দেশে কোনো নতুন রাজনৈতিক দল হবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ। তবে ইদানীং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের উদ্যোগে একটি দল গঠন করার সংবাদে দেশব্যাপী বেশ কিছুটা গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দল গঠন নিয়ে গুঞ্জন কিংবা আলাপ-আলোচনা অনাকাক্সিক্ষত কিংবা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে সে নতুন দল গঠন নিয়ে সৃষ্ট নানাবিধ সন্দেহের কারণে। সন্দেহের মূল কারণ হচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে কয়েকজন ছাত্রনেতার অবস্থান নিয়ে। কারণ প্রথাগতভাবে ক্ষমতার অংশীদার থাকা অবস্থায় কোনো দল গঠনের প্রক্রিয়া সংগত নয় বলে মনে করাটা অসংগত নয়। এ কথা ঠিক যে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিংবা তাঁর বর্তমান প্রশাসনের কেউ কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল থেকে আসেননি, তবে তাঁদের কোনো না কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিশ্বাস থাকতেই পারে।
তাতে অসংগতি কিংবা অন্যায়ের কিছু নেই। তবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে দেশের কয়েকটি নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রদের কাছ থেকে। তাঁদের অভিযোগ কিংবা বক্তব্য হচ্ছে, যেভাবেই হোক বর্তমানে ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করলে সেটা হবে রাজনৈতিক পক্ষপাতের দায়ে অভিযুক্ত কিংবা কলঙ্কিত। কারণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দিক থেকে সেটা কোনো কাঙ্ক্ষিত আচরণ নয়।
কোনো রাজনৈতিক দল গঠন বা সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে হলে সেসব ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কিংবা একটি দলনিরপেক্ষ অস্থায়ী সরকারের চৌহদ্দি কিংবা প্রভাববলয় থেকে যেভাবেই হোক বেরিয়ে আসতে হবে। সেটাই হবে নীতি-নৈতিকতাভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক আচরণ। সে কথাটিই প্রথম থেকে বলে এসেছেন বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তাঁর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাতে রাজনৈতিক বিরূপতা কিছু আছে বলে কেউ মনে করে না।
বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সংগ্রামী ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান এ দেশের আপামর জনসাধারণকে দিয়েছে নতুন আঙ্গিকে একটি মুক্তির পথনির্দেশ।
তাতে দেশবাসী অবশ্যই ছাত্র-জনতার প্রতি কৃতজ্ঞ। সে সংগ্রামী ছাত্র-জনতার যৌথ উদ্যোগে যদি নতুন কোনো রাজনৈতিক দল গঠিত হয়, তাকে তো দেশবাসী শুভ কামনা জানাবেই। কিন্তু এখানে সংগত প্রশ্ন হলো, জন্মের আগেই ছাত্র-জনতার সে প্রস্তাবিত দল যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। নৈতিক দিক থেকে যেন গ্রহণযোগ্যতা না হারায়। সে কারণেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে যে কজন ছাত্র প্রতিনিধি রয়েছেন তাঁরা প্রস্তাবিত দলে যোগ দিলে সরকারি দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে হবে। আর যাঁরা দলে সরাসরি যোগ না দিয়ে সরকারে থাকতে চান, তাঁরা দায়িত্ব পালন করে যাবেন। কিন্তু অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, সেটাও ঠিক হবে না। কারণ নবগঠিত দলটি হবে সরকারে কাজ করা ছাত্রনেতাদেরই আশীর্বাদপুষ্ট। সুতরাং দল গঠিত হলে সরকারের সব পর্যায় থেকে তাঁদের সরে যেতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি একটি নির্দলীয় প্রশাসন বলে গণ্য হয়ে থাকে। কিন্তু ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে জড়িত নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিয়েছিলেন আন্দোলনকারী জনতার অংশ হিসেবে, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে নয়। বাদবাকি উপদেষ্টারা হচ্ছেন পেশাজীবী মানুষ, যাঁরা সরকারি কিংবা বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছেন। তাঁরা সরাসরিভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। তা ছাড়া প্রকাশ্য সমর্থকও নন।
জনগণের রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর প্রায় পাঁচ দশক হতে চলল। এর মধ্যে তিনবার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় গিয়েছিল তারা। তারপর বিএনপির ওপর নেমে আসে এক অশুভ রাহুর গ্রাস। এক-এগারোর পর দীর্ঘ দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী কিংবা আরেক অর্থে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন। এ সময়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বিএনপির ওপর হামলা-মামলা, জেল-জুলুম এবং নির্যাতন-নিষ্পেষণসহ নেমে আসে অত্যাচারের খড়্গ কৃপান। এ সময়ে ওপরে উল্লিখিত দুটি দলের কত লাখ নেতাকর্মী হত্যা, গুম, জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তা আজও সঠিকভাবে জানা যায়নি। ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর উল্লিখিত দুটি দল মনে করেছিল এবার বুঝি দেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইবে এবং কর্তৃত্ববাদী কিংবা স্বৈরশাসনের অবসান ঘটবে। একটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং একটি জনগণের সরকার গঠিত হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সংবিধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রশ্নে দেখা দেয় একটি জটিল পরিস্থিতি। এখানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দিষ্ট সময় ঘোষণা নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের মধ্যে কিছুটা অসন্তোষও দেখা দেয়। বিএনপি এবং জামায়াতসহ বিভিন্ন দল জরুরি কিংবা অত্যাবশ্যক সংস্কারের বিরুদ্ধে নয়। তবে তাদের মতে সেগুলো একটা অনির্দিষ্টকাল যাবৎ চলতে পারে না। দেশের যাবতীয় সংস্কারের বৈধতা দেবে রাজনৈতিক দলগুলো এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করবে একটি নির্বাচিত সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের সেগুলো বাস্তবায়নের কোনো সাংবিধানিক বা আইনানুগ এখতিয়ার বা ক্ষমতা নেই। তবে গণ-অভ্যুত্থানোত্তর একটি বিপ্লবী অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে হয়তো সেটির দায়দায়িত্ব বা গুরুত্ব নিঃসন্দেহে একটু বেশি। বিএনপি বা জামায়াতের মতো বড় সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলোর যুক্তি হচ্ছে, অতিদ্রুত জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে তারা প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত করবে। যাতে দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে হারানো মূল্যবোধগুলো এ দেশের মাটিতে গভীরভাবে শিকড় গাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেবও একটি ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তাঁরা ক্ষমতাসীন হলে অন্যান্য দলের সমর্থনে সেসব সংস্কার কর্মসূচি নিয়েও কাজ করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দলীয় ব্যক্তি পরিচয়ে চাঁদাবাজি ও অনিয়মের যেসব অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন তারেক রহমান। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী অন্যান্য ব্যবস্থা নিতে গেলে হাতে প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকতে হয়।
মধ্য ফেব্রুয়ারিতে অর্থাৎ ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ছয় মাস পেরিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের উদ্যোগে বা সমর্থনে একটি রাজনৈতিক দল ঘোষিত হতে পারে বলে জানা গেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে যে তিনজন ছাত্রনেতা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন, তাঁদের একজন নব ঘোষিত দলটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারেন বলে জানা গেছে। এর পাশাপাশি এটাও বলা হচ্ছে যে নাগরিক কমিটি থেকেও নতুন দলটির প্রধান কিংবা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করা হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের যে তিনজন ছাত্র উপদেষ্টা রয়েছেন তাঁদের কেউ যদি নবগঠিত দলে যোগ দেন তাহলে সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন। বর্তমানে ছাত্র উপদেষ্টাদের মধ্যে রয়েছেন নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলম। নতুন দলে জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি থেকেও অনেকে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন বলে জানা গেছে। নাগরিক কমিটির নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি, আখতার হোসেন ও হান্নান মাসুদসহ প্রভাবশালী তরুণ ব্যক্তিরা রয়েছেন, যাঁরা নবগঠিত দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন। দেশের ভবিষ্যৎ সংসদ নির্বাচনে তাঁরা নিজেদের দলীয় প্রার্থী দেওয়া ছাড়াও অন্যান্য দলের সঙ্গে জোট গঠনের সম্ভাব্যতাকে এখন সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করেছেন বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে সাবেক ভিপি নুরের গণ অধিকার পরিষদ কিংবা আন্দালিব রহমান ও ববি হাজ্জাজের রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার নির্বাচনী জোট হতে পারে বলে জল্পনা-কল্পনা চলছে। তবে এ সব কিছুরই এখন সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। কোনো কিছু চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছতে এখনো অনেক সময় বাকি। তবে যতটুকু জানা গেছে, প্রস্তাবিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার নতুন দলে নেতৃত্বের বিভিন্ন পর্যায় থাকতে পারে। যেমন নবগঠিত দলটির উচ্চ পর্যায়ে একটি অভিভাবক পরিষদ থাকতে পারে, যারা বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন বিষয়ে বা ইস্যুতে উপদেশ দিতে পারেন। এখানে উল্লিখিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এ মুহূর্তে যথেষ্ট আলাপ-আলোচনা কিংবা পর্যালোচনা চলছে বলে জানা গেছে। এর সব কিছুই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে অবশ্য যথেষ্ট সময় লাগতে পারে। সে কারণে অনেকে মনে করেন ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত কি সব কিছু চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে? এসব ব্যাপারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য উপদেষ্টারা কোনো মন্তব্য বা মত প্রকাশ করেননি। অনেকের মতে, কারো নতুন দল গঠন করার ব্যাপারে উপদেষ্টারা কী-ইবা বলতে পারেন। এটি তাঁদের কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। কারণ তাঁরা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ অস্থায়ী সরকারের সদস্য। কিছু বলতে হলে কিংবা সে প্রস্তাবিত দলে যোগ দিতে হলে তাঁদেরও পদত্যাগ করতে হবে।
এ চলমান প্রক্রিয়ার পাশাপাশি প্রস্তাবিত নতুন দলের ছাত্রনেতা এবং নাগরিক কমিটির বিভিন্ন নেতা বা কর্মীদের অর্থ সাহায্য নেওয়া সম্পর্কে নানা অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। সেগুলো এখনো প্রতিষ্ঠিত না করা গেলেও বলা হচ্ছে প্রস্তাবিত দলের নেতাকর্মীরা দল গঠনের লক্ষ্যে চাঁদা বা অর্থ সংগ্রহ করছেন। অনেকে গাড়ি কিংবা পরিবহনের সুযোগ-সুবিধা করে দিচ্ছেন, কিন্তু তাতে কোনো আইনি বিধি-নিষেধ রয়েছে কি না জানা যায়নি। এসব ‘কানকথা’ কিংবা গল্পগুজব অথবা অভিযোগের জবাব একমাত্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কিংবা নাগরিক কমিটির নেতৃবৃন্দই যথাযথভাবে দিতে পারেন। তবে এ ব্যাপারে বিভিন্ন বিধি-নিষেধ কিংবা বৈধতা প্রসঙ্গে প্রস্তাবিত দলের নেতাকর্মীরা পরিষ্কার থাকাই বাঞ্ছনীয়। কারণ যেসব কারণে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে তার যেন কোনো পর্যায়েই আর পুনরাবৃত্তি না হয়। তা হলে আমাদের গণ-অভ্যুত্থানের গুরুত্বটিই সত্বর হারিয়ে যাবে। দেশ আবার নিপতিত হবে অতীতের অরাজকতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে যেমন দেশের বর্তমান বৃহত্তম দল বিএনপিকে হুঁশিয়ার হতে হবে, তেমনি অন্যদেরও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যা শোনা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর কিংবা আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সুতরাং সরকারি কিংবা দলীয় পর্যায়ে সবারই দায়দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সবারই কামনা, সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় দেড় থেকে দুই হাজার মানুষের প্রাণদানকে যেন অর্থবহ ও সাফল্যমণ্ডিত করে তোলা হয়।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক