বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
২৩ মাঘ ১৪৩১
ফের সুদহার বাড়লে বাধাগ্রস্ত হবে ব্যবসা-কর্মসংস্থান
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫, ১২:৫৬ এএম |




উচ্চ মূল্যস্ফীতি ভোগাচ্ছে দীর্ঘদিন। নানান পদক্ষেপের সঙ্গে সুদহার বাড়িয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এরই মধ্যে নীতি সুদহার (রেপো সুদ) আরেক দফা বাড়াতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধ (জানুয়ারি-জুন) সময়ের মুদ্রানীতিতে আসতে পারে এ ঘোষণা।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে না, এতে আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর প্রভাব পড়বে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানে। আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুদহার বাড়িয়ে বিনিয়োগ চাইলে ব্যবসায়ীদের ওপর এর প্রভাব কিছুটা হলেও পড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, রেপো (ট্রেজারি বিল জমা রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার) সুদহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হতে পারে। নীতি সুদহার বাড়লেও সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যাংকারদের ঋণে সুদহার (৪ শতাংশ) অপরিবর্তিতই থাকবে। গত রোববার চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। বৈঠকে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি না কমলে নীতি সুদহার বাড়ানো হবে। এটি হবে বর্তমান গভর্নরের প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা।
রেপোর বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ধার দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়া হয়। আবার ব্যাংক রেটও এক ধরনের নীতি সুদহার। ব্যাংক রেটে ঋণ পান সাধারণত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, জুডিসিয়ারি সার্ভিস, বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। এ কারণে ব্যাংক রেট বাড়লে বা কমলে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীর ঋণের খরচ বাড়ে বা কমে।
২০০৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ব্যাংক রেট ছিল ৫ শতাংশ। ২০২০ সালের জুলাইয়ে এক নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যাংক রেট কমিয়ে ৪ শতাংশে নামানো হয়। ওই বছরের ৩০ জুলাই রেপোর সুদহার কমিয়ে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ আর রিভার্স রেপো সুদহার নির্ধারণ করা হয় ৪ শতাংশ। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে ব্যাংক রেট ১০০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৪ শতাংশে নামানো হয়েছিল।
ব্যবসায় লাভ আরও কমার আশঙ্কা
ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘এখন কারখানায় উৎপাদন বেড়েছে, অন্য খরচের সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদ্যুৎ-গ্যাসের অতিরিক্ত দর। সুদের হারও বাড়তি। ব্যবসা চালানো অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন প্রফিট করতে পারছি না। এর সঙ্গে নতুন করে ফের সুদহার বাড়ানো হলে শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। উৎপাদন খরচ বাড়বে, প্রফিটের দেখা পাবেন না উদ্যোক্তা।’
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন সুদহার বাজারের ওপরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একেক ব্যাংক একেক রকমের সুদ নিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সুদ বাড়ানো হয়, কিন্তু এখন বর্তমান অবস্থা ভিন্ন। সুদহার এখন অনেক বেশি। এখন সুদ বাড়লে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। প্রজেক্ট নেই, ক্রেতারা ঋণ করে আবাস গড়েন। সেখানে সুদহার আরেক দফায় বাড়ানো হলে ব্যবসায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকায় ২০২২ সালের ৩০ মে প্রথমে রেপোর সুদহার বাড়ানো হয়। রেপোর সুদহার ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে টানা ১৩ দফা বাড়িয়ে সবশেষ গত অক্টোবরে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। স্পেশাল রেপোর সুদহার ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং রিভার্স রেপোর সুদহার ৪ শতাংশ থেকে এখন সাড়ে ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ৪ শতাংশ ব্যাংক রেট অপরিবর্তিত আছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের স্বার্থে উদ্যোক্তারা যেন সহজ শর্তে ও স্বল্পসুদে ঋণ পায় তা নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে একটি সংকটময় মুহূর্ত যাচ্ছে। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মূল কারণ সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি খরচ বৃদ্ধি, উচ্চ জ্বালানি ব্যয় ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি। ঋণ প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। উচ্চ সুদহার আমাদের চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়ে দেয়।’
বিকেএমইএর সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘সাধারণত ঋণ নিয়েই ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন। সুদ যখন বাড়ে এতে প্রতিটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাষ্ট্রের নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে বড়রাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন চালের গোডাউনে দেড় মাসে চাল রেখে বিক্রি করতে সময় লাগে, চাতালসহ বিভিন্ন খচর আছে। এক্ষেত্রে সুদহার বাড়লে এভাবে সব ক্ষেত্রে প্রভাব বাড়বে। খরচ দেবে ভোক্তা।’
ফতুল্লা অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম বলেন, ‘সুদহার বাড়িয়ে কী অর্জন করতে চাই এটা বুঝি না। উন্নত বিশ্ব সুদহার না বাড়িয়ে একটা জায়গায় রাখতে চায়। আবার বাড়ালেও এর সাইড ইফেক্ট আছে, সেটা দেশ নিতে পারে না। একটা স্থবির দিকে যায়। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমবে। এখন ব্যাংকে রাখলে যদি ১৫ শতাংশ সুদ পাওয়া যায় তাহলে কি ব্যবসা করবে কেউ, ওটা তো নিরাপদ বিনিয়োগ। ব্যবসা করলে লাভ-লোকসান আছে। আমি তো ব্যাংকে রাখতে চাইবো, ব্যবসা না করে। এতে নতুন কর্মসংস্থান বাড়বে না, ব্যবসা কমবে।
মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে গড় মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আড়াই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। এর মধ্যে শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানো ও মহার্ঘভাতার কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে।
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত দেশে সর্বোচ্চ সুদহার সীমা আরোপ করা হয় ৯ শতাংশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন সুদহার কমাতে শুরু করে, তখন আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর দেশে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে সুদহার নির্ধারণে প্রথমে ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি চালু করা হয়। পরে তা ছেড়ে দেওয়া হয় বাজারের ওপর। সেই সুদহার বেড়ে এখন ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
ব্যবসা কলাপস করলে দায় কে নেবে?
বিজিএমইএর সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, ‘এখন জ্বালানিসহ বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, শ্রমিকের বেতন বাড়ানো হয়েছে, উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ব্যবসা চালিয়ে রাখাই দায়। এর মধ্যে সুদহার বাজারভিত্তিক করার ফলে এখন ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ফের সুদহার বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। এতে ব্যবসা যদি কলাপস করে তাহলে এর দায় কে নেবে।
তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের দিকটা দেখা উচিত। সব কিছু ছেড়ে দিয়ে কতটুকু বাঁচানো যাবে আমি জানি না। একটা রোগীকে আইসিইউ থেকে ছেড়ে দেওয়া মানে মেরে ফেলা, আমাদের অবস্থাটা একই রকম। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব একটা উন্নত হয়নি এখনো। আইএমএফ বলছে সব সাপোর্ট উঠিয়ে নিতে, কিন্তু এটা উঠিয়ে নিলে সরকার হ্যান্ডেল করতে পারবে না। আমরা প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের এটা ভেবে দেখার অনুরোধ জানাবো।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে চলা সমস্যা- উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ ও সীমিত কর্মসংস্থানের চাপ আছে। আগামী দিনে বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জ থাকবে, বিশেষ করে ব্যক্তি খাতে। নীতি সুদহার সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে বাড়ানো হবে। তবে এটারও সীমাবদ্ধাতা আছে। স্থিতিশীলতা ফিরে এলে সেটা কমাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকারি গ্রোথ গত মাসে ১৯, বেসরকারি গ্রোথ ৭ শতাংশের মতো। আগামী মাসেও এমনটা হতে পারে। সুদ বাড়ানো হলে ব্যবসায়ীদের ওপর ইফেক্ট আছে, আবার মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। আমাদের রাজস্বনীতি, কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস নিয়ে কাজ করার আছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে কিছু সময়ের জন্য দরকার। ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করার দিকে নজর দিতে হবে। এটা ঠিক একদিকে বিনিয়োগ চাই, আবার সুদ বাড়ানো হবে এতে ব্যবসায়ীদের ওপরে প্রভাব কিছুটা পড়বে।’















সর্বশেষ সংবাদ
অর্ধলক্ষাধিক বইয়ের সমাহার কুমিল্লার গণগ্রন্থাগারে
চৌদ্দগ্রামে যুবককে পিটিয়ে হত্যা
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ফোন নাম্বার হ্যাক
জামায়াত নেতা মাহবুবর রহমানের মায়ের ইন্তেকাল
ব্রাহ্মণপাড়ায় বিজিবি অভিযানে গাঁজাসহ মাদক কারবারি গ্রেপ্তার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় কুমিল্লার এক যুবক নিহত
কুমিল্লায় একদিনে তিন লাশ উদ্ধার
যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলাম স্মরণে শোক সভা
কাউকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া যাবে না
চৌদ্দগ্রামে যুবককে পিটিয়ে হত্যা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২