বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি ২০২৫
১৭ মাঘ ১৪৩১
রবিবাসরীয়...
প্রকাশ: রোববার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৫, ১২:৫১ এএম |

রবিবাসরীয়...













কাব্যচিন্তা ও কাব্যলোক
জুলফিকার নিউটন ।।
রবিবাসরীয়...পূর্বে প্রকাশের পর
বিদ্যা এবং পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে আমাদের ধারণা এখনও শিশুসুলভ। সমাজে যেমন ঁহবধৎহবফ রহপড়সব বলে একটা জিনিস আছে-বাপ-দাদার জমানো টাকায় কিম্বা সম্পত্তিতে বাবুগিরি করা-তেমনি পুঁথিগত বিদ্যা হল ঁহবধৎহবফ ষবধৎহরহম। এটাও এক ধরনের পরের ধনে পোদ্দারি সেটা শেষ পর্যন্ত মুখস্থ বুলিতে দাঁড়ায়, সেটার নাম বিদ্যা ফলানো। পুঁথির বিদ্যা যখন নিজের চিন্তার দ্বারা শোধিত হয়ে সম্পূর্ণরূপে নিজস্বীকৃত হয় তখনই তাকে বলা যায় বিদ্যা, তার পূর্বৈ নয়। বিদ্যার সাঙ্গীকরণ এবং স্বকীয়করণের মধ্যেই আসল পাণ্ডিত্য। রবীন্দ্রনাথ সেই নির্জলা পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন।
শুরুতে বলেছিলাম যে রবীন্দ্রনাথের উক্তি কবিরে পাবে না তার জীবনচরিতে-এ কথা আংশিকভাবে সত্য হলেও পুরোপুরি সত্য নয়। জীবনী যেখানে ঘটনাপঞ্জীতে পর্যবসিত কবির কবিসত্তা সেখান থেকে নির্বাসিত-বলা নি®প্রয়োজন যে রবীন্দ্রনাথ ঐ অর্থেই কথাটি বলেছিলেন। তথাপি এ কথা মানতেই হবে যে বিশেষ বিশেষ ঘটনা কবির জীবনকে নিঃসন্দেহে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, তাঁর কবি-মনের গঠনে নিশ্চিত সহায়তা করেছে। তা হলেও জীবনী এমন জিনিস যে ঘটনার ভিড়ের মধ্যে কবির একান্ত তন্ময় তদগত ব্যক্তিত্বটি সেখান হারিয়ে যাওয়া কিছুই বিচিত্র নয়। কাজেই কবির যিনি জীবনীকার তাঁকে শুধু জীবনীকাহিনী লিখলেই হবে না, লিখতে হবে চরিত্রকথা। কবি মানুষের যে বিশেষ মনের গড়ন সেটিই তাঁর কবিচরিত্র। সেই চরিত্রের রহস্য উদঘাটনই জীবনীকারের প্রধান কর্তব্য। সে রহস্যের সন্ধান মিলবে কিছু কবির স্বভাবের মধ্যে কিছু যে পরিবেশে তিনি বর্ধিত হয়েছেন সেই পরিবেশের মধ্যে কিছু বা কবি-জীবনের কোনো কোনো ঘটনার মধ্যে। সেই ঘটনাগুলি আপাতদৃষ্টিতে গুরুতর রকমের কিছু না হলেও কবির জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ-এ কথা মানতেই হবে। মোটের ওপর উপরোক্ত ঐ তিনের-কবির স্বভাব, শৈশব-কৈশোরের পরিবেশ এবং বিশেষ বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে তবে কবিকে সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব হবে।
এই সূত্রে আবার মনে রাখতে হবে যে জন্মমাত্রই কোনো মানুষ তৈরি স্বভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। শিশুর স্বভাবের মধ্যে নিজস্ব ভাব বিশেষ কিছুই নেই। সবটুকুই পরস্ব। পরের অর্থাৎ অপরের ভাবকেই আমরা বলি প্রভাব। দিনের পর দিন চোখে যা দেখছে, কানে যা শুনছে তাই দেয়ই শিশুর স্বভাব গড়ে উঠছে। গৃহগন্ডির মধ্যে নিত্য দিনের কর্মকান্ড, পরিবার-পরিজনের আচার আচরণ, যে পারিপার্শ্বিকে নিত্য বিচরণ তারই প্রভাব