ট” নাটকে, ডবংঃ ঊধংঃবৎহ উরাবহ, এবভঁহফবহ -এর কাব্যগ্রন্থে, “একরমানের সঙ্গে আলাপে”, বার বার তিনি নানাভাবে এ সত্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমার বিশ্বাস তিনি যে চেলিনি এবং দিদরোর লেখা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন তার কারণ বিশেষ করে এই প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে এঁরা ছিলেন তাঁর নিকট-আত্মীয় এবং এ প্রত্যয় যে বৃদ্ধকালেও তাঁকে ত্যাগ করেনি তার প্রমাণ চুয়াত্তর বছর বয়সে উলরিকার প্রেমে পড়ার পরে লেখা “মারীনবাড়-গাথা।”
ফরাসি বিপ্লবের পূর্ববর্তী প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল ধরে সে দেশে যে নবীন ভাবান্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে, গোয়েটের প্রথম যুগের বিভিন্ন রচনার উপরে তার প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। ভামির যুদ্ধে (১৭৯২) জার্মানরা যখন ফরাসিদের কাছে হেরে যায়, তখন গোয়েটে তাঁর স্বদেশবাসীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “জগতের ইতিহাসে আজ এক নতুন যুগ শুরু হল।” কিন্তু গোয়েটের যুক্তিবাদী মন ফরাসি বিপ্লবকে স্বাগত করেও তার মূল ত্রুটিকে লক্ষ্য করতে ভোলেনি। বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে যে বিপ্লব ঘটে, তা যে মানুষের স্থায়ী কল্যাণসাধনে অপারগ, প্রথম থেকেই সে কথা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। সে বিপ্লবের প্রথম ফল বিশৃঙ্খলা এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত আসে জবরদস্তি। গোয়েটে জানতেন জ্ঞান এবং সহযোগিতার মধ্য দিয়েই মানুষের যথার্থ বিকাশ সম্ভবপর হয়। আবেগের আতিশয্যে মানুষ বড় জোর ভাঙতে পারে, কিন্তু গড়ার জন্য চাই জ্ঞান, ধৈর্য, নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ। যে কারণে তিনি একদা রোমান্টিক আতিশয্যকে পরিহার করে ক্লাসিক সংযমের সঙ্গে রোমান্টিক অভীপ্সার সমন্বয়ের মধ্যে মানুষের বিকাশ সাধনার সূত্র নির্দেশ করেছিলেন, সেই কারণেই ফরাসি বিপ্লবের ঐতিহাসিক মূল্য স্বীকার করে নিয়েও তিনি তার মূঢ় বিক্ষোভকে সমর্থন করতে পারেননি। তাঁর সমকালীন বিপ্লববাদীদের অনেকে এজন্য তাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল, এমনকী বিশ্বাসঘাতক বলে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু তাঁর সে সমালোচনার মধ্যে যে কতখানি দূরদর্শিতা ছিল, পরবর্তীকালে ফরাসি দেশের ইতিহাস তা বারবার প্রমাণ করেছে।
গোয়েটের ফাউস্ট প্রতি মুহূর্তে নিজের সঙ্গে নিজে সংগ্রাম করছে। লালসা এবং মমতা, সত্যানুসন্ধান এবং সম্ভোগাসক্তি, আত্মপ্রত্যয় এবং আতঙ্ক তার চরিত্রে নিয়ত যুধ্যমান। আত্মবিরোধের হাত থেকে সে পালাতে চায়নি, তার মধ্য দিয়ে সে মুক্তির সাধনা করেছে। ফাউস্ট এবং মেফিস্টোর সম্পর্ক তাই শাদার সঙ্গে কালোর সম্পর্ক নয়; তারা একই সঙ্গে পরস্পরের বিরোধী এবং পরস্পরের আত্মীয়। মেফিস্টো যদি ফাউস্টের অস্তিত্বের মূলে না বাসা বাঁধত, তবে ফাউস্টের পক্ষে মুক্তির জন্যে সাধনা করাই সম্ভব হত না।
পাঁচিল কি গোয়েটেরই ছিল না! তবে সে পাঁচিল তিনি টপকাতে পেরেছিলেন। ভাবের পাঁচিল, নীতির পাঁচিল, ভাষার পাঁচিল। প্রেম তাঁকে সাহায্য করেছিল। প্রথম বয়সে কাটারিনা এবং ফ্রিডেরিকা থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত সমাজের প্রবল প্রতিরোধ সত্ত্বেও যাকে তিনি বিয়ে করলেন সেই ক্রিস্টিয়ানা-বহুবল্লভ গোয়েটের জীবনে এবং সাহিত্যে যে মেয়েরা অক্ষয় স্বাক্ষর রেখে গেছে তাদের অনেকেই সমাজের নীচের তলার মানুষ। তিনি নিজেই লিখেছেন, কাটারিনার প্রেমে পড়ে তিনি প্রথম বুঝতে শেখেন ধর্ম, নীতি, লোকাচারের ভিত্তি কত অগভীর, আবিষ্কার করেন সমাজ কাঠামোর অন্তরালে জীবনের যত ভয়াবহ অন্ধকার সুড়ঙ্গ। রবীন্দ্রনাথ তত্ত্বের ক্ষেত্রে মানব-প্রেমী হয়েও জীবনের ক্ষেত্রে বন্দী রইলেন আভিজাত্যের দুর্গে। কামনা গোয়েটেকে সে দুর্গ থেকে টেনে বার করেছিল।” তাঁর যৌবনের উচ্ছৃঙ্খল দিনগুলি ব্যর্থ হয়ে যায়নি। একদিকে যেমন গ্রিক ল্যাটিন পড়েছেন, অন্যদিকে তেমনি দিনের পর দিন রাতের পর রাত কাটিয়েছেন শুঁড়িখানায়, বস্তিতে, বেশ্যালয়ে, সমান আনন্দে মিশেছেন ধার্মিক লাফাটর আর মাতাল প্রকৃতিবাদী বাজেডভ্-এর সঙ্গে, বন্ধুত্ব পাতিয়েছেন নেতিপন্থী মার্ক আর যুক্তিভীর যাকোবির সঙ্গে, গরিব গেঁয়ো পুরতের মেয়ে ফ্রিডেরিকার সঙ্গে প্রেমলীলা ফুরোতে না ফুরোতেই বন্ধুর বাগদত্তা শার্লোট বুফ-এর সঙ্গে জট পাকিয়েছেন। ঝড়ঝাপটা যুগের আবহাওয়াও হয়তো তাঁকে সাহায্য করেছিল। তবে আমার বিশ্বাস এই পাঁচিল টপকানোর ব্যাপারে তিনি সব চাইতে নির্ভরযোগ্য সমর্থন পেয়েছিলেন তাঁর আপন প্রকৃতির মধ্যে। তাঁর যৌবন কালের বন্ধু মার্ক তাঁকে লিখেছিলেন, কাল্পনিক সৌন্দর্যের সাধনা তোমার ধর্ম নয়, বাস্তবকে উদ্ঘাটিত করার মধ্যেই তোমার সার্থকতা। গায়েটে সম্বন্ধে এর চাইতে সত্য কথা আর কেউ বলেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই।
