পঞ্চম
শ্রেণিতে থাকতে মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন নাছিমা খানম।
দাম্পত্যের পাঁচ বছরের মাথায় র্দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন স্বামী। তখন তিনি
তিন সন্তানের জননী। গর্ভে অনাগত আরেক সন্তান। জীবনে এক ধরনের অনিশ্চয়তায়
পড়েন। জীবিকা নির্বাহ নিয়ে দিশে হারা। শিশু সন্তানদের খাবার জোগাতে এক সময়
নিজের শরীরের রক্ত বিক্রয় করতেন। বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। সন্তানদের ভাত
খাইয়ে নিজে খেতেন ভাতের মার। তবে সেই নাছিমা খানমের দিন ফিরেছে। একশ’ টাকা
নিয়ে শহরে আসা এই সংগ্রামী নারী এখন কোটিপতি। যুব উন্নয়ন থেকে সেলাইয়ের কাজ
শিখে এখন প্রতিষ্ঠিত নারী উদ্যেক্তা। বর্তমানে তার চারটি ব্যবসা
প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ৩০ জন কর্মী। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জাতীয়
যুব পুরস্কারসহ বিভিন্ন সন্মাননা।
সম্প্রতি কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুর
হাজী প্লাজার দ্বিতীয় তলায় জুলি লেডিস টেইলার্সে গিয়ে কথা হয় নাছিমা খানমের
সাথে। তার জীবনের বাকে বাকে ঘটে যাওয়া কষ্টের সময়গুলো বর্ণনা করে
অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। ১৭ বছর বয়সে চার সন্তান রেখে স্বামীর মৃত্যু, শ^শুর
বাড়ির লোকজনের অবহেলা ও বাবার বাড়ির আর্থিক টানাপোড়েনে এক সময় হাল ছেড়ে
দিতে চেয়েছিলেন। তারপরও সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের চাওয়া-পাওয়াকে
বিসর্জন দিয়েছেন। তার ভাষ্যমতে ১৯৬৯ সালে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার
ইলিয়টগঞ্জ উত্তর ইউনিয়ের গোবিন্দপুড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা খলিল
খান মহান মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফেরেন নি। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন
দ্বিতীয়। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ১৯৮৩ সালে বিয়ে হয় পার্শ¦বর্তী
সিংগুলা গ্রামের মতিউর রহমান প্রধানের সাথে। ১৯৮৮ সালে জমি নিয়ে বিরোধে
বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে স্বামী মতিউর রহমানকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই সময়ে
সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন নাছিমা। বড় ছেলে মো. মাছুম রানা প্রধানের বয়স
৫ বছর, মেজো ছেলে মাছুদ রানার বয়স ৪ আর ছোট ছেলে মামুন রানার বয়স ছিলো এক
বছর।
স্বামী মারা যাওয়ার পর ঠাঁই হয়নি শ্বশুরবাড়িতে। সন্তানদের নিয়ে
আশ্রয় নিলেন বাবার বাড়িতে। এরই মধ্যে ভুমিষ্ঠ হয় চার নম্বর সন্তানের। অভাব
অনটনে সেখানে থাকাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। দুই বছর পর সেখানে থাকাও থাকা
অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যোগাযোগ করেন কুমিল্লা নগরীতে বসবাসকারী মাজেদা বেগম
নামের দূরসম্পর্কের এক খালার সঙ্গে।
তারই পরামর্শে বাবার বাড়ি থেকে ১৯৯০
সালের একদিন রওয়ানা দেন কুমিল্লা শহরের উদ্দেশ্যে। ওই সময় তার কাছে ছিলো
মাত্র ১০০ টাকা। এর মধ্যে বাড়ি থেকে মালামাল আনতে ট্রাক ভাড়ায় খরচ হয় ৫০
টাকা। বাকি ৫০ টাকা নিয়ে মাজেদা খালার ঠিক করে দেয়া কুমিল্লা হাউজিং স্টেটে
ছোট্ট একটি বাসায় ওঠেন চার সন্তান নিয়ে। সেখান থেকেই শুরু হয় তার জীবন
সংগ্রামের দ্বিতীয় অধ্যায়। সন্তানদের স্কুলে ভর্তি ও খাবার যোগার করতে
বিক্রি করেছেন শরীরের রক্ত। প্রতি ব্যাগ রক্ত বিক্রি করতেন ২০০ টাকায়। এর
মধ্যে ১৫ থেকে ১৬ ব্যাগ রক্ত বিক্রি করেন তিনি। চার ছেলের মধ্যে দুই জনকে