পড়ছে তার স্বভাবে। তা হলেই দেকা যাচ্ছে যে মানুষের স্বভাব বহুলাংশে পরিবেশের সৃষ্টি। শিশু রবীন্দ্রনাথের স্বভাব গঠনে মহর্ষি ভবনের সুস্থ সংযত পরিচ্ছন্ন পরিবেশের প্রভাব সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। মহর্ষিকে আমরা একজন ধর্মপ্রাণ ভগবদ্ভক্ত মানুষ হিসেবেই ভাবতে শিখেছি। তিনি যে একজন কবি-স্বভাব সৌন্দর্য-প্রেমিক শিল্পরুচিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। রামমোহন যে ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই ধর্মকে সমাজবদ্ধরূপ দেবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ তিনি ব্রাহ্ম চার্চের প্রতিষ্ঠাতা। ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের সর্বপ্রকার ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের রূপ এবং রীতি সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত। মহর্ষির ধর্মবোধের সঙ্গে সৌন্দর্যবোধ অতি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। উপনিষদে ভগবানকে বলা হয়েছে প্রজ্ঞানঘন, মহর্ষি বলতেন, আমার দেবতাকে আমি দেখেছি সৌন্দর্যঘন রূপে। সৌন্দর্যচর্চাকে তিনি ধর্ম চর্চার অঙ্গ বলে মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথ যে পরবর্তীকালে তাঁর ধর্মকে ৎবষরমরড়হ ড়ভ ধহ ধৎঃরংঃ আখ্যা দিয়েছিলেন সে আখ্যা মহর্ষির ধর্মাচরণের, প্রতিও প্রযোজ্য। মহর্ষির মধ্যে এই সৌন্দর্যপ্রীতি যদি বদ্ধমূল না হত তা হলে একই পরিবারের মধ্যে একই সময়ে কাব্য নাট্য চিত্রকলা সংগীতকলার এমন সুসংবদ্ধ চর্চা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন বিচিত্র প্রতিভার স্ফূরণ কখনো সম্ভব হত না। এই পরিবেশের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কৈশোর উদ্যাপিত হয়েছে। রবীন্দ্র-প্রতিভার আলোচনার পূর্বে মহর্ষি-প্রতিভার কথা বিশেষভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। 
স্ব-কল্পিত রীতি নীতি বিধি-প্রণয়নের দ্বারা দেবেন্দ্রনাথ এক নতুন সমাজের পত্তন করেছিলেন। যে ভিত্তির উপরে তিনি এই সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার মূলে ছিল সাংসারিক জীবনে, সামাজিক আচার ব্যবহারে, অশন আসন বসন ভূষণে, উৎসবে অনুষ্ঠানে প্রখর রুচিবোধ, গভীর সৌন্দর্যবোধ এবং শিক্ষায় দীক্ষায় কর্মে  চিন্তায় প্রবল স্বদেশানুরাগ। বলাবাহুল্য তাঁর সমাজ-পরিকল্পনার প্রাথমিক পরীক্ষা তিনি আপন পরিবারের মধ্যেই করেছেন। সুচিন্তিত ধবংঃযবঃরপ আদর্শ যে সমাজে কতখানি শক্তিসঞ্চার করতে পারে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-পরিবার এবং এককালের ব্রাহ্মসমাজ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন তখন অনুরূপ পরিকল্পনায় ধবংঃরবঃরপ ভিত্তিতে একটি অভিনব জীবন প্রণালী গড়ে দিয়েছিলেন। ঐ জীবনটিই শান্তিনিকেতনের শিক্ষার মূল কথা। আমার বক্তব্য এই যে, দেবেন্দ্রেনাথের শিক্ষা এখানেও পুত্রের জীবনে সক্রিয়ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। জীবনস্মৃতিতে তিনি যে তাঁর গৃহপরিবেশের কথা বলেছেন বিদ্যালয়-পরিচালনায় সেই কথাটি বিশেষভাবে স্মরণে রেখেছেন। 
