“ভালোবাসা”
চার অক্ষরের একটি আপাত নিরীহ শব্দ হলেও এর ব্যাপ্তি, ব্যঞ্জনা, দ্যোতনা,
সুর, লয়, তাল অনেক দূর অবধি বিস্তৃত। কেউ কেউ বলেন “ভালোবাসা” হলো একটি
অনুভূতি’র নাম। কেউ কেউ বলেন ভালোবাসা হলো বাতাসের মতো যাকে ধরা বা ছোঁয়া
যায় না শুধু অনুভব করা যায়। কেউ কেউ বলেন এটি শুধু অনুভূতিই নয় এটি সার্বিক
একটি প্রক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ যাকে একটি ‘প্যাকেজে’ এর সাথে তুলনা করা যায়।
ডিকশনারি এর সমার্থক শব্দ হলো-প্রণয়, স্নেহ, প্রীতি, অনুরাগ, মমতা, পেয়ার,
অনুরক্তি, আদর, প্রণয় ইত্যাদি। ভালোবাসার উৎস কোথায় তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক।
কেউ বলে এর জন্ম ‘মস্তিস্কে’, কেউ বলে এটি জন্ম নেয় মনের গহীনে। মনের বাস
কোথায় সেটি নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। গবেষকরা বলেছেন ভালোবাসা যতটা বাহ্যিক
তার চেয়েও বেশি হৃদয়ের ব্যাপার। ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসার উৎপত্তি। এ কথা
সত্যি যে শুধু মুখে বললেই ভালোবাসা হয় না, এর জন্য প্রয়োজন মনের গভীর
অনুভূতি। ভালোবাসার ফলে দুটি মনেরই পরিবর্তন ঘটে। গবেষকদের মতে একজনের যখন
অন্য কাউকে ভালোলাগে তখন মস্তিষ্কে রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ হয়। ফলে
ব্যক্তির মনে সৃষ্টি হয় সুখানুভূতির। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, একজন ব্যক্তি
অন্য কারও প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক মোট চার মিনিট ৯০ সেকেন্ড
সময় নেয়। গবেষকরা এটাও দেখেছেন, মানুষের মস্তিষ্ক প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে
ব্যক্তির কিছু বিষয় বিবেচনা করে। তার মধ্যে ৫৫ শতাংশ হলো তার অঙ্গভঙ্গি বা
বাহ্যিক রূপ, ৩৮ শতাংশ কণ্ঠস্বর ও কথা বলার ভঙ্গি এবং মাত্র ৭ শতাংশ তাদের
মূল বক্তব্য শোনে।
ভালোবাসার রং কারো কাছে নীল, কারো কাছে গোলাপি আবার
কারো কাছে সাদা-কালো। তবে ভালোবাসা যে রং এর ই হোক না কেন এর রকমভেদের উপর
ভিত্তি করে এর রং পাল্টায়। ভালোবাসা শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে নয়,
ভাই-ভাইয়ে, ভাই-বোনে, বাবা-মা ও সন্তানদের মাঝে, বন্ধু-বন্ধুতে এমনকি পোষা
প্রাণীর জন্য ভালোবাসা জন্ম নেয়। অনেকে আবার প্রকৃতিকে ভালোবেসে উদাস বাউল
হয়ে যান। সম্পর্কের প্রকৃতির সাথে ভালোবাসার প্রকৃতি তথা গভীরতা উঠা নামা
করে। আসলে যে ভালোবাসাতে যানে তার কাছে সম্পর্কের প্রকৃতি গৌন হয়ে পড়ে।
নতুবা ভালোবেসে সমাজ, রাষ্ট্রকে রাঙিয়ে দেয়ার জন্য যারা উদার হয়ে কাজ করেন
তাদের কোন কিছুই আটকে রাখতে পারে না। দার্শনিক টমাস ফুলার বলেছেন ভালোবাসা
পাওয়ার চাইতে ভালোবাসা দেয়াতেই বেশী আনন্দ। তাই ভালোবাসা দেয়া এবং নেয়ার
বন্ধন। তবে ফ্রাংকলিন পি জোনস যেমনটি বলেছেন ভালোবাসা হলো সেটাই যা জীবন
নামক যাত্রাকে অর্থবহ করে তোলে। আসলেই তাই মানুষ মাত্রই তার জীবনকে অর্থবহ
করে তুলতে চায় আর ভালোবাসার মাধ্যমেই তা সম্ভব। সৃষ্টির শুরুই ভালোবাসা
থেকে আর যা নিরবধি বয়ে চলেছে এখনও, থাকবে পৃথিবী ধ্বংসের শেষদিন পর্যন্ত।
প্রেমকে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয়ই বলে মনে করা হয়। এর ভাল দিকের মধ্যে
রয়েছে, এটি মানুষের মনে দয়া, সমবেদনা এবং স্নেহ- অন্যের ভালোর জন্য
নিঃস্বার্থভাবে এবং পরোপকার কাজের প্রেরণা জোগায়। এর খারাপ দিক হলো এটি
মানুষের মাঝে সার্থপরতা ও অহংকারের জন্ম দেয়।
প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা
প্রেমের ছয়টি রূপ শনাক্ত করেছিলেন: পারিবারিক প্রেম, বন্ধুত্বপূর্ণ প্রেম,
রোমান্টিক প্রেম, আত্ম-প্রেম, অতিথি প্রেম এবং ঐশ্বরিক বা নিঃশর্ত প্রেম।
আধুনিক লেখকরা প্রেমকে বৈচিত্রের ভিত্তিতে আলাদা করেছেন: অপ্রত্যাশিত
প্রেম, সহচর প্রেম, পরিপূর্ণ প্রেম , মুগ্ধ প্রেম, দরবারী প্রেম। প্রেমকে
