ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষার চেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের জাগ্রত এক রূপ। ভাষার জন্য আন্দোলন কিংবা আন্দোলনের বিষয় ভাষা- এমন ব্যঞ্জনা বা চেতনা বিশ্বজুড়ে শুধু বাঙালি সমাজের মননে স্থান করতে পেরেছিল। মায়ের মুখের ভাষার জন্য লড়াই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই, ভাষার জন্য আত্মাহুতি, রক্তক্ষয়- এমন ধারা কোনোকালে কোনো জাতি দেখেনি। বাঙালি বীরের জাতি। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে মিথ্যার সৌধকে গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল সত্যের স্বপ্নভূমি। বাংলা ভাষার আলোকছটা বিচ্ছুরিত হয়েছিল আন্দোলনের রূপায়ণে। বাঙালির ভাষা তাই আজ বিশ্বদরবারে সম্মানের আসনে আসীন হতে পেরেছে। প্রকৃতপক্ষে বাঙালিকে ভাষা আন্দোলনই প্রেরণা জুগিয়েছিল নতুন করে মুক্ত, স্বাধীন হয়ে বাঁচার জন্য। একুশের চেতনায় বাঙালি তৎকালীন পাকিস্তানের দুঃশাসন ও শোষণ থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখে। বাংলাদেশের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জনের গুরুত্ববহ ধারাটি প্রবাহিত করে একুশ- যেটা পরবর্তীকালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বলিষ্ঠ পদক্ষেপের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়। ভাষা আন্দোলনই বাঙালি জনগণের মধ্যে বৃহত্তর পরিসরে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করে। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে তাই আমরা গর্ব ও গৌরব অনুভব করি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আজ স্বতন্ত্র ও যুগোপযোগী সমাজের চালিকাশক্তি। একুশ সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যের নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করে তুলেছে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তান সরকারের অবহেলা এ অঞ্চলের মানুষের মনে হতাশার জন্ম দেয়। সে বছর হায়দরাবাদের উর্দু সম্মেলনে বাংলাকে হেয়প্রতিপন্নের প্রচেষ্টা চলে। একই বছরের জুলাইয়ে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহম্মদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। পূর্ব বাংলায় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মাত্র ৭ শতাংশের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টা অব্যাহত থাকে। ফলে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘তমুদ্দন মজলিশ’। বাঙালি জাতির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে এ সংগঠন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত প্রকাশ করে। শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালের শেষভাগে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন হয়। কুমিল্লার গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রস্তাব করেন। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় এবং কার্জন হলের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ কিন্তু ছাত্রসমাজ তা মেনে নেয়নি। এ সময় আরবি হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্র চলে। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও জনতা আন্দোলনমুখর হয়ে পড়ে। নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ঢাকা অধিবেশনে ও পল্টন ময়দানে জিন্নাহর সুরেই কথা বলেন।
১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ধর্মঘট পালিত হয়। ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। কারাবন্দি থাকা অবস্থায় ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহম্মদ আমরণ অনশন করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে। এদিন কলা ভবনে (এখনকার ঢাকা মেডিকেল কলেজ) শিক্ষার্থীরা ১০ জন ১০ জন করে মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এগিয়ে যান। পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকে শহিদ হন। সারা দেশে ভাষা আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়। এই দিনটিকে ভাষাশহিদ দিবস বলা হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উর্দুর পাশাপাশি বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। ভাষা আন্দোলন না হলে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হতো না। একুশের এই শিক্ষাই আমাদের পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছিল। আমাদের অধিকার বিষয়ে যে সচেতনতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার যে স্পৃহা, যে সাহস- তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এনে দিয়েছে।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বর্তমানে বাংলা ভাষার স্থান পৃথিবীতে সপ্তম। এ ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪০ কোটি। আজ বাংলা ভাষাকে সম্মান দিতে পৃথিবীর সব দেশে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন শুধু বাঙালির ভাষা দিবস নয়, এটা পৃথিবীর সব দেশের জন্য মাতৃভাষা দিবস। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবেও বাংলা স্বীকৃতি প্রাপ্তির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যম ভাষা। হৃদয়ের কথা-ব্যাকুলতা জানাতে তাই ভাষার প্রয়োজন।
মাতৃভাষার মাধ্যমে সৃজনশীল জ্ঞানচর্চা করার আনন্দই আলাদা। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষাচর্চায় মাতৃভাষার গুরুত্ব ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীন, কোরিয়া, জাপান, জার্মানি, তুরস্ক, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইরান প্রভৃতি দেশ নিজের ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে বিশ্বে নিজেদের অবস্থানকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাই বাংলা ভাষা চর্চায় যেন কোনো ঘাটতি না থাকে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। কারণ ভাষার জন্যই আমরা বাঙালি আজ আত্মপরিচয়ে পরিচিত হতে পেরেছি, স্বনির্ভর হতে পেরেছি। বিশ্ববাসীকে মাতৃভাষার মর্যাদা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছি। যে ভাষার জন্য আমাদের এই সংগ্রাম ও ত্যাগ, সেই মাতৃভাষাকে সঠিক মর্যাদায় সর্বস্তরে আরও প্রচলন করতে যত্নশীল হতে হবে। বাংলা ভাষায় সমৃদ্ধ সাহিত্যাঙ্গন রয়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের জ্ঞানচর্চার বিষয়গুলো বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাদানে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নত জাতি গঠনে মাতৃভাষাচর্চা ও জাতীয়তাবাদকে গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই।
আমাদের দেশে মাতৃভাষা বাংলাকে সর্বস্তরে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা বিদেশি ভাষা চর্চা করব প্রয়োজনে; কিন্তু মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করব সবার আগে। কারণ মাতৃভাষায় যে শিক্ষা লাভ করা যায় পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় সে শিক্ষা লাভ করা যায় না। তরুণসমাজ আজ পশ্চিমা অশ্লীল সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হচ্ছে না জেনে। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও এ দেশের অধিকাংশ সাইন বোর্ড, নেমপ্লেট ও গাড়ির নম্বর ইংরেজিতেই রয়েছে। আবার বিয়ে ও জন্মদিনের কার্ডগুলোতে বাংলার অনুপস্থিতি চোখে পড়ছে। গবেষণা, জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চায় নিজের ভাষায় মানুষ উৎকর্ষে পৌঁছাতে পারে। আমাদের দেশে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ঐক্যহীনতার কারণে মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। আমাদের সংবিধানের প্রথম ভাগের ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ এর মানে সংবিধান যেদিন প্রণীত হলো, সেদিন থেকেই এ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আজও নিজের ভাষায় বিশ্বমানের জ্ঞানচর্চার উপকরণ তৈরি করতে না পারা চরম ব্যর্থতারই পরিচয়। উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়াতে একটি সামগ্রিক সামাজিক উদ্যোগ প্রয়োজন। আমাদের একটি ভাষানীতি প্রয়োজন।
আমাদের কোনো ভাষা পরিকল্পনা নেই, যা এখন অপরিহার্য। এভাবেই একদিন আমাদের ভবিষ্যতের তরুণরা তাদের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে পুরো পৃথিবীকে শাসন করতে পারবে। মা, মাতৃভাষা এবং মাতৃভূমি- এই তিনের প্রতি বাঙালির ভালোবাসা সব সময় অটুট এবং অক্ষুণ্ন থাকুক। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হোক। একুশের চেতনায় গড়ে উঠুক সুন্দর আগামী। একুশের আবেগে যেন মিশে রয়, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি?’ এ অঙ্গীকার নিয়েই যেন আমরা বাঁচতে পারি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজ