বাংলাদেশের
অর্থনীতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের ভূমিকা অপরিসীম।
বিগত কয়েক দশক ধরেই বিদেশে বসবাসরত ও কর্মরত ভাই-বোনেদের পাঠানো
রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জীবনশক্তি হিসেবে কাজ করছে। বলা যায়
রেমিট্যান্স হচ্ছে অর্থনীতির প্রাণ ভোমরা। বৈশি^ক পরিমন্ডলে রেমিট্যান্স
অর্জনে বাংলাদেশ প্রথম দশটি দেশের একটি। ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে ১০ মিলিয়ন
মার্কিন ডলার দিয়ে শুরু হওয়া রেমিট্যান্স আয়, বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৬.৮৯
বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। রপ্তানী খাত থেকে এর চেয়ে বেশি আয় অর্জিত হলেও
একটি বিষয় প্রনিধানযোগ্য যে রপ্তানী আয়ের বিপরীতে বাংলাদেশকে আমদানি পন্য
বা কাঁচামাল আমদানি বাবদ বেশ বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। নীট আয় হিসেব
করলেও রেমিট্যান্স এর গুরুত্ব সহজে অনুধাবন করা যায়। ১৯৯০-৯১ সাল থেকে শুরু
করে ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রপ্তানী বাবদ আয় হয়েছে ৬০২.৩২ বিলিয়ন
মার্কিন ডলার এবং এর বিপরীতে আমদানী ব্যয় হয়েছে ৮৮৮.৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
(বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৪)। আমদানী ব্যয় রপ্তানী আয়ের চেয়ে বেশি
হয়েছে ২৮৬.৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ নিট রপ্তানি আয় সেই অর্থে
ঋণাত্বক। পক্ষান্তরে ১৯৯০-৯১ সাল হতে ২০২২-২৩ সময়কালে রেমিট্যান্স বাবদ
প্রেরিত মোট অর্থের পরিমান ২৭৯.৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যার পুরোটাই আয়। তাই
এক অর্থে আমাদের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত হচ্ছে জনশক্তি
রপ্তানী থেকে প্রাপ্ত বা রেমিট্যান্স বাবদ আয়।
আর্ন্তজাতিক অভিবাসন
সংস্থা এর ‘‘বিশ^ অভিবাসন প্রতিবেদন-২০২৪’’ এর মতে বিশে^র মোট জনসংখ্যার
প্রায় ৩.৬% ভাগ অর্থাৎ প্রায় ২৮ কোটি মানুষ (২০২০ সালের প্রাপ্ত ডাটা)
কাজের সন্ধানে ভিন দেশে অবস্থান করছেন। ২০২২ সালে বৈশি^ক রেমিট্যান্স এর
আকার ছিল ৮০১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যার মধ্যে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে
গেছে ৬৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমান রেমিট্যান্স। বিশ^ব্যাংকের মতে ২০২৩
সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রেমিট্যান্স থেকে প্রায় আয় হচ্ছে বৈদেশিক
অর্থায়নের বড় উৎস এবং এ সময়ে রেমিট্যান্স আয় বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা ও
সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমানকেও ছাড়িয়ে গেছে। ২০২২ সালে বিশে^র প্রথম
দশটি রেমিট্যান্স আয় গ্রহণকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮ম। এ
সময় বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয়ের পরিমান ছিল ২১.৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ
তালিকায় ১ম স্থানে ছিল ভারত যার আয়ের পরিমান ছিল ১১১.২২ বিলিয়ন মার্কিন
ডলার।
বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জনের প্রবণতা স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির
অনেক পূর্ব থেকে শুরু হলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তেল সমৃদ্ধ
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এটি বেশি গতি লাভ
করে। পরবর্তীতে মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, ইউরোপের কিছু দেশসহ বিভিন্ন শ্রম
বাজারে আমাদের শ্রমিক রপ্তানীতে হার বেড়েছে। বিশে^র প্রায় ১৭০ এর অধিক দেশে
এক কোটির বেশি বাংলাদেশি কর্মী ভাই-বোনেরা কর্মরত আছেন।
পরীক্ষান্তে
দেখা যায়, গ্রামীন জনগোষ্ঠীর মানুষেরাই কাজের সুযোগ সুবিধার জন্য ভিন্ন
দেশে গমনে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং সেসব দেশে পাড়ি দেন। সফলভাবে সেই শ্রমিক
ভাই ভিনদেশে অভিবাসী হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরী করতে সক্ষম হলে এর
ধারাবাহিকতায় তাঁর দেশে রেখে যাওয়া পরিবারের সদস্যরাও আর্থিক ও
সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ পান। শ্রমসাধ্য কাজের বিনিময়ে মাসের
শেষে দেশে অবস্থানরত পরিবারের জন্য টাকা পাঠাচ্ছেন। এ বৈদেশিক মুদ্রা
একদিকে দেশে তাঁর পরিবারের ভরণ পোষণ, পড়ালেখা, চিকিৎসা, ব্যবসা পরিচালনা
ইত্যাদি কাজে লাগছে। এটি একদিকে পরিবারে অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করছে
অন্যদিকে সরকারী কোষাগারে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার স্ফীত হয়ে ব্যালেন্স অব
পেমেন্টকে স্থিতিশীল রাখছে। রেমিট্যান্স বাংলাদেশের মতো উন্নয়নমুখী দেশের
শুধু যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ায় তা নয়, এটি গ্রামীন অর্থনীতিতেও বড়
ধরনের প্রভাব ফেলে। রেমিট্যান্স থেকে প্রাপ্ত আয় গ্রামীন অর্থনীতির বিভিন্ন
কর্মকান্ডে যুক্ত হয়ে কর্মসংস্থান তৈরীতে ভূমিকা রাখে, জীবনযাত্রার
মানোন্নয়ন ঘটায়, ভোগ বাড়ায়, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বাড়ায়, দারিদ্র
ঘুচায় এবং সর্বোপরি এটি জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের জাতীয় আয়
বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সাম্প্রতিক সমীক্ষা মতে প্রবাসীদের
পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রায় ৯০ ভাগ দেশে অবস্থানরত পরিবারের ভরণ পোষণ ও ঋণ
পরিশোধে ব্যয় হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ রেমিট্যান্সের উপর ভর করে পরিবার
তার আয় বাড়াতে সক্ষম হয় এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের পড়াশোনার পেছনে বিনিয়োগ করে
থাকে। ফলশ্রুতিতে দেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে উপকার লাভের সুযোগ তৈরী হয়।
লক্ষ্য
করা যায় বাংলাদেশ থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কমদক্ষ ও আধা দক্ষ জনবল বিদেশে
কাজ করতে যাচ্ছে। কিন্তু এ কমদক্ষ শ্রমিকদের যদি কাঙ্খিত দেশের শ্রমবাজারের
উপযোগী দক্ষতায় দক্ষ করে পাঠানো যায় তাহলে কম সংখ্যক শ্রমিক রফতানী করেও
অধিক পরিমাণ রেমিট্যান্স আয় করা সম্ভব হবে। এজন্য বিদেশে বাংলাদেশ
দূতাবাসের সাথে সমন্বয় করে শ্রমিক গ্রহীতা দেশের চাহিদা অনুযায়ী দেশের
অভ্যন্তরে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। বিদেশে
অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলো সেখানকার বাংলাদেশি শ্রমজীবি ভাই-বোনদের জন্য
সময় সময় উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়ে ধারণা দেয়ার লক্ষে সেমিনার আয়োজন করতে পারে।
এর মাধ্যমে দীর্ঘ সময় বিদেশে শ্রমসাধ্য ও উন্নত বা নতুন প্রযুক্তির
সংস্পর্শে কাজ করা বাংলাদেশি শ্রমিকরা দেশে ফিরে যাতে তাদের অভিজ্ঞতাকে
কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে উদ্যেক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন সে বিষয়ে ধারণা ও
সাহস পাবেন। সরকার কর্তৃক বিদেশ ফেরত শ্রমিকদের জন্য যে সকল সুযোগ সুবিধা
দেয়া হচ্ছে সে সম্পর্কে আগাম ধারণা পেলে দেশে ফিরেই শ্রমিক ভাইয়েরা নিজেদের
জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবেন। ফলে বিদেশ ফেরত শ্রমিকরা সহজেই
উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নিজেকে সংযুক্ত করে ভূমিকা রাখতে পারবেন। যথাযথ
উদ্যেগ ও সুযোগ পেলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে সরকারের নীতি সহায়তা
নিয়ে বিদেশ ফেরত শ্রমিক ভাইয়েরা বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটাতে পারবে। এতে করে
ব্যক্তির পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রও উপকৃত হবে।
বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম
উইংকে সেসব দেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের সাথে সার্বক্ষণিক সংযোগ রক্ষা
করে তাদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো দেখভাল করে দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স
পাঠানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করার জোরালো ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন। দেশে রেমিট্যান্স
বৈধ পথে প্রেরণের জন্য উদ্ধুদ্ধ করার লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক প্রদেয়
প্রনোদনার বিষয়ে বেশি বেশি প্রচার করা এবং রেমিট্যান্স প্রেরণের
চ্যানেলগুলোর সহজলভ্যতা ও শ্রমিকদের দৌড়গোড়ায় পৌঁছানোর প্রচেষ্টা চালানো
উচিত। কেননা দেখা গেছে অনেক সময় শ্রমিক ভাইয়েরা শহর থেকে অনেক দূরে
প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজে নিয়োজিত থাকেন বিধায় অফিস খোলার দিন তাদের পক্ষে
ব্যাংকে বা রেমিট্যান্স হাউজগুলোতে এসে বৈধ পথে দেশে অর্থ পাঠানোর সুযোগ
হয়ে ওঠে না। তাই অনেক সময় তারা অবৈধ পথে অর্থ প্রেরণে বাধ্য হন। এক্ষেত্রে
সেইসব দেশের ব্যাংক ও রেমিট্যান্স হাউজগুলোর সাথে বাংলাদেশের বিভিন্ন
ব্যাংকের ’সমঝোতা চুক্তি’ সম্পাদন করে দেশে অর্থ আনয়নের পথ সহজ করা
প্রয়োজন। তাছাড়া রেমিট্যান্স প্রেরণে লেনদেন খরচ কমানো সহ এটি দ্রুত ও
নিরাপদ করার উপর জোর দিতে হবে এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার আরো
কার্যকরীভাবে করতে হবে। দেশীয় ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক রেমিট্যান্স হাউজগুলোর
সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দেশে অর্থ প্রেরণের পর অভিবাসী শ্রমিকের পরিবারের
সদস্যরা যাতে সহজে অর্থ উত্তোলন করতে পারেন তার জন্য ব্যাংকিং সেবা আরো সহজ
করা যেতে পারে। দেশের যেসব অঞ্চলে/এলাকায় বেশি মানুষ অভিবাসী সেসব
অঞ্চলে/এলাকায় ব্যাংক এর পক্ষ থেকে প্রবাসীদের পরিবাবের জন্য বিশেষ সেবা
প্রদানের লক্ষ্যে হেল্প ডেস্ক চালু করা যেতে পারে।
রপ্তানী বাজারের মতো
বাংলাদেশের বিদেশস্থ শ্রম বাজারটিও খুব কম সংখ্যক দেশের উপর নির্ভরশীল।
এদেশের বেশির ভাগ রেমিট্যান্স আসে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে যা
দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নাও হতে পারে। যে কোন কারণে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রম বাজারে
কোন বিরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আমাদের দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ
বাধাগ্রস্থ হয়ে অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব তৈরী করতে পারে। তাই প্রয়োজন
প্রচলিত গন্তব্য ছাড়াও বিভিন্ন দেশে শ্রম বাজার বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য
কর্মসৃজনের সুযোগ আহরণ করা এবং সে সব বাজারে চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় দক্ষ
জনবল তৈরী করা।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক
কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স আয়ের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। রেমিট্যান্স বাবদ আয়
দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখে বেকারত্ব হ্্রাসের মাধ্যমে দারিদ্র
বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে এবং একই সাথে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা
অর্জনের পথে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। তাই এ খাতে বাস্তবতার নিরিখে নীতি
সহায়তাসহ মাঠ পর্যায়ে বিশ^বাজারের জন্য উপযোগী দক্ষ শ্রমিক তৈরীর প্রচেষ্টা
জোরদার করা জরুরী।
লেখকঃ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।