রবীন্দ্রনাথের ন্যায় বিশ্ববিখ্যাত মানুষের জীবনে বহু বৃহৎ এবং চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কোন্ ঘটনা কতথানি আলোড়ন সৃষ্টি করল তার উপরে তার গুরুত্ব নির্ভর করে না-বিশেষ করে কবি, দার্শনিকদের জীবনে। কবির মন বড় খেয়ালি মন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর জীবন-স্মৃতিতে বলেছেন, সে আপন অভিরুচি অনুযায়ী কত কি বাদ দেয়, কত কি রাখে। কত বড়কে ছোটো করে, ছোটকে বড়ো করিয়া তোলে। মন গড়ার একটা প্রক্রিয়া সকল মানুষের মধ্যেই অবিরাম চলতে থাকে। স্থূল-প্রকৃতি সাধারণ মানুষের মধ্যে সেটা বিশেষণ বিশেষ ঘটনার মারফতে ঘটে। কবি বা ভাবুক-প্রকৃতির মানুষের বেলায় সেটা ঘটার অপেক্ষা রাখে না। নিঝুম দুপুর বেলায় নির্জন ছাদ থেকে আকাশের কোলে যে চিল পাখিটির কণ্ঠ শুনতে পেয়েছেন সে তাঁর মনকে যতখানি দোলা দিয়েছে অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর ঘটনা ততখানি দেয় নি। কিভাবে, কি উপকরণের সংযোগে কবির মন গড়ে ওঠে কেউ তা বলতে পারে না। এমনও হতে পারে উপকরণের অভাবেই মন গড়ে ওঠে। কল্পনা দিয়ে উপকরণের অভাব ভরাট করতে হয়, কারণ মন কখনো শূন্য থাকে না। দর্শন-স্পর্শন-শ্রবণের উপকরণ আয়ত্তের মধ্যে যত কম থাকবে মন তত বেশি কৌতূহলী এবং কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠবে। ভাবলে অবাক লাগে, এমন বিচিত্র যে মানুষের জীবন সে মানুষের শৈশব বি অভাবনীয়রূপে বৈচিত্র্যহীন। শুধু যে একটি গৃহ-প্রাচীরের মধ্যে আবদ্ধ এমন নয়, শ্যাম চাকরের খড়ি-আঁকা গণ্ডির মধ্যে বন্দি। অসহায় বালকের বন্দিদশা কল্পনা করে কোমলহৃদয় পাঠকের মন আর্দ্র হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু উক্ত পাঠক এই কথা ভেবে সান্ত্বনা লাভ করতে পারেন যে ঐ খড়ি-আঁকা গণ্ডির মধ্যেই কবিমনের হাতেখড়ি হয়েছ্ েমনটা যত বেশি জানালার খড়খড়ি খুলিয়ে সমস্ত দিনঘাট বাঁধানো পুকুরটাকে একখানা ছবির বহির মতো দেখিয়া কাটাইয়া দিতাম।’ পুকুরের ধারে প্রকান্ড একটা চীনা বট। ‘পুষ্করিনী নির্জন হইয়া গেলে সেই বটগাছের তলাটা আমার সমস্ত মনকে অধিকার করিয়া লইত।’ ‘বাহিরের সংশ্রব আমার পক্ষে যতই দুর্লভ থাক্ বাহিরের আনন্দ আমার পক্ষে হয়তো সেই কারণেই সহজ ছিল। উপকরণ প্রচুর থাকিলে মনটা কুঁড়ে হইয়া পড়ে, সে কেবলই বাহিরের উপরেই সম্পূর্ণ বরাত দিয়া বসিয়া থাকে, ভুলিয়া যায়, আনন্দের ভোজে বাহিরের চেয়ে অন্তরের অনুষ্ঠানটাই গুরুতর।’ বেশির ভাগ মানুষের জীবনে অন্দর বলে কোনো জিনিস নেই, শৈশব থেকেই জীবনটা বড় বেশি সদর-সেখানে বহু মানুষের আনাগোনা, কলরব। বাইরেটা এত বেশি জায়গা জুড়ে নেয় যে মনটার মধ্যে নিরালার অবকাশ বড় একটা থাকে না। সেই মন একটু বেড়ে আর বাড়তে চায় না, গোড়াতেই হাড় পেকে যায়। কোনো রকম গন্ডি যেখানে নেই মনের কল্পনাশক্তি সেখানে ঝিমিয়ে পড়ে, নিজের অজান্তে গন্ডি তৈরি হয় এবং মনটা গন্ডির মধ্যেই বাঁধা পড়ে যায়। কিন্তু  শৈশবের ঐ গন্ডিবন্দি বালক যাকে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে বাইরের জগৎটাকে দেখতে হয়েছে সেই মানুষই একদিন বলতে পেরেছে, আমি সুদূরের পিয়াসী। নীল আকাশের কোলে চিলকে যে ভাসতে দেখেছে সেই বলতে পেরেছে, গৃহত্যাগী মন মুক্তগতি মেষপৃষ্ঠে লয়েছৈ আসন, উড়িয়াছে দেশ দেশান্তরে। গৃহপ্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে যেদিন প্রথম সদর রাস্তায় পদার্পণ করেছিলেন সেদিন পায়ের চটি-জুতা পা ছাড়িয়ে আগে আগে চলেছিল, অনভ্যস্ত অপটু পদক্ষেপ যাকে পদে পদে বিড়ম্বিত করেছে সেই মানুষই বলেছে, এর চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুঈন। পদে পদে বাধাই তাকে বাঁধনমুক্ত করেছে। বলাবাহুল্য সেদিনকার শিশু মনেই এইসব কবিতার জীবন বপন হয়েছিল।


চলে যাওয়া


সফিকুল বোরহান ।।
রবিবাসরীয়...ঘড়ঘড়...হিস্ হিস্...হুশ...ঝিক্ ঝিক্..., ট্রেন চলার বিবশ শব্দে আনমনা চলে আসে। কী মোহতা ট্রেনের দুলুনীতে! মন ভাল হয়ে যায়, আবার ঘুমও পায়। কিন্তু ঘুমাতে ইচ্ছে করে না। বাইরের দিগন্তচড়ায় কালো ফিঙ্গে উড়ে ছোঁ মেরে পোকাঠোঁটে ফিরে এসে বসে ঘাস খাওয়া মহিষের পিঠে। দূরে আরেকটা মহিষের পিঠে দুধ সাদা জোড়া বক ছবির মত দাঁড়ানো। পশুতে পাখিতে অপূর্ব হৃদি বন্ধন! বকেদের ঝাঁক দল বেঁধে দিগন্ত সাদা করে উড়ে গিয়ে অন্য এক জায়গায় বিচরন। রেল সিগন্যালের তারে নান্দনিক ভঙ্গিমায় মায়া শালিকের ঝাঁক। পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিম আকাশে জাফরানি রঙের ওড়না। লাল, হলদে, নীল আর আকাশি রঙে মাখামাখি মেঘেরা বর্ণিলে কাব্য তুলছে। ফাঁকে শেষ সূর্যচ্ছটা মনের গভীরে ঢুকে যেন বলছে, ‘ফিরে আসবে তিথি, ফিরে আসবে। ভাসবে তোমার পলকায়, নাইবে রঙ মনিষায়।’
না, তিথি আর ফিরে আসেনি।
তিথি চাকরি নিয়ে রাজশাহী চলে এসেছে এক মাস হলো। যে তিথি বিয়ের পর কোনোকালে একরাত কোথাও থাকেনি, এমনকী তার বাবার বাড়িতেও, সেই তিথি রিমনকে ছাড়া থাকছে কোন বিভূঁই-য়ে, তাও একা! ঝরঝর দমক কান্নায় রিমনের বুক হালকা হয় না।
লাগোয়া ব্যাংকের ছোট্ট দু’রুমের একটা ডরমেটরিতে থাকে তিথি। পাশেই অন্য ব্যাংকার দম্পতি। পরিবেশটা বেশ নিরাপদই বলা চলে। রিমনকে দেখে মোটেও অবাক হয়নি তিথি। জানে, পৃথিবীর যেখানেই যাক রিমন তাকে খুঁজে বের করবেই। ব্যাংকের পিয়ন যখন তিথিকে বললো, রিমন সাহেব নামে একজন আপনার সাথে দেখা করতে চায়, শুনেই দমকে চোখের পানিটাকে শক্ত করে আটকে ভেতরে নিয়ে আসে রিমনকে।
এই একটা মাসেই দূরত্বের দেয়াল ঝাপটা মারে। বুক হু-হু করা প্রশ^াসে কথারা উঠে আসতে চায় না, ‘বাহ্, এ ক’দিনেই বেশ স্মার্ট চাকরিজীবী হয়ে গেছো তিথি, বাসায় শাড়িও পড়ে থাকছো।’ তিথি দৃষ্টি নমিত রেখে শাড়ির আঁচলটা একটু টেনে ওরুমে গিয়ে খানিক পর দু’কাপ ধুমায়িত চা আর একটা প্লেটে অনেকখানি পাউরুটি টোস্ট রেখে ‘খাও’, বলে পাশের চেয়ার টেনে বসলো, মুখোমুখি। রিমন ‘হাতমুখে পানি দিতে হবে’ বলে দাঁড়াতেই তিথি বেসিন দেখিয়ে দেয়।
‘তোমার প্রিয় পাউরুটি টোস্ট এখন খেয়ে নাও, রাতের খাবার একটু দেরি হতে পারে।’
‘খিদে নেই’ বলে চায়ের কাপে চুমু দিতেই তিথি টিসু এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘কাপটা রেখে চোখটা মোছো, মেয়েদের মতো চোখে পানি ভরে রাখছো কেনো।’ একটু থেমে ‘এতদূর জার্নি করে এসেছো, খিদে নেই বলাটা তোমার চিরায়ত অভ্যাস।’
শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে হলো রিমনকে। তিথি কিছুতেই রাজি হয়নি চলে আসতে। না, রিমন কঠিন কোনো মিনতি করেনি তিথিকে। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম প্রেম বলে কিছু ছিল না তিথি-রিমনের জীবনে, প্রতিটি মুহুর্তই প্রথম প্রেম হয়ে জীবনের বহতায় কোনদিক দিয়ে পাঁচটা বছর পার করে দিল। জাগতিক প্রেম মানুষকে শান্তি দেয়, কিন্তু স্বস্তি কতটুকু দেয় তা এখনো বোঝা হলো না। আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত যতটুক দূরত্ব, তার থেকেও অনেক বেশি পথ তিথি-রিমন বিগত পাঁচটি বৎসর বিশ্বাসে ভরা যুদ্ধ করে পাড়ি দিয়েছে, যার প্রানশক্তিই ছিলো ভালোবাসা।
ভালবাসা যা দেয়, তারচে সম্ভবত বেশি কেড়ে নেয়। ঠিক পাঁচ বছর পর তিথিই তুলেছিল, ‘রিমন, আমি আর পারছিনা। একাকীত্ব আমার অস্থি-মজ্জায় হীমকাঁপুনি তুলছে। তোমার সাথে থাকাটা যে কী প্রাপ্তির, আমি জীবন দিয়ে তা প্রমান করতে পারবো, কিন্তু সময়ের বারতা আমাকে প্রানসংহারের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’
বেশ আকুলতা ও আহত মননে রিমন, ‘তিথি, পরের চারটা বছর তো আমরা সব রকমের চেষ্টা করেছি, জীবনে যা উপার্জন করেছি দেশে-বিদেশে যতরকম ডাক্তার-ডায়াগনষ্টিকের পেছনে কার্পন্য করিনি। ডাক্তারি পরিভাষায় আমার দিকটায় ত্রুটি, সেটাতে আমার কোনো হাত নেই। আমাদের পার্সোনাল ইমোশনালগুলোতেও কোনো অপূর্ণতা নেই। যে প্রেম তুমি দিয়েছো, তোমার ঋণ আমি ইহজন্মে শোধ করতে পারবো না।’
হাউমাউ কান্নায় তিথি জড়িয়ে ধরে রিমনকে। ‘আমি ওভাবে বলতে চাইনি রিমন, তুমি যখন কাজে চলে যাও, হাজার রকমের শূন্যতা ডাইনির শত পাখনা নিয়ে আমাকে বিবশ করে। গান, বই, মুভি, বাগান, আত্মীয়-বন্ধু, সংসার আমাকে দিনের বেশীরভাগ সময় দিতে দিতে তারাই এখন নিঃসাড় হয়ে আসছে।
‘আবার চাকরি নেবে একটা?’
‘রিমন, তুমি কি আমাকে বুঝতে পারছো না? আমার শুন্যতা আমাকে কোথায় তড়পায় তা কি দেখেও দেখছো না? আমি নিজের বেদনায় তোমাকে জড়াতে চাই না রিমন, নেগেটিভিটি আমারও হতে পারতো, কিন্তু কী এক অব্যক্ত যন্ত্রনা খুবলে খাচ্ছে আমাকে, এটা তোমাকে বোঝাতে পারছি না।’
রিমন আকুলে ডোবে, ‘মাতৃত্বের কাঙ্খিত বেদনার দুর্বিসহ যাতনা বুঝবো না, এমন মানুষ আমি নই। আমারও কত আকুলতা ‘মা’ চিত্রপটে তোমাকে দেখবো, এটা জেনে গেছো এতদিনে। আমার অনাকাঙ্খিত অক্ষমতা তোমাকে মাতৃবঞ্চনায় সিক্ত করছে, তা ধুয়ে-মুছে দিতে আমার অপার ভালবাসা তোমাকে কি কোনো অংশে বঞ্চিত করেছে তিথি?’
