গদ্যভাষার
বৈষম্যটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। সমাজের এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে
অসাম্য নেই এবং যেখানে সেই অসাম্যের কমতির পরিবর্তে বাড়তি পাওয়া সম্ভব হয়।
এই যে একটা দূরত্ব, এর পরেই আসে সাধু ও চলতির ব্যবধান। সম্প্রতি সরকারি
নির্দেশ এসেছে অফিস-আদালতে সাধু ভাষাই চলবে, চলতি ভাষা চলবে না। সাধু ভাষা
নিজেকে সাধু বলেই জানে, চলতিকে সে সব সময়েই ধমকের ওপর রাখে, এখন তো আরও
জোরে ধমক দেবে, পেয়ে গেছে সরকারি সমর্থন। চলতি বোধ করি আরও ধীরে ধীরে চলবে।
আসলে
ভাষার ব্যবধান ভাষাতাত্ত্বিক কারণে তো ঘটে না, ঘটে সমাজতাত্ত্বিক কারণেই।
স্বাধীন, জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশে আজ ইংরেজি চলছে, বাংলা চলছে, আরবিও চলছে,
এবং মধ্যপ্রাচ্যের বস্তুগত আকর্ষণে, জনপ্রিয় হচ্ছে। এর ওপর আবার বাংলাও দুই
প্রকারের হয়ে দাঁড়াবে বটে সাধু ও চলতি। এসব কিছুর উদ্ভব পরিষ্কারভাবে বলা
যায়, সামাজিক বৈষম্য থেকেই। বস্তুত, সামাজিক বৈষম্যই গদ্যের এক নম্বর
শত্রু। কেমন করে চলে এর শত্রুতা? সে তো মোটেই অস্পষ্ট নয়। প্রথম কথা, এই
বৈষম্যই মানুষে মানুষে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে, বাধা দিচ্ছে যোগাযোগে, ব্যাহত
করছে আদান-প্রদান। মস্ত এক পরিখা কাটা আছে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত লোকদের
মাঝখানে। কুকরা বাইশজন লোক অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, শিক্ষিত আরও কম। বই পড়ে এর
সামান্য ভগ্নাংশ।
অধিকাংশ লোক লেখাপড়া করে আর যাতে লেখাপড়া না করতে হয়
তার জন্য। ‘লেখাপড়া করে যেই গাড়িঘোড়া চড়ে সেই’ আমাদের এই দেশে লেখাপড়ায়
উদ্বুদ্ধ করার জন্য এর চেয়ে মহৎ কোনো স্লোগান উদ্ভব সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই
স্লোগানেও কুলাচ্ছে না আর। লেখাপড়া কম করেও বড় বড় গাড়িতে চড়া যায়। যাচ্ছে
আজকাল। বেশি লেখাপড়াওয়ালারাই বরঞ্চ খাবি খাচ্ছে। কিন্তু দেশের কুকরা
আশিজনের মতো লোক যে এমনকি অক্ষরজ্ঞানও পায়নি, তারা গদ্য পড়বে কোন পথে?
কাজেই একদিকে দেখছি, অধিকাংশ লোকই গদ্য পাঠের সুযোগবঞ্চিত। অন্যদিকে দেখছি,
অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন লোকেরও সাধ্য নেই বই কেনার, বা সাধ্য থাকলেও সাধ নেই
পড়ার- নিতান্ত বস্তুগত কারণেই। ইংরেজি সংবাদপত্রের মতো ইংরেজি বইয়েরও
মর্যাদা অধিক, সেও ওই সামাজিক, অর্থনৈতিক কারণেই। কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা
বাড়ছে, দাপট বাড়ছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো আরও ম্রিয়মাণ, আরও বেশি জবুথবু
হয়ে পড়ছে। আমাদের সামাজিক বীরদের মুখের বুলি বাংলা নয়, ইংরেজিই। তারা
বিদেশি দ্রব্যে শোভিত, মন ও মেধা তাদের বিদেশমুখো, দেশে থাকেন বাধ্য হয়ে
এবং অনিচ্ছায়, বিদেশিদের মতো। সবটা মিলিয়ে সত্য একটাই, মানুষে মানুষে
বিচ্ছিন্নতা। বিচ্ছিন্নতা ধনী-দরিদ্রে, দরিদ্রে-দরিদ্রে, এবং ধনীতে-ধনীতে।
বাংলাদেশে আজ সমাজ আছে, আনুষ্ঠানিকতার অর্থে সামাজিকতাও আছে কিন্তু
আন্তরিকতার অর্থে সামাজিক সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ অভাব মানুষে মানুষে
যোগাযোগের। যোগাযোগের ফসল হচ্ছে গদ্যভাষা।
অথচ শত্রু ছিল যে ইংরেজ, সেই
ইংরেজ শাসনেরই একটি ফসল তো বাংলা গদ্য। কবিতার ক্ষেত্রে আমাদের ঐতিহ্য
হাজার বছরের, কিন্তু গদ্যের ঐতিহ্য টেনে বাড়ালেও ২০০ বছরের সীমানা পার হয়
না। এর কারণটা সহজ। কবিতা সংগঠিত সামাজিক জীবনের অভাব থাকলেও রচিত হতে
পারে, যেভাবে গান রচিত হয়। কিন্তু গদ্যে যদিও নেই। রাস্তার গাড়িতে গাড়িতে
যে তফাৎ, যেকোনো স্টেশনে মানুষে মানুষে, জামাকাপড়ে যে ব্যবধান, তারই সঙ্গে
ছন্দ মিলিয়ে এবং বস্তুত তারই দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে একই নিউজপ্রিন্টে ছাপা
একই হকারের হাত দিয়ে বিতরিত জাতীয় সংবাদপত্র বিভিন্ন রকমের গদ্য ব্যবহার
করছে। একেক রকম গাড়ির যেমন একেক প্রকার গতি, গন্তব্য ও যাত্রী, সংবাদপত্রের
বেলাতেও তাই।
শকটে-সংবাদপত্রে সাদৃশ্যটা বোধ করি কাল্পনিক নয়। দুটোই
পরিবহনকারী এবং দুটোই চলে। আর ওই চলমানতা ও তার আবশ্যকতা থেকেই গদ্যের
আবির্ভাব। গদ্য হচ্ছে সামাজিকতার ভাষা। মানুষ মানুষের কাছে যেতে চায়, সেই
গতিতেই, সেই যাওয়াতেই গদ্য এসেছে। গদ্য সামাজিকতার সৃষ্টি; গদ্য আবার
সামাজিকতারই প্রতিফলন। সামাজিক যোগাযোগ যতটা ব্যাপক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ,
লেনদেন যতটা গভীর ও আন্তরিকতা-ঋদ্ধ গদ্যও ততটাই সমৃদ্ধ। সে দেয়, এবং নেয়।
শকট নিতে পারে, দিতে জানে না, শকট নিষ্প্রাণ সেদিক থেকে।
কিন্তু যাকে
বৈষম্য বললাম, আসলে সে কি বিশৃঙ্খলাও নয়? হ্যাঁ, তাও। সমাজে বিদ্যমান
বিশৃঙ্খলাই ছায়া ফেলেছে সংবাদপত্রের ভাষায়। অন্য দিকটায় হয়তো ততটা নয়,
কিন্তু ওই যে দ্বন্দ্ব, সাধু চলবে নাকি চলতি- এটা একটা বিশৃঙ্খলারই প্রকাশ
বটে। এবং এর প্রতিফলনে অস্বাভাবিকতা নেই, অস্বাভাবিকতা ঘটত প্রতিফলন না
ঘটলেই। প্রতিদিন যে দুর্ঘটনা, হত্যা ও পাল্টা গর্জন, ষড়যন্ত্র ও ষড়যন্ত্র
নস্যাৎকরণের রোমহর্ষক খবর, খবরের কাগজেই পাওয়া যায় তার সঙ্গে তাল দিয়ে, তার
ভেতর থেকেই এবং তারই নিয়ন্ত্রণাধীন অবস্থাতেই তো বেরিয়ে এসেছে আমাদের
গদ্যভাষা। বলাই বাহুল্য, সামাজিক বিশৃঙ্খলার মূল কারণ সামাজিক অসাম্য।
অসাম্যই বিশৃঙ্খলার রূপ নিচ্ছে, এবং সেই রূপ পরিব্যাপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের
পোশাকে, চেহারায়, গাড়িতে, বাড়িতে এবং আমাদের গদ্যভাষায়।
সাধু ও চলতির
ব্যবধান একমাত্র ব্যবধান নয়, তবে মৌলিক পার্থক্য বটে। তার চেয়েও মৌলিক
ব্যবধান অবশ্য আছে। ইংরেজি ও বাংলার মধ্যে, আর এই ঘটনা নিশ্চয়ই
তাৎপর্যবিহীন নয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশে ইংরেজি সংবাদপত্রের মর্যাদা ও
সংখ্যা কমেনি মোটেই। সংখ্যা কমেনি, মর্যাদা বেড়েছে। পাকিস্তান আমলেও ইংরেজি
