আমাদের
সময়ে বই, খেলাধুলা আর টেলিভিশন ছিল আমাদের বিনোদনের পথ। বর্তমান সময়ের মতো
এত বেশি মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, তথ্য প্রযুক্তির সেবা তখনকার সময়ে ছিল না।
ছিল বন্ধু বান্ধব মিলে ঘুরাফেরা, সহপাঠীদের মধ্যে খেলাধুলা, আড্ডা আর
বইয়ের বিনিময়। তখনকার সময়ে একজনের বই কয়েকজনে পড়তাম, এমনি বাজারে পুরাতন বই
বিক্রয় হত। আমি যখন ১৯৯৫ সালে সপ্তম শ্রেণিতে উঠি তখন আমার এলাকার
দুলালপুর বাজার থেকে সপ্তম শ্রেণির পুরাতন একসেট বই ক্রয় করি মাত্র ১১০
টাকা দিয়ে, তবে কিনার জন্য বাজারের খাজনা দিতে হয়েছে ৫ টাকা। তখন জানুয়ারি
মাসব্যাপি বাজারে নিদিষ্ট স্থানে বই বিক্রির বাজার বসতো।
বইগুলো বাসায়
এনে দেখি প্রায় বইয়ে দুইজনের নাম লেখা, এতে বুঝা যায় এর মধ্যে বইগুলো দুইজন
পড়েছেন, কয়েকটি বইয়ের কিছু পাতা ছেড়া ছিল, ইংরেজি গ্রামার বইয়ের কয়েটি
রচনার পাতা ছেড়া ছিল। ঐ সময়ে মাধ্যমিকে সরকারিভাবে বই ফ্রি দেওয়া হতো না,
সবাই বই কিনে পড়তে হতো। বর্তমানে প্রতি বছরই সরকার নতুন বই দেয়। ঐ সময়ে
নতুন কিনতে পারলে অনেক আনন্দ পেতাম, নতুন বইয়ে ঘ্রান নিতাম, নতুন বইয়ের
ঘ্রান একটা অনন্য অনুভুতি দিত।
আমরা পাঠ্য বইয়ের পাপাশাশি পড়তাম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, আনিসুল হক, জাফর ইকবাল, হুমায়ূন
আহমেদসহ আরো অনেকের গল্প-উপন্যাস আর কবিতার বই। থাকত অনেক গোয়েন্দা আর
থ্রিলার সিরিজ। আমরা ম্যাকাইভারের মেধা দেখে মুগ্ধ হতাম, সিন্দবাদের
অভিযানে শিহরিত হতাম, টম অ্যান্ড জেরি দেখে প্রান ভরে হাসতাম।
বর্তমানে
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ক্রেস্ট বা সম্মাননা স্মারক উপহার দেওয়ার প্রচলন
ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এটি এক ধরনের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, যা অনেক
ক্ষেত্রেই তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে না। বরং, এর পরিবর্তে যদি বই
উপহার দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তাহলে তা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও শিক্ষামূলক
দিক থেকে অনেক বেশি উপকারি হবে। ক্রেস্ট তৈরিতে যে ধাতু, কাচ বা
প্লাস্টিকের ব্যবহার হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অন্যদিকে, বই
কাগজ দিয়ে তৈরি হলেও এটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং জ্ঞান বৃদ্ধির অন্যতম
মাধ্যম।
এক-একটি বই, এক-একজন জ্ঞানী-গুণী মানুষের নীরব ভাষা।
জ্ঞানী-গুণী মানুষের চিন্তার ফসল। বই পাঠকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। প্রকৃত
পাঠকরা বই পাঠে সুখ উপভোগ করে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বই পড়ার
প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বই শুধু জ্ঞানের পরিধি বাড়ায় না, বরং বুদ্ধিমত্তা,
চিন্তাশক্তি এবং সৃজনশীলতাও বৃদ্ধি করে। পাঠ্যবই ছাড়াও অতিরিক্ত বই পড়লে
তাদের সাধারণ জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি পায়। বই পড়ার ফলে শিক্ষার্থীদের
শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয় এবং তারা সুন্দরভাবে কথা বলতে ও লিখতে শিখে, তথা
ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি।
বই শিক্ষার্থীদের ধৈয্যশীল ও মনোযোগী হতে
সাহায্য করে, যা পড়াশোনায় ভালো ফলাফল অর্জনে সহায়ক। সাহিত্য, কল্পকাহিনি বা
বিজ্ঞানভিত্তিক বই পড়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তি
বৃদ্ধি পায়। এটি তাদের নতুন চিন্তাধারা গঠনে সহায়তা করে। ধর্ম ও নৈতিক
শিক্ষা বিষয়ক বই পড়লে শিক্ষার্থীরা মূল্যবোধ সম্পর্কে জানতে পারে এবং
নৈতিকভাবে সুস্থ জীবনযাপন করতে উদ্বুদ্ধ হয়। বই পড়া শিক্ষার্থীদের মানসিক
চাপ কমাতে ও প্রশান্তি দিতে সাহায্য করে। জ্ঞানের জগৎকে প্রসারিত করে এবং
ভবিষ্যতে সফল হতে সাহায্য করে।
বই উপহার দেওয়া মানে হলো একজন ব্যক্তিকে
নতুন কিছু শেখার সুযোগ করে দেওয়া। একটি ভালো বই মানুষকে আলোকিত করতে পারে,
তার চিন্তাভাবনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। ক্রেস্ট শুধু প্রদর্শনের
জন্য থাকে, কিন্তু একটি ভালো বই জীবনকে বদলে দিতে পারে।
ইতিহাস,
বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন বা আত্মউন্নয়নমূলক বই পড়ার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি
নতুনভাবে চিন্তা করতে শেখে । বইয়ের মাধ্যমে একজন মানুষ নৈতিক শিক্ষা ও
মূল্যবোধ সম্পর্কে জানতে পারে। ধর্মীয় বই, গল্প-উপন্যাস, অনুপ্রেরণামূলক বই
একজন মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করে।
বই শুধু উপহার নয়,
এটি একটি জ্ঞানের আলো, যা একজন মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ইতিবাচক
পরিবর্তন আনতে পারে। ক্রেস্ট হয়তো দেওয়ালে ঝুলে থাকবে, কিন্তু একটি ভালো বই
একজন ব্যক্তির চিন্তাভাবনা ও জীবনধারাকে পরিবর্তন করতে পারে।
আমরা
সবাই মিলে "ক্রেস্ট নয়, বই উপহার দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলি এবং একটি আলোকিত
সমাজ গড়ার পথে এগিয়ে যাই। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি
প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর উচিত তাদের সম্মাননা অনুষ্ঠানে বই উপহার
দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া। এছাড়াও আমরা জন্মদিন, বিয়ে, বিদায় সংবর্ধনা,
নববর্ষ, ঈদ বা পূজা-যেকোনো উৎসবে আমরা যদি বই উপহার দেওয়ার অভ্যাস গড়ে
তুলি, তাহলে এটি ধীরে ধীরে একটি সামাজিক সংস্কৃতিতে পরিণত হবে।
মানুষ
স্বভাবতই সুখ প্রত্যাশী। ভবিষ্যৎ সুখী জীবনযাপনের জন্য মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ
সময় বা জীবন গড়ার সময় হলো ছাত্রজীবন। সুখের সঙ্গে শরীর ও মনের সুসম্পর্ক
রয়েছে। এই শরীর ও মনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন শরীরচর্চা,
খেলাধুলা, শারীরিক পরিশ্রম। সুশিক্ষার অংশ হিসেবে খেলাধুলা বা ব্যায়ামের
বিকল্প নেই। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
খেলাধুলা চলে, চলুক অসুবিধা নেই।
দীর্ঘ সময় ধরে দেখতে পাচ্ছি খেলাধুলায়
বিজয়ীদের পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে প্লেট, বাটি, মগ, গ্লাস, বক্স
ইত্যাদি। ভালো ফলাফলে, বিজয়ে, সাফল্যে বা অভিবাদনে দেওয়া হচ্ছে ক্রেস্ট।
মেটাল ক্রেস্ট, ক্রেস্টাল ক্রেস্ট বা প্লাস্টিকের ক্রেস্ট, সম্মাননা
স্মারক, মেডেল ইত্যাদি, যা শো-কেসের সৌন্দর্য্য বাড়াবে। কিন্তু ক্রেস্ট কি
বইয়ের বিকল্প হতে পারে? কালের পরিবর্তনে আমাদের মন-মানসিকতার সঙ্গে রুচিরও
পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেখা দেখি বিভিন্ন কোচিং সেন্টার,
ক্লাব, ছাত্র সংগঠনগুলো ক্রেস্ট প্রদান করছে।
কোমলমতি শিক্ষার্থীদের
উন্নত চরিত্র গঠনের জন্য, ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য, আত্মবিশ্বাসী ও জ্ঞানের
তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বইয়ের বিকল্প নেই। যদি ক্রেষ্ট দেই সেই সাথে কমপক্ষে
যেন একটি বই উপহার হিসাবে যুক্ত করি। বই হোক একমাত্র সম্মাননা স্মারক ।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।