সংবাদপত্র
নাগরিক জীবনের অন্যতম অনুসংগ। ঘুম ভাঙার পর সেদিনের সংবাদপত্রটি হাতে না
আসা পর্যন্ত চায়ের কাপের আমেজ পূর্ণতা পায় না। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি
আমাদের পূর্বসুরীরা মাসিক বাজেটের কিছুটা দৈনিক সংবাদপত্র ও সাপ্তাহিক
ম্যাগাজিনের জন্য বরাদ্দ রাখতেন। দিন যায়, মাস যায়, বছর ফুরায় কিন্তু
সংবাদপত্রের চাহিদা ফুরায় না বরং বাড়ে। সকল বিবেচনায় সংবাদপত্র সমাজের
আয়না। আয়নায় যেমন নিজের চেহারা প্রতিবিম্বিত হয়, তেমনি সমাজের চিত্র ফুটে
উঠে পত্রিকার মাধ্যমে। সমকালীন বিশ্ব, দেশ, জাতি ও সমাজের চলমান ঘটনা,
জীবনযাত্রা, চিন্তাচেতনা, সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হয়। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম
হলো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার
ঘোষণাপত্রের মূল রচয়িতাদের অন্যতম জেফারসন বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি এই
বিকল্পটি দেওয়া হয় যে তুমি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন
সংবাদপত্র চাও? তখন আমি পরেরটা বেছে নেব। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট
সংবাদপত্রকে বেয়নেটের চেয়েও আক্রমনাত্বক বলে মন্তব্য করেছেন। অর্থনীতিবিদ
অমর্ত্য সেনের মতে, ‘কোনো দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ
হানা দিতে পারে না’। বিদগ্ধজনদের এসব প্রতিক্রিয়া থেকেই সংবাদপত্রের
গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
আমাদের এ ভূখণ্ডেও সংবাদপত্র বরাবর সমৃদ্ধ
আগামী বিনির্মাণে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন
থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে সংবাদপত্র জাতীয়
স্বার্থ, মানবাধিকার উন্নয়নে ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে, গণতন্ত্রকে
সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। সংবাদপত্র একটি
দেশ ও জাতিকে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ ও গণতান্ত্রিক আশা-আকাংক্ষা পূরণে
অন্যতম হাতিয়ার। সংবাদপত্র ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা গণতান্ত্রিক সমাজের
অপরিহার্য অঙ্গ। আজকে, রেডিও, টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের যুগেও প্রিন্ট
মিডিয়ার গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাফল্য-সম্ভাবনা ও
উন্নয়ন বিষয়ক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ যখন কাগজের পাতায় ছাপা হয় তা দিন, মাস, বছর,
যুগ পেরিয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। তৃণমূলের খবরা খবর পত্রিকাকে
পরিপূর্ণ করে তোলে।
সংবাদ বলতে অতীত ও বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের একগুচ্ছ
নির্বাচিত তথ্যের সমষ্টি যা যোগাযোগের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।
পরবর্তিতে এসব তথ্যের উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের পথ নকশা রচিত হয়। সেই অর্থে
সংবাদ হলো আজকের মোড়কে দেওয়া আগামী দিনের ইতিহাস। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
বলেছেন, ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে। একজন সাংবাদিকের সহজিয়া ভাষায় রচিত
তথ্যবহুল রিপোর্ট পাঠককে আকর্ষণ করে, সংবাদপত্র পঠনে মনোযোগী করে তোলে।
সংবাদপত্র এক অর্থে সমাজমনষ্ক পাঠক তৈরী করে আবার অন্যদিকে সমাজমনস্ক
পাঠকরাই হচ্ছে সংবাদপত্রের প্রাণশক্তি। সংবাদপত্র পাঠকের মনের খোরাক জোগায়,
বিবিধ বিষয়ে ধারনা দিয়ে তাঁর মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে সাধারণ পাঠককেও
সপ্রতিভ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। একজন সচেতন নাগরিক নিজের
কল্যাণ সাধনের পাশাপাশি জাতির উন্নয়ন ধারায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে।
এখানেই সংবাদপত্রের স্বার্থকতা।
সাংবাদিকাতা একটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং
পেশা এবং একই সাথে থ্যাংকলেস পেশা। রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষকে সত্য সংবাদ
প্রাপ্তির সুযোগ করে দেয়াই একজন সাংবাদিকের প্রথম দায়বদ্ধতা। যদিও এ
দায়িত্ব পালনের পথে ফুলের পাশাপাশি কাঁটাও বিছানো থাকে। কাজ করতে গিয়ে পদে
পদে ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হয়। বিশেষ করে সমাজের, রাষ্ট্রের ক্ষমতাবানদের
বিপক্ষে কোন সংবাদ প্রচারিত হলে প্রতিবেদককে অনেক দূর্ভোগ পোহাতে হয়।
সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কাজ করা যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)’র এক প্রতিবেদন মতে ২০২৪ সালে
বিশ্বের ১৮টি দেশে অন্তত ১২৪ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। যা ২০২৩ সালে ছিল
১০২ জন এবং ২০২২ সালে ছিল ৬৯ জন। সিপিজে’র আর একটি তথ্য মতে ২০২৪ সালের
ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বব্যপি ৩৬১ জন সাংবাদিক কারাগারে যেতে বাধ্য হয়েছে।
এসব পরিসংখ্যান থেকে বোঝাই যাচ্ছে সাংবাদিকতা পেশা দিন দিন কতটা বিপদজনক
হয়ে উঠছে।
অন্যান্য পেশাজীবীদের মত করে সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত বা
পারিবারিক জীবন উপভোগ করার সুযোগ হয় না। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, মহামারি,
যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদির যে কোনটিতেই অন্যরা যখন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান,
সাংবাদিকরা তখন তাদের পেশার দায়বদ্ধতার কারণে এ ঘটনাগুলোর মুখোমুখি হয়ে তার
পাঠকদেরকে সর্বশেষ সংবাদটুকু পৌছে দেয়ার চেষ্টা করেন। ২০২০-২১ এর সারা
বিশ্বব্যাপি কোভিড মহামারি চলাকালিন সময়ও প্রয়োজনীয় সংবাদ সংগ্রহ ও সরবরাহে
সাংবাদিকরা ব্যস্ত ছিলেন। ২০২৪ সালে কুমিল্লা ও ফেনী অঞ্চলের আকস্মিক
বন্যার সময় আমরা দেখেছি আমাদের এ জেলা সাংবাদিকরা বিপদসংকুল অবস্থায়ও
আন্তরিকভাবে দূর্যোগ কবলিত মানুষের খবরাখবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তুলে
ধরেছেন। এতে অনেক সাংবাদিকের জীবনও বিপর্যস্ত হয়েছে।
ঢাকার বাইরে
জেলা/উপজেলা পর্যায়ে মফস্বল সাংবাদিকরা সারাদিন সংবাদ সংগ্রহের জন্য
জেলা-উপজেলা প্রশাসন, কোট-কাচারি, থানা, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বিভিন্ন
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, প্রান্তিক মানুষের দ্বারে দ্বারে দৌড়াতে
থাকেন। পাঠকদের কাছে সর্বশেষ তরতাজা সংবাদটি পৌছে দিতে গিয়ে মফস্বল
সাংবাদিকরা প্রায়শই অনাকাঙ্খিত অবস্থার মুখোমুখি হন। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে
অনেক সময় খবরের মানুষটি নিজেই খবর হয়ে যান। এ প্রসংগে আমাদের কুমিল্লার এক
সময়কার মেধাবী সাংবাদিক নওশাদ কবির ভাইয়ের কথা খুব বেশি মনে পড়ে। যিনি
খবরের উৎস সন্ধানে গিয়ে বিভৎস সড়ক দূর্ঘটনার মুখোমুখি হয়ে নিজেই
সংবাদপত্রের খবর হয়ে গেছেন। এত এত যারা দিনরাত পরিশ্রম করেন সেই
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আরো কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন। সংবাদপত্র
শিল্পে যে বেতন কাঠামো তা একজন সাংবাদিককে দৈনন্দিন জীবন যাপন ব্যয় মেটানোর
জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবুও সাংবাদিকরা নিজের পেটে ক্ষুধা রেখে অন্যের
অপ্রাপ্তির বিষয়গুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করার জন্য প্রাণান্ত
চেষ্টা চালিয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ফটোসাংবাদিক প্রিয় সাদেক ভাই আমাদের
ছেড়ে অনন্তলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। উনার পরিবারের আর্থিক দূরাবস্থা
কথা যা আমরা জানতে পেরেছি, তা মেনে নেয়া সত্যিই অনেক কষ্টকর। একজন সাংবাদিক
কোন বিশেষ পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের পাশে দাড়াঁনোর
একটি আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থার রূপরেখা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে
একটি মানসম্পন্ন জীবনযাত্রা নিশ্চিত করার উপযোগী সম্মাননা প্রাপ্তির অধিকার
সাংবাদিকদের রয়েছে। তাছাড়া সময় সময় সাংবাদিকদের নতুন ধরণার সাথে পরিচিত
করার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাটাও জরুরী। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা
যায় যে, অনেক প্রতিকূলতা থাকলেও মফস্বল তথা ঢাকার বাইরে সাংবাদিকরা
সংবাদপত্র শিল্পে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছেন। ঢাকার বাইরের
সাংবাদিকদের উপর ভর করে জেলা/উপজেলা পর্যায়ের পত্রিকাগুলো যেমন চলছে তেমনি
রাজধানীর জাতীয় পত্রিকাগুলো তাঁর একটা বড় খবরের সোর্স হিসেবে মফস্বল
সাংবাদিকদের উপর নির্ভর করছেন।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার বাড়ছে। সেই সাথে
তাল মিলিয়ে সংবাদপত্রও বাড়ছে (অনলাই/অফলাইন)। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বরের
হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের নিবন্ধিত পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৩২১০টি (অনলাইন
গণমাধ্যম ব্যতিত)। এর মধ্যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা ছিল ১৩৫৭টি
এবং ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলা থেকে বাদবাকি ১৮৫৩টি পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
পাঠকের সামনে এখন সংবাদ পাঠের মাধ্যম সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। সংবাদপত্রও বাড়ছে
তবে সে অনুপাতে সংবাদপত্রের পাঠকের সংখ্যা বাড়ছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
তবে সংবাদপত্রের গুরুত্ব দিন দিন বেড়ে চলেছে। কিছু কিছু সংবাদপত্র সংবাদের
গুণগত মান ও উপস্থাপনার কারণে পাঠকের মন জয় করতে পারছে, কোন কোনটা
প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ঝড়ে পড়ছে। ঢাকার বাইরে জেলা/উপজেলা পর্যায়ে
বিজ্ঞাপনের অভাবে সংবাদপত্র প্রকাশ করা ও চালিয়ে নেওয়া খুবই চ্যালেঞ্জিং
একটি বিষয়।
একটি মানসম্মত সংবাদপত্র ও দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ একজন দক্ষ ও
বিচক্ষণ সাংবাদিক দেশ ও জাতি গঠনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাই
মানসম্মত পত্রিকা প্রকাশিত হউক, সমাজকে আলোকিত করুক, দেশের উন্নয়ন যাত্রার
সারথী হউক। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনা এবং অন্যয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি
ভূমিকা রেখে পজেটিভ খবর প্রকাশনার মাধ্যমে তরুণ-যুব সমাজকে দেশপ্রেমে
উদ্বুদ্ধ করুক, বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যে মেলবন্ধন গড়ে তুলতে
ভূমিকা রাখুক, পৃথিবীকে সতেজ করে তুলুক।
লেখকঃ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।