ফলত গোয়েটে সাধনা করেছিলেন মুক্ত মন দিয়ে অস্তিত্বের সমগ্র রূপকে বুঝতে, আর সেই বোঝাকে প্রকাশ করতে বিজ্ঞানে, সাহিত্যে, নিজের জীবনে। “আমি হতে চাই প্রকৃতির মতো কৃত্রিমতামুক্ত, ভালোয় মন্দয় মেশানো, সব সামাজিক ঔচিত্য বন্ধনের ঊর্ধ্বে।” এ তাঁর প্রথম যৌবনের ঘোষণা। বৃদ্ধ বয়সে একরমানের সঙ্গে আলাপেও বার বার তিনি সেই একই প্রত্যয়ের উল্লেখ করেছেন। “শিল্পীকে বিমূর্ত সামান্য ভাবের মোহ এড়িয়ে দেহাশ্রিত বিশেষের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে।” “যার জীবনে মতবাদ যত প্রবল, সে তত খারাপ লেখে; বাস্তবজীবনে অভিনিবিষ্ট হতে পারলে তবেই খাঁটি লেখক হওয়া সম্ভব।” “শ্লীলতাবোধ সাহিত্য সৃষ্টির অন্তরায়-শিশুদের জন্য বিদ্যালয়, পরিণত বয়স্কদের জন্য রঙ্গমঞ্চ।” “আমার কাব্যে কখনও কোনও তত্ত্বকথাকে রূপ দেবার চেষ্টা করিনি।” “সত্যের চাইতে কোনও কিছুই বড় নয়।” “প্রতিভার কাছে আমাদের প্রথম এবং শেষ দাবি সত্যানুগত্য।” হুগোর লেখা তাই তাঁর মনে বিতৃষ্ণার সঞ্চার করেছিল। এই মানদণ্ডে বিচার করেই তিনি গোল্ডস্মিথ এবং দিদরোকে লেখক হিসেবে উঁচুতে আসন দিয়েছেন।
গোয়েটের এ সব উক্তি যে কথার কথা নয় তাঁর দীর্ঘজীবনের রচনাবলী তারই প্রমাণ। বিশদ আলোচনার এখানে অবকাশ নেই; একটি-দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যে প্রাচীন কাহিনী থেকে গোয়েটে তাঁর “ফাউস্ট” নাটকের গল্পটি সংগ্রহ করেন তার নায়িকা ছিল গ্রিক মহাকাব্যের বিখ্যাত রূপসী হেলেন। ১৫৮৭ সালে প্রকাশিত স্পিজ-এর “ফাউস্ট-বুখ”-এ আছে ফাউস্টুস জাদুবিদ্যার জোরে হেলেনকে প্রেতলোক থেকে টেনে আনে এবং তার প্রেমে পড়ে। ফাউস্ট সংক্রান্ত অন্যান্য প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় গল্পে ও হেলেনের সঙ্গে তার প্রেমের উল্লেখ আছে। গোয়েটে যখন প্রথম “ফাউস্ট” নাটক লিখতে শুরু করেন তখন তিনিও হেলেনকেই নায়িকা করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর অস্তিত্বতন্ত্রী শিল্পী-প্রকৃতিই জয়ী হল। হেলেন রূপান্তরিত হল গ্রেখেনে-যে গ্রেটখেনে দেবতার অংশ কিছুই নেই-যে বেশ্যার মেয়ে, গরিব, অশিক্ষিত, নির্বোধ। পারিসের প্রেমিকাকে গোয়েটে দেখেননি; কিন্তু গ্রেটখেনে শোয়েনকফ তাঁকে হাত ধরে শিখিয়েছিল কামনার মধ্যে উদ্দাম আনন্দ আর অসহ্য যন্ত্রণা কী ভাবে মেশানো থাকে; অন্যদিক নিষ্পাপ ফ্রিডেরিকাকে ভালবেসে ত্যাগ করার গ্লানি তিনি কোনওদিন ভুলতে পারেননি। তাঁর কল্পনা বড় জোর পৌরাণিক হেলেনের উপরেই কিছু কারিগরি করতে পারত; তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা জন্ম দিল মার্গারেটাকে। মার্গারেটা তাই অমর হল, অন্য কেউ দূরে থাক স্বয়ং গোয়েটেও এমন আর একটি চরিত্র সৃষ্টি করতে