পত্রিকা ছিল দুটি, এখন কয়েকটি। পাকিস্তান আমলে পুরানো ইংরেজি কাগজ পুরানো
বাংলা কাগজের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হতো। কাগজ একই, কালিও এক, খবরও ভিন্ন
নয়, ত্রেতাও একই, ফেরিওয়ালাও অভিন্ন, কিন্তু ইংরেজির এক দর, বাংলার আরেক
দর। অন্য কোনো কারণে নয়, ওই ভাষার কারণেই, ইংরেজি গদ্য অধিক মূল্যবান,
বাংলা গদ্যের তুলনায়। এখন অবশ্যি এই ব্যাপারটা নেই। কোন ব্যাপারটা? কাগজের
দাম সমান সমান, কিন্তু গদ্যের দাম কি তাই? কাগজের দাম সমান সমান হওয়ার
কৃতিত্ব ফেরিওয়ালাদের, তারা জাতীয়তাবাদী হয়েছেন। হয়তো-বা কারণ, বাংলা
কাগজ-বিক্রয়কারীদের জীবনপণ দর কষাকষি, হয়তো বা ইংরেজি কাগজ পাঠকদের
দর-দামের ব্যাপারে ঔদাসীন্য। যেটাই হোক, ইংরেজি কাগজ পড়া এখনো আভিজাত্যের
লক্ষণ বটে। এখনো দামি দামি প্রবন্ধগুলো ইংরেজিতেই লেখে অনেকে, আন্তর্জাতিক
খ্যাতি ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই ব্যক্তি মনের অভিব্যক্তি থাকে, ব্যক্তিই লেখে
যদিও গদ্য, তবু গদ্য অনেক বেশি সামাজিক। যৌথ সৃষ্টি, সে সৃষ্টি সমগ্র
সমাজের। ইংরেজ আসার আগে এ দেশের সামাজিক বিচ্ছিন্নতাটা আরও বেশি ছিল,
মানুষগুলো ছিল বর্ষাকালে পূর্ববঙ্গের গ্রামের মতো, নিকটবর্তী হয়েও
দারিদ্র্য ও যোগাযোগের অপ্রতুলতার দ্বারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। ইংরেজ তার
শোষণের প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক উভয় প্রয়োজনে একটা যোগাযোগব্যবস্থা খাড়া
করল, দেশের সর্বত্র নিজেদের লোক পাঠাল। যাতায়াত ব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি
করল, পরে রেললাইনও তৈরি করল। আর এই যোগাযোগের আনুকূল্যেও বটে, তার
প্রয়োজনেও বটে বাংলা গদ্যের চর্চা শুরু হলো।
মিশনারিরা এল আরেক ধরনের
উদ্দেশ্য নিয়ে, তারাও মানুষের কাছে যেতে চায়, ধর্মপ্রচারের প্রয়োজনে, ফলে
তারাও শুরু করল গদ্যচর্চা। আর যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হলো এ দেশে
ইংরেজের সমর্থনে, ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের ফলে তার মধ্যে দেখা দিল
জাতীয়তাবোধের উন্মেষ। ইংরেজের উৎকৃষ্ট সাহিত্য আছে, আমাদেরও সাহিত্য চাই-
এই বোধটা এল। আর ইংরেজের হাতে যে একটা জাতিগত নিপীড়ন ঘটে যাচ্ছে সেই বোধটাও
না এসে পারল না, ফলে ইংরেজের বিরুদ্ধে সংগঠিত করার প্রয়োজন দেখা দিল দেশি
মানুষদের। তার জন্যও গদ্য চাই। ফলে সাংবাদিকতা এল, এল পাঠ্যপুস্তক। সব
মিলিয়ে গড়ে উঠল বাংলা গদ্য, ঘটল তার বিস্ময়কর বিকাশ।
কিন্তু এই বিকাশের
মধ্যেই উপ্ত ছিল এর দুর্বলতার বীজ। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি দায়িত্ব নিল
গদ্যের, তার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ছিল দেশের বিপুল জনসাধারণের। বিচ্ছিন্নতা
অপর কিছুর নয়, শ্রেণিরই। এমনকি ‘করুণার সাগর’ যে বিদ্যাসাগর তিনিও সর্বজনীন
প্রাথমিক শিক্ষার চাইতে বিশেষ শ