‘জানি না, বুঝতে পারছিনা কিছুতেই। মা হতে না পারলেও জীবন চলে, কিন্তু আমি শক্তিহীন হয়ে পড়ছি, এটা আমার মানসিক গ্রস্থতা হতে পারে। আমি উন্মাদ হবার আগেই তোমার থেকে মুক্তি চাই রিমন। বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে যাবার নিষ্ঠুর দৃশ্যটা দেখার আগেই তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চাই।’
শেষ পৌষের শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদটা তিথির বারান্দা থেকে হালকা কুয়াশার মাখামাখিতে কী উজ¦ল দেখাচ্ছে। কোনো কোলাহল নেই কোথাও। ঝিঁঝিঁ পোকারা চাঁদ আকর্ষনে কীনা, রাত প্রথমেই তারস্বরে মেতে উঠেছে।
‘লাইট অফ করে দেব? অন্ধকারে জোসনাটাকে ভালভাবে দেখতে পারবে তুমি।’ তিথির নরম স্বর।
‘কেনো চলে এলে তিথি! এক মুহুর্তও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। নিঃসঙ্গতা আমাকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।’
‘সে আর সম্ভব না, রিমন।’ তিথি অঝোরে কাঁদে।
‘কেন, সম্ভব না কেন? এর আগেও তুমি কতবার দুস্টুমি করে বলেছ, চলে যাবে, কিন্তু যাওনি একবারও। এখন কেন চলে গেছ তিথি?’
কথাহীন নিস্তব্ধতা জাঁকিয়ে বসে পুরো পরিবেশটাকে বেদনাতুর করে তুলেছে।
‘চলো, পদ্মা পাড় থেকে ঘুরে আসি, চাঁদনি রাতে পদ্মাকে ভাল লাগবে তোমার।’ মন গভীরের তোলপাড়কে স্তব্ধ করে দিয়ে তিথির সহজাত অনুরোধে রিমন অবাক হয়।
উত্তাল পদ্মা জোসনামাখা চকমকিতে শান্ত, সৌম্য, চলতরহিত। দিগন্ত প্রসারিত চাঁদ আলোর মায়াবীতে তিথির মুখটা হাজার যোজন দূরের কোনো এক কায়া যেনো। এত পাশে তিথি, কিন্তু দূরত্বের কঠিন শূন্যতায় রিমন তলিয়ে যায়। সেখান থেকে আর উঠে আসা হয় না।
‘আমি রাতের ট্রেনে ফিরব।’
‘চলে যাবে? যাও।’
‘আমার সাথে আসবে না তিথি?’
‘আমি তো চলেই এসেছি রিমন, ফিরে আসার জন্য নয়।’
রাত দশটায় ফিরতি ট্রেন। সময় ঘনিয়েছে। তিথি অফিসের গার্ডকে ডেকে রিমনকে স্টেশনের ট্রেনে উঠিয়ে দিতে অনুরোধ করে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও আইটি বিষয়ক প্রশিক্ষক
অন্বেষা, রানির দিঘির পূর্ব পাড়, কুমিল্লা












সর্বশেষ সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন আনসার আলী মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি
কুমিল্লায় গ্রাহকের অভিযোগে ফেঁসে গেলেন পূবালী ব্যাংক ম্যানেজার
‘দুদক দুর্নীতিগ্রস্থ না হলে দুর্নীতি কমে আসবে’ -দুদক চেয়ারম্যান
ইতালিতে পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় মাফিয়া চক্রের হাতে তুলে দেয়ার অভিযোগ!
চৌদ্দগ্রামে ১০ মামলার আসামি ‘গাবলা সুমন’ আটক
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় গ্রাহকের অভিযোগে ফেঁসে গেলেন পূবালী ব্যাংক ম্যানেজার
দেশে ফেরেই গ্রেপ্তার স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা সাদ্দাম
এবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণ হচ্ছে
নদী-খাল কিছু নেই,তবুও নির্মিত হচ্ছেপৌনে ৪ কোটি টাকার সেতু
ট্রেন বন্ধের খবর জানতেন না কুমিল্লার অনেক যাত্রী
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২