একজন
রেজিস্টার্ড মনোবিজ্ঞানী অথবা ক্লিনিক্যাল সামাজিককর্মী প্যারেন্টিং বিষয়ে
অভিজ্ঞ। এই অভিজ্ঞ মানুষ হলেন এমন একজন ব্যক্তি, যার এ বিষয়ে পেশাদার
প্রশিক্ষণ রয়েছে। একই সাথে পারিবারিক সমস্যা সম্বন্ধে নানা অভিজ্ঞতাও
রয়েছে। কাজেই প্যারেন্টিং বিষয়ে কথা বলতে গেলে, পরামর্শ দিতে গেলে পেশাদারি
প্রশিক্ষণ লাগবেই!
নানা কারণেই একুশ শতকে ইতিবাচক প্যারেন্টিং নিয়ে
আলোচনা, আগ্রহ ও কনসার্ন হাইপ হয়ে উঠেছে। এর একটা বড় কারণ মুঠোফোন,
ইন্টারনেট, ডিজিটাল কনটেন্টসহ আরও অনেক কিছুই! চলমান সমাজ ব্যবস্থা এবং
সমাজে বসবাসকারী অভিভাবকদের সম্পর্কে একজন মনোবিজ্ঞানী চমৎকার ধারণা রাখেন।
নানা
সময় টেলিভিশনের পর্দায় বা মুখোমুখি আলোচনায় এমন সব সমস্যা সাধারণ মানুষের
সামনে উঠে এসেছে। বেশ ইতিবাচকভাবেই কিছু অভিভাবকদের মধ্যে প্যারেন্টিং
সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি হয়েছে।
প্যারেন্টিং আসলে কী নিয়ে কথা বলে?
প্যারেন্টিং-এর সাধারণ সমস্যাগুলো হলো রাগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা, ট্যানট্রাম,
আচরণগত সমস্যা, দুর্বল যোগাযোগসহ নানা কিছু। একজন অভিভাবকের দায়িত্ব হলো
শিশুকে বড় হয়ে উঠতে সাহায্য করা। শিশুকে সঠিকভাবে লালন পালন করা যাতে তার
বিকাশ নিশ্চিত হয়। শিশুকে সুরক্ষা প্রদান করা। নানা রকম বিকাশের দিকগুলো
বিবেচনায় রেখে যত্ন প্রদান করা।
শিশুদের বড় করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একজন
অভিভাবক নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন। এই মুহূর্তে বেশ
আলোচিত-মুঠোফোনের অধিক ব্যবহার বা অ্যাডিকশন।
একজন মনোবিজ্ঞানী
স্মার্টফোন অ্যাডিকশন সম্পর্কে অভিভাবকদের সাথে কথা বলবেন, পরামর্শ দেবেন।
খারাপ চিন্তাভাবনা, অনুভূতি, আচরণগুলো পরিবর্তনে পরামর্শ দেবেন। এখন একজন
শিক্ষা গবেষক হিসেবে অভিভাবকদের সাথে কথা বলে বাড়ির পরিবেশ বুঝে নানা রকমের
খেলা, এক্টিভিটি বা সময় কাটানোর টেকনিক সম্পর্কে ভেবে, ডিজাইন করে শিশুকে
ইতিবাচকভাবে সময় কাটানোর দিকে মনোযোগ ঘুরিয়ে দেওয়ার কাজটিই এ মুহূর্তে করে
যাচ্ছি।
মূল বিষয়টি যদি হয় আসক্তি কমানো সেক্ষেত্রে কীভাবে কমানো যায়,
আসক্তির ধরন কেমন, বাবা-মায়ের মধ্যে আসক্তি সম্পর্কে ধারণা স্পষ্টকরণ, ঠিক
কোন কোন আচরণের ভিত্তিতে বলা যায় একজন শিশু মোবাইলের প্রতি আসক্ত; সে
সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভের জন্য অথেনটিক সোর্স হলো একজন পেশাদার
মনোবিজ্ঞানী।
তার পরামর্শের ওপর ভিত্তি করেই অভিভাবক শিশুর জন্য সঠিক
প্রতিষ্ঠানটি খুঁজে বের করবেন। যেখানে শিশু খেলবে, সময় কাটাবে। শিশুর খেলা ও
সময় কাটানোর এ জায়গায় একজন আর্লি চাইল্ডহুড বিশেষজ্ঞ কাজ করতে পারেন। তিনি
নানা ধরনের খেলার ম্যাটেরিয়াল শিশুর আগ্রহের জায়গাগুলো কেন্দ্র করে তৈরি
করতে পারেন।
শিশুর অভিভাবককে শিশুর সাথে খেলার ও সময় কাটানোর ধরন