কোন কোন দার্শনিক "অন্যের মঙ্গল কামনা" হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, কেউ কেউ
বলেছেন প্রেম মানে হলো "অন্যের সুখে আনন্দিত হওয়া।" দার্শনীক রাসেল প্রেমকে
আপেক্ষিক মূল্যের বিপরীতে "পরম মূল্য" এর শর্ত হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
বছর
ঘুরে আবার ফেব্রুয়ারী মাস এসেছে। এসেছে ভালোবাসা প্রকাশের উপলক্ষ। এ মাসে
১৪ ফেব্রুয়ারী ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে তা উদ্যাপনের জন্য চারদিকে হাঁকডাক পড়ে
যায়। সব ধরণের মিডিয়ার পাশাপাশি পোস্টার ব্যানারে ১৪ ফেব্রুয়ারী ভালোবাসা
দিবস উপলক্ষে প্রিয়জনকে ভালোবাসা জানাতে কি কি ধরণের আয়োজন বা ব্যবস্থা করা
হচ্ছে তার জানান দিতে থাকে।
ভালোবাসা দিবসে অর্থনীতিক দিকও রয়েছে।
ভ্যালেনটাইনস ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুন তথা বসন্ত উৎসব
দুটোই আমাদের মনে রং ছড়ায়। সাধের সঙ্গে সাধ্যের মিল রেখে আমরা যে যার মতো
কেনাকাটা করি, কিছু নিজের জন্য আর কিছু প্রিয়জনদের জন্য। প্রতিবছরই এ দুটি
দিবসে দেশের অর্থনীতিতে বাড়তি মূল্য সংযোজন হয়। ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র
করে অর্থনীতিতে একধরণের গতি আসে। একে কেন্দ্র করে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার
ঘটে। কেননা উপহার বিনিময়, পছন্দের পোষাক পরিধান, ভালো খাওয়া দাওয়ার আয়োজন,
বিনোদন কেন্দ্রে গমন, মুভি দেখা, বই বিনিময়, ছবি তোলা, টিভিতে বিভিন্ন
অনুষ্ঠান মালার আয়োজন, বিশেষ ম্যাগাজিন কেনাবেচা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে
অর্থনীতিতে আর্থিক লেনদেন বাড়ে-জিডিপিতে মূল্য সংযোজন হয়। ভালোবাসা দিবস
উপলক্ষ্যে কেনাকাটা সব যে নিজের জন্য তা নয়। পরিবারের অনন্য সদস্যদের জন্য,
বন্ধুদের জন্য, প্রিয় মানুষের জন্য, বাবা মায়ের জন্যেও অনেকে কেনাকাটা করে
থাকে। এ সব কেনাকাটার মাধ্যমে অর্থনীতিতে গতি আসে, মূল্য সংযোজন হয়।
ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে ‘ভালোবাসার অর্থনীতি’র (লাভ ইকোনমি)
আকার বড় হচ্ছে।
আমাদের দেশে “ভালোবাসা দিবস”কে কেন্দ্র করে যে ফুলের
ব্যবসা হয় তা প্রায় ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশে এ সময়টায় পুরো মাস
জুড়ে ‘একুশের বই মেলা’ আয়োজিত হয়। বই ভালোবাসা দিবসের উপহার হিসেবে একটি
বড় স্থান দখল করে থাকে। তাছাড়া ফ্যাশন হাউজগুলোতে এ দিনকে কেন্দ্র করে নতুন
ডিজাইনের পোষাক বিক্রি বাড়ে। বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে মানুষ তার প্রিয়জনকে
নিয়ে ভিড় জমায়। অনেকে প্রিয়জনকে নিয়ে কফিশপ, ফাস্টফুড খাবার দোকানে ভিড়
জমায়। বড় বড় হোটেল ও খোলা জায়গায় ওপেন এয়ার কর্নসাট আয়োজন করা হয়। সেখান
থেকেও অর্থনীতিতে অর্থ যোগ হয়। সব মিলিয়ে এ সময় বেশ বড় রকমের একটা আর্থিক
লেনদেন ঘটে থাকে। এ দিবসকে কেন্দ্র করে ছোট ছোট ব্যবসায়ীর প্রসার ঘটে।
একটা
জরিপে দেখা গেছে ২০২৪ সালে উন্নত দেশে এ সময় যে সকল জিনিসগুলোর বিক্রি
বেড়েছিল সেগুলো হলো চকলেট, ভালোবাসার কার্ড, ফুল, বৈকালিক ভ্রমন ও বিনোদন,
গহনা ও জুয়েলারী, কাপড় চোপড়, বিভিন্ন উপহার ইত্যাদি। গড়ে সে সময় উন্নত দেশে
ভোক্তা প্রতি প্রায় ১৮০.৮১ ডলারের মতো খরচ করা হয়েছে।
তাই বিশ্ব
ভালোবাসা দিবস কিন্তু শুধু ভালোবাসার আবীর ছড়িয়েই শেষ হচ্ছে না- দেশের
অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতেও ভূমিকা রাখছে। তাই বলি ভালোবাসা বেঁচে থাক।
ভালোবাসার বিস্তৃতি ঘটুক প্রিয় মানুষের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য
সর্বোপরি রাষ্ট্রের জন্য। দিন শেষে সব না পাওয়ার হতাশাকে পাশ কাটিয়ে
ভালোবাসার ভাল লাগার অনুভূতি জড়িয়ে প্রিয় মানুষগুলো আগামী ভোরের জন্য
অপেক্ষা করুক।
লেখকঃ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।