অতলান্ত
স্মৃতির ফোয়ারা বইয়ে দিয়ে সাদেক ভাই হঠাৎই পাড়ি জমালেন- না ফেরার দেশে।
তার এই শোকস্তব্ধ চলে যাওয়া প্রতিটি সহকর্মীর জন্যই বেদনা-বিধূর। অসম্ভব
কাজ-প্রিয় এই মানুষটি আর ফিরবেন নাÑ ভাবতেই গা শিহরে উঠে। কতো-শত স্মৃতি,
আড্ডা, হৈ-হুল্লোড় পেছনে ফেলে সত্যি সত্যিই তিনি চলে গেলেন! সকলের জন্য
রেখে গেলেন ক্যামেরার চোখে দেখা তার অজস্র সৃষ্টি/ শিল্প কর্ম।
কোঁকড়া
চুলের দীর্ঘদেহী সাদেক ভাইয়ের সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচয়ের দুই দশক পাড়
হয়েছে অনেক আগেই। এই সুদীর্ঘ সময়ে কতো-শত স্মৃতি জমা পড়েছে আমাদের! আদর
করতেন, ধমক দিতেন, ঠাট্টা করতেন; হঠাৎ করেই কানের কাছে ‘দম ফাটানো’ শব্দে
শীষ দিতেন। দুই কানে আঙ্গুল গুঁজে আমরা বেশুমার আনন্দে মেতে উঠতাম।
অদম্য
পরিশ্রমী সাদেক ভাইকে গণমাধ্যমকেন্দ্রীক কোনো কাজেই দমিয়ে রাখা যেতো না।
ছবি তোলার জন্য তিনি যে কতো-শত মাইল পথ পাড়ি দিয়েছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
প্রকৃতি ভীষণ টানতো তাকে। একটা পাখির ছবি, ফুলের ওপর বসে থাকা প্রজাপতির
ছবি ফ্রেমবন্দী করতে অপেক্ষা করতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। শৈশবের দূরন্তপনা,
খেটে খাওয়া মানুষের জীবন, নৈসর্গিক কুমিল্লার প্রকৃতি ও পরিবেশÑ সবকিছুই
দারুণ শৈল্পিকভাবে ফুটে উঠতো তাঁর ক্যামেরায়। মাঝে মাঝে এসব নিয়ে গল্প
বলতেন আমাদের। একবার মুন্সিগঞ্জের আলু ক্ষেতের ছবি তোলার সময় ঘটে যাওয়া
নাতিদীর্ঘ এক গল্প বলতে বলতে হেসে লুটিয়ে পড়লেন।
এম সাদেক ছিলেন এই
শহরের একজন সাহসী আলোকচিত্রী। কুমিল্লাজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময়
বিভিন্ন গ্রুপের অস্ত্রবাজী, সংঘর্ষ কিংবা হামলা-পাল্টা হামলা চলাকালে মাঠে
বুক চিতিয়ে ছবি তুলে যেতেন তিনি। সাহসের সাথে ক্যামেরা হাতে মাঠে দাপিয়ে
বেড়ানো যে ক’জন ফটোসাংবাদিক; তাদের একজন এম সাদেক। সর্বশেষ জুলাই-আগস্টে
ছাত্র-জনতার তীব্র গণআন্দোলনের সময়েও ক্যামেরা হাতে তার সাহসিকতার চিত্র
দেখা গেছে। তার আগে-পরে কতো-শত ঘটনায় যে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি
তার হিসেব করা মুশকিল। বিশেষ করে সাংবাদিকতার দুর্দিনে আমরা যখন
কাঁপুনি-জমা বুকে নিউজ কভারেজে যেতাম; তিনি আমাদের সাহস জোগাতেন। তাঁকে
দেখলে আমরা ভরসা পেতাম। মাঝে মাঝে তার মুখেই সাহসিকতার গল্প শুনতাম। কখনো
কখনো তা স্ব-চক্ষেও দেখতাম।
পেশাগত কাজে ফাঁকিবাজিতে ছিলেন না কখনোই।
মৃত্যুর আগমুহূর্তেও কাজেই নিমজ্জিত ছিলেন এ মানুষটি। গিয়েছিলেন গোমতী নদীর
পাড়ে মাছ শিকারের ছবি তুলতে; সেখান থেকেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। প্রথম
আলোর ওয়েবসাইটে এম সাদেকের মৃত্যুর সংবাদের সাথে একটি ছবি দিয়ে ক্যাপশনে
লেখা হয়েছে- ‘ প্রকৃতি খুব টানতো ফটো সাংবাদিক এম সাদেককে। ঋতুরাজ বসন্তের এ
দৃশ্য তিনি ক্যামেরাবন্দী করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায়। সোমবার
সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে প্রথম আলো কার্যালয়ে পাঠানো তাঁর শেষ ছবি এটি...’
কুমিল্লার
সিনিয়র ফটো সাংবাদিক এম সাদেক প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কুমিল্লা
অঞ্চলের আলোকচিত্রী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মৃত্যুর দিনেও তিনি তাঁর দায়িত্ব
পালন করে গেছেন। কাজের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও দায়িত্বশীলতার এ এক
উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে। সোমবার গোমতী নদীর তীরে পেশাগত দায়িত্ব পালনের
সময় এম সাদেক যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রথম আলো
কুমিল্লার আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা জুয়েল। তিনি জানিয়েছেন, গোমতী
নদীতে পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসব চলছে। এ উৎসবের ছবি তোলার জন্য সোমবার সকালে
এম সাদেক গোমতী নদীর পাড়ে আসেন। বেলা ১১টার দিকে তিনি হঠাৎ অসুস্থ বোধ
করছিলেন। একপর্যায়ে মাথাব্যথা ও বুকে ব্যথা অনুভব করেন তিনি। পরে তাঁকে
গোমতী নদীর চানপুর সেতুসংলগ্ন একটি দোকানে বসিয়ে প্রথম আলোর কুমিল্লা
প্রতিনিধি আবদুর রহমানকে বিষয়টি জানানো হয়। আবদুর রহমান দ্রুত
অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসে সাদেককে হাসপাতালে নিয়ে যান। বেলা দুইটার দিকে তাকে
আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়।
এম. সাদেক প্রথম আলোর আলোকচিত্রী
হলেও দৈনিক কুমিল্লার কাগজের সাথে তার ছিলো নিবিড় সম্পর্ক। তিনি ছিলেন
আমাদের-ই একজন। ছবি-সংক্রান্ত যে কোনো প্রয়োজনে যখনই ডেকেছি- সাদেক ভাই
সাড়া দিয়েছেন স্বমহিমায়। তাঁর অনেক ছবি ছাপা হয়েছে কুমিল্লার কাগজের পাতায়।
কুমিল্লার কাগজের প্রয়োজনে তাঁকে তিনি যেমন সাড়া দিতেন; কুমিল্লার কাগজকেও
তিনি পাশে পেয়েছেন যে কোনো প্রয়োজনের মুহূর্তে। দৈনিক কুমিল্লার কাগজ
সম্পাদক আবুল কাশেম হৃদয় ভাইয়ের সাথে তার ছিলো হার্দিক সম্পর্ক। তাদের
আড্ডার মুহূর্তগুলো ছিলো অনেক প্রাণবন্ত। এমন প্রাণবন্ত একটা মানুষ হঠাৎ
করেই ‘নাই’ হয়ে গেলেন। তাঁর এ চলে যাওয়া গণমাধ্যমের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
মানুষ
চলে যায়; প্রকৃতির নিয়মেই তাকে যেতে হয়...। সদ্যবিগত শবে বরাতের রাত থেকেই
আমার মনের অজান্তে মুখে একটা সুর বেজে উঠছে- ‘গুণাহ্্র বোঝা মাথা নিয়া
দেশ-বিদেশে ঘুরি; কোনদিন জানি আজরাঈলের হাতে ধরা পড়ি...।’ সাদেক ভাই
আজরাঈলের হাত ধরে বিধাতার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন পরপাড়ে। ওপাড়ে ভালো
থাকবেন সাদেক ভাই। আপনার কর্মের প্রতি আমাদের অতল শ্রদ্ধা।
লেখক ঃ জহির শান্ত
উপ-সম্পাদক ও প্রধান বার্তা সম্পাদক
দৈনিক কুমিল্লার কাগজ