সম্পর্কে হাতেকলমে শেখাতে পারেন। শিশুর বিকাশ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ
করার মাধ্যমে নতুন কোনো খেলার ধারণা, পরিকল্পনা, ডিজাইন করতে পারেন। একজন
শিক্ষা গবেষক নানাভাবেই ইতিবাচক প্যারেন্টিং-এর ক্ষেত্রে ইনপুট দিতে পারেন।
এখন
কয়েকটি কেস স্টাডি নিয়ে আলোচনা করা যাক। একজন শিশুর নাম শোয়েব (ছদ্ম নাম)।
শিশুর বাবা বাইরে চাকরিজীবী এবং মা ঘরে। শিশুটির বয়স যখন ৩ বছর তখন তাকে
একটি স্কুলে দেওয়া হয়। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকেই কিছুক্ষণ পরপর মোবাইলের নেশায়
সে ছুটে যাচ্ছিল অপেক্ষারত মায়ের কাছে। মাকে অনুরোধ করছিল ফোনটি দিতে।
কয়েকদিন
ভালোভাবে শিশুটিকে পর্যবেক্ষণ করার পর স্কুল শিশুকে খেলায় ব্যস্ত রাখার
জন্য শিশুর পছন্দের বিষয়গুলো ও স্ট্রেন্থ-এর জায়গাগুলো চিহ্নিত করে নানা
রকমের ম্যাটেরিয়ালের সাথে সময় কাটানোর ব্যবস্থা করলো। আস্তে আস্তে সময়ের
সাথে শিশুটি মোবাইলের আসক্তি থেকে বের হয়ে আসলো। ইতিমধ্যে শিশুটির বাবা ও
মাকে পরামর্শ দেওয়া হলো একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে। তারা সেটা
করেছিলেন বলেই পুরোটা মিলিয়ে শিশুটি সাহায্য করা সম্ভব হয়েছিল।
আরেকটি
কেস স্টাডি এখানে উল্লেখ করছি। এই শিশুর বয়স ২ বছর ৩ মাস। শিশুর স্পিচ
ডিলেসহ আরও নানা রকমের সমস্যা আছে। তার মধ্যে একটি হলো হাইপারএক্টিভিটি।
শিশুকে নিয়ে মা নানা হাসপাতালে গিয়েছেন। নানা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ
করেছেন। বিভিন্ন থেরাপি শেষে শিশুটি দলীয়ভাবে অন্যান্য শিশুদের সাথে একটি
প্রতিষ্ঠানে খেলা শুরু করে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করে।
বাস্তবে
দেখা যায় সত্যিই দলীয় খেলার পরিবেশ শিশুর মধ্যে একটা চমৎকার স্থিরতা নিয়ে
আসে কিন্তু রাতারাতি স্পিচ ডিলে-এর সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। সাধারণত
একজন কাউন্সিলর বা মনোবিজ্ঞানী বাবা-মাকে ছোট শিশুদের তাড়াতাড়ি স্কুলে দিয়ে
দিতে বলেন যাতে অন্য শিশুদের সাথে মিশে চমৎকারভাবে গড়ে উঠতে পারে।
এটা
সঠিক পরামর্শ কিন্তু একটা পরিবেশে গিয়ে শিশু ঠিক কী করবে, কীভাবে সময়
কাটাবে, অন্য শিশুদের সাথে তার বন্ডিং কীভাবে তৈরি হবে এগুলোর জন্য যথেষ্ট
পর্যবেক্ষণ, পরিকল্পনা এবং একজিকিউশনের ভাবনাগুলো নিয়ে ব্রেইন স্টর্মিং
করার প্রয়োজন আছে। এই দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের যারা এক্টিভিটির বিষয়গুলো নিয়ে
ভাববে ও গবেষণা করবে তাদের ওপর বর্তায়।
প্যারেন্টিং নিয়ে কেবল বাংলাদেশে
নয় বরং পুরো বিশ্বেই আলোচনা চলছে। ইন্টারনেট ভিত্তিক কনটেন্ট-এর ব্যবহার
বৃদ্ধি পাওয়ায় সমাজে নানা রকমের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। একই
সাথে অভিভাবকদের ব্যস্ত জীবন। জীবিকার সন্ধানে ঘরের বাইরে দেওয়া প্রচুর সময়
সন্তানদের বড় করে তোলার ক্ষেত্রগুলোও চ্যালেঞ্জিং করে তুলছে।
এমতাবস্থায়