এইচএসসি আর এক ছেলেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়েছেন। তবে বিভিন্ন
সীমাবদ্ধতার কারণে লেখাপড়ায় তারা আর বেশি দূর এগুতে পারেননি। এরই মধ্যে সড়ক
দুর্ঘটনায় নাছিমার ১০ বছর বয়সী একটি ছেলের মৃত্যু হয়।
এর কিছু দিন
কুমিল্লা মেডিকেলের সহকারী হিসেবে অস্থায়ীভাবে কাজ করেন নাছিমা খানম।
সেখানে সীমিত আয় দিয়ে চার সন্তানের ভরণ-পোষণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। পর্যায়ক্রমে
নগরীর ঠাকুরপাড়ায় যুব উন্নয়ন থেকে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে বাসায় বসে শুরু
করেন সেলাইয়ের কাজ। অবশ্য প্রথম দিকে তেমন কাজ পেতেন না। তবে পরবর্তীতে
তার কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়লে কাজের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। এ কাজে তাকে সহযোগিতা
করতেন বড় ছেলে মাছুম রানা। বিরামহীন পরিশ্রম করছেন মা ছেলে।
কাজের
মধ্যেই পরিচয় হয় এক নারী সেনা কর্মকর্তার সাথে। নাছিমাকে একটি ব্লাউজ সেলাই
করতে দেন। ডেলিভারি দেয়া সেই ব্লাউজটি পছন্দ হয় ওই নারীর। পরবর্তীতে তাকে
টেইলার্সের দোকান দিতে উৎসাহ দেন। সে অনুযায়ী ছেলেদের সাথে পরামর্শ করে
দোকান দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এক পর্যায়ে কুমিল্লা নিউ মার্কেটে আমিন
টেইলার্স নামে একটি দোকানের সাটার বন্ধ দেখেন। খোঁজ নিয়ে দোকানের মালিক
অধ্যাপক আমিনুল ইসলামের বাসায় যান মা-ছেলে। তাদের দুঃখের কথা শুনে কোনো
অগ্রিম ছাড়াই দোকানের চাবি দিয়ে দেন নাছিমার হাতে। সেখানে আগে থেকেই মেশিন ও
কাটিং টেবিল থাকায় মাত্র একটি কাঁচি আর ফিতা নিয়ে শুরু হয় নাছিমার নতুন
অধ্যায়। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দিন যতো যায় তার কাজের পরিধি
বাড়তে থাকে। কারণ ওই সময় শহরের একমাত্র নারী দর্জি ছিলেন নাছিমা খানম।
বর্তমানে নগরীর মনোহরপুর হাজি প্লাজার দ্বিতীয় তলায় একটি ও রেসকোর্স এলাকার
ইস্টার্ন ইয়াকুব প্লাজায় আরও দুইটি টেইলার্সের দোকান আছে তার। রয়েছে একটি
থান কাপড়ের দোকান। সেগুলো পরিচালনা করেন তার তিন ছেলে। মনোহরপুরে জুলি
টেইলার্সটিতে তিনি নিজেই বসেন। এখানে রয়েছেন ১০ জন কর্মী। আর রেইসকোর্সের
তিনটি দোকান ও কারখানায় রয়েছেন আরও ২০ জন কর্মী।
মূলত মনোহরপুরের
দোকানটির আয় থেকেই কুমিল্লা শহর ও গ্রামের বাড়িতে জমি কিনেছেন নাছিমা।
বর্তমানে তার দেড় কোটিরও বেশি টাকার সম্পদ রয়েছে। অবশ্য শুকরিয়া স্বরূপ
আয়ের একটি অংশ মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা ও অস্বচ্ছলদের দান করেন। ২৫০ জনের
বেশি বেকার নারীকে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তারাও এখন আত্মনির্ভরশীল।
নাছিমা
খানম জানান সন্তানদের নিয়ে সংগ্রামী জীবন বিববেচনায় ২০২৩ সালে ’তরী’
সামাজিক বুনন নামে বেসরকারি একটি সংস্থার পক্ষ থেকে কীর্তিমান মা সন্মাননা
পুরস্কার পেয়েছেন। আর শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা হিসেবে ২০০১ সালের ১ ডিসেম্বর যুব ও
ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পেয়েছেন জাতীয় যুব পুরস্কার। এছাড়াও
ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনও তাকে পুরস্কৃত করেছে। নাছিমা মনে
করেন পরিশ্রম, সততা ও একাগ্রতার থাকলে মানুষের সাফল্য কেউ ঠোকাতে পারে না।
কুমিল্লার
তরী সামাজিক বুননের সমন্বয়ক রেজবাউল হক রানা বলেন, জীবনে নানা
প্রতিবন্ধকতা থাকবেই। তবে পরিশ্রম, সততা ও একাগ্রতা থাকলে মানুষের সাফল্য
কেউ ঠেকাতে পারে না। এগিয়ে যান বহু দূরে। আর সেটাই প্রমাণ করলেন কীর্তিমান
মা খেতাবপ্রাপ্ত কুমিল্লার নাছিমা খানম। এ নাছিমা খানমরাই সমাজের এক একটি
উদাহরণ।