পারেননি। পরবর্তীকালে “ফাউস্ট” দ্বিতীয় খণ্ডে গোয়েটে অবশ্য হেলেনকে নিজের অধিকারে নাটকে স্থান দিয়েছেন; দ্বিতীয় খণ্ডের পুরো তৃতীয় অঙ্কটি হেলেনকে নিয়ে লেখা। এখানে কাব্যগুণের অভাব নেই, যেমন নেই রবীন্দ্রনাথের পরিণত কাব্যরচনায়। কিন্তু প্রথমত, হেলেনের সঙ্গে নাটকের কোনও যোগ নেই (তৃতীয় অঙ্কটি প্রথমে স্বতন্ত্র একটি রচনা হিসেবেই প্রকাশিত হয়েছিল); অ্যারিস্টটলের ভাষায় এটি এপিসোড মাত্র। দ্বিতীয়ত, চরিত্র হিসেবে হেলেন একেবারেই অবাস্তব, মার্গারেটার সঙ্গে তার কোনও তুলনা হয় না। গোয়েটে এখানে নিজের প্রকৃতিকে খর্ব করে নিজের এবং আমাদের লোকসান ঘটিয়েছেন। “ফাউস্ট” দ্বিতীয় খণ্ড তাই প্রথম খণ্ডের মতো অমরত্ব অর্জন করতে পারল না।
নাটকের ক্ষেত্রে যেমন, উপন্যাস এবং গল্পের ক্ষেত্রেও তেমনি এই সুগভীর জীবনস্বীকৃতি গোয়েটের বৈশিষ্ট্য। “ভের্টরের দুঃখ” কাঁচা হাতের লেখা; কিন্তু সেই ঝড়ঝাপটার যুগেও গোয়েটে ভাববাদের মোহে কখনও ভোলেননি তাঁর নায়ক-নায়িকা মানুষ, সে কারণে জটিল, দ্বিধাবিভক্ত; কোনও ভাবরূপের দেহায়ন নয়। তাঁর সব চাইতে দুঃসাহসী এবং পরিণত উপন্যাস ঊষবপঃরাব অভভবরঃরহু -এ এই চেতনা বিচিত্র ফসলে সার্থকতা লাভ করেছে। এ বই পড়ে বায়রন গোয়েটেকে বলেছিলেন “বুড়ো শেয়াল।'
শুধু ডরষযবষস গবরংঃবৎং অঢ়ঢ়ৎবহঃরপবংযরঢ় শিক্ষানবিশি উপন্যাসে গোয়েটে যত বিচিত্র স্তরের এবং প্রকৃতির চরিত্র সৃষ্টি করেছেন-মারিয়ানা, “শুধু ডরষযবষস গবরংঃবৎং অঢ়ঢ়ৎবহঃরপবংযরঢ় শিক্ষানবিশী’ মেলিনা, ফিলিনা, লেয়র্টেস্, মিন্, হার্প-বাজিয়ে বুড়ো, আউরেুডলয়া, জার্নো, ফেলিক্স, লোটারিও, লিডিয়া, টেরেসা, বারবারা, হার্নর, নাটালিয়া, ফ্রিডেরিক -রবীন্দ্রনাথের সমস্ত উপন্যাস মিলিয়েও তার তুলনা হয় না। শুধু তাই নয়, তারা প্রত্যেকেই বিশিষ্ট, জটিল, জীবন্ত, পরিবর্তনশীল।
অপরপক্ষে অস্তিত্বের মূলে যে সংঘাত, ভালমন্দের যে দুঃসমাধেয় সমস্যা, গোয়েটে তাকে আদর্শ বা নীতির নামে সরল বা সহনীয় করার চেষ্টা করেননি। মেফিস্টোর সঙ্গে চুক্তি হবার পর ফাউস্ট বলেছিল, মানুষের ভাগ্যে যত যন্ত্রণা আছে আমার অস্তিত্ব দিয়ে তার সব আমি জানব, আমার আত্মা দিয়ে ছোঁব তাদের উচ্চতম চূড়া আর নিম্নতম গহ্বর, আমার বুকে টেনে নেব তাদের সব আনন্দ বেদনা, আমার সত্তা সব ছাড়িয়ে যাবে তাদের সকলের সত্তায়।
ঘড়ঃ ুবঃ যধাব ও সু ষরনবৎঃু সধফব মড়ড়ফ 
ওভ ও পড়ঁষফ নধহরংয গধমরপ’ং ভবষষ পৎবধঃরড়হং
অহফ ঃড়ঃধষষু ঁহষবধৎহ ঃযব রহপধহঃধঃরড়হ
ঝঃড়ড়ফ ও, ঙ ঘধঃঁৎব! গধহ ধষড়হব রহ ঃযবব,
ঞযবহ বিৎব ও রঃ ড়িৎঃয ড়হব’ং যিরষব ধ সধহ ঃড় নব!
এ শুধু ফাউস্ট চরিত্রের মূল কথা নয়, “ফাউস্ট” নাটক এবং গোয়েটের জীবন এবং সাহিত্যসাধনারও মূলকথা। তিনি জানেন যে মেফিস্টোফেলিস ফাউস্টকে বাইরে থেকে প্রলুব্ধ করেনি, ফাউস্টের সমগ্র অস্তিত্ব থেকেই তার উদ্ভব। ভালমন্দর বিরোধ অস্তিত্বের মূলে; সে বিরোধের যন্ত্রণা যে জানে না, অস্তিত্বের উচ্চতম শিখরও তার অনায়ত্ত। এই বোধ থেকে জন্ম নিয়েছে টাসো, ইফিগেনি, হিলমহেলম, ওটিলী, ফাউস্ট, মেফিস্টোফেলিস এবং মার্গারেটা। গোয়েটে এই বোধের জোরে হোমার, দান্তে, লিওনার্দো, শেক্সপিয়রের সমকক্ষ স্রষ্টা।
ভাষার দিক থেকেও গোয়েটের মন শেক্সপিয়রের মতো সংস্কারমুক্ত। ফাউস্ট’নাটকের প্রথম খসড়ার একটি বিখ্যাত চরণে তিনি লিখেছিলেন: “বাক্চাতুরি! পুতুলনাচের সঙ্গেই ওটা মানায়।' (ডধং ঠড়ৎঃৎধম ! উধং রংঃ মঁঃ ভঁৎং চঁঢ়ঢ়বহংঢ়রবষ)। কোমলকান্ত পদাবলীতে তিনি সিদ্ধ ছিলেন; ধীরোদাত্ত ভাষাও তাঁর আয়ত্তে ছিল। কিন্তু তার জন্যে তিনি হাটবাটের ভাষাকে অবহেলা করেননি, ভোলেননি ইতরজনের ভাষার মধ্যেও অসামান্য ব্যঞ্জনার সম্ভাবনা নিহিত থাকে। সব চেয়ে বড় কথা অশ্লীলতার ভয়ে তিনি কখনও ভাষাকে কৃত্রিম বা অস্বচ্ছ করে তোলেননি। ভাষা বিষয়ে গোয়েটের এই মুক্তবুদ্ধির সবচাইতে সার্থক উদাহরণ ‘ফাউস্ট’। এখানে তিনি শ্লীল-অশ্লীল, অভিজাত-ইতর, কোমল-রক্ষ, বিচিত্র স্তর এবং প্রকৃতির ভাষায় যে আশ্চর্য ঐক্যতান সৃষ্টি করেছেন শেকসপিয়রের নাটকের বাইরে তার তুলনা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে আমার অন্তত জানা নেই।













সর্বশেষ সংবাদ
পদত্যাগ করলেন টিউলিপ
কুমিল্লার দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’অন্যতম সদস্য মাইনুদ্দিন আটক
দুটি পিস্তল ও ধারালো অস্ত্রসহ দুই সন্ত্রাসী আটক
কুমিল্লায় দুই নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা
কুমিল্লা মেডিকেল ছেড়ে কোথায় গেলো শিশুটি?
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় তিন প্রতিষ্ঠানকে ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে পুলিশে সোপর্দ
প্লাস্টিক জমা দিন গাছের চারা নিন
কুমিল্লায় ‘প্রেমিকের’ সাথে দেখা করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার দুই নারী
কুমিল্লার দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’অন্যতম সদস্য মাইনুদ্দিন আটক
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২