অভিভাবকরা প্যারেন্টিং-এর জায়গাগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। এখন
পজিটিভ প্যারেন্টিং নিয়ে ভাববার আগে সামাজিক সমস্যাগুলো আলোচনায় আনার
প্রয়োজন আছে। ঠিক কেন, কী কারণে অভিভাবকদের ইতিবাচক প্যারেন্টিং সম্পর্কে
ভাবতে সমস্যা হচ্ছে সে জায়গাগুলো চিহ্নিত করে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন আছে।
কেবলমাত্র
কাউন্সিলিং করা হলেই সমস্যার পুরো সমাধান হয়ে যায় না। সমস্যার সমাধান
সামগ্রিকভাবে করতে গেলে একজন বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে পরামর্শ পাওয়ার পর
পারিবারিকভাবে সমাধান অ্যাপ্লাই করার ক্ষেত্রে ও শিশুকে একটি ইতিবাচক
পরিবেশের মাধ্যমে লার্নিং-এর গ্রোথ নিশ্চিত করতে গেলে অবশ্যই একাধিক
রিলেটেড প্রতিষ্ঠানকে চমৎকার বন্ধনে কাজ করতে হবে। তাহলেই একটা চমৎকার
সমাধানের সন্ধান পাওয়া যাবে।
ঠিক এ পর্যায়ে একজন শিশুর কথা মনে পড়ছে যার
বয়স পাঁচ বছর। শিশুটি বাবা ও মায়ের অনুপস্থিতিতে একটা লম্বা সময় বাড়িতে
থাকে। ঠিক কীভাবে সময় কাটাবে সে বিষয়টি শিশু ধরতে পারে না। তার এলেবেলে
সময়ের মধ্যে বয়স অনুযায়ী কনটেন্ট-এর অভাব স্পষ্ট। এমন অবস্থায় শিশুর আচরণীয়
সমস্যার সাথে বাবা ও মাকে বেশ কষ্ট করতে হয়।
সবসময় ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ
সমাধান নয়। কেবলমাত্র বই হাতে ধরিয়ে দিলেও চাহিদামতো আউটপুট পাওয়া যায় না।
সময় দেওয়া, কথা বলা এবং নিজের জন্য চমৎকার কিছু করার বিষয়গুলো শিশুদের
অভ্যাসের মধ্যে নিয়ে আসতে হয়। একই সাথে অভিভাবককে শিশুর বেড়ে ওঠার জার্নি
সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা রাখতে হয়। প্যারেন্টিং-এর ত্রুটির জায়গাগুলোর একটি
হলো শিশুর ডেভেলপমেন্ট সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য না রাখা।
প্যারেন্টিং-এর
জার্নি তো জীবনব্যাপী! অভিভাবক হওয়ার আগেও চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন আছে।
হওয়ার পর দায়িত্ব নেওয়ার মানসিকতা থাকারও দরকার আছে। একজন শিশুকে বড় করে
তোলার জার্নিটা খুব সহজ না। প্রয়োজনে কাউন্সিলিং করতে হবে। নিজেকে ও বয়স
অনুযায়ী শিশুকে। সাহায্য নিতে হবে একজন মনোবিজ্ঞানীর।
তারা যথার্থ
অর্থেই একজন বিশেষজ্ঞ। জানেন এবং বোঝেন এবং ব্যাখ্যা করতে পারেন বর্তমান
পরিস্থিতি। একই সাথে শিশুর জন্য উপযুক্ত একটি চমৎকার প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের
করতে হবে যারা বৈজ্ঞানিকভাবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুসরণ করে চমৎকার
গাইডেন্স দেবে। শিশুর সামগ্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে এমন পন্থা কার্যকরী হবে
বলেই আশা করা যায়। আমরা আফ্রিকান সেই প্রবাদের কথা জানি, একটি শিশু গড়ে
তুলতে একটি গ্রামের প্রয়োজন হয়।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, শৈশব; শিক্ষা বিষয়ক লেখক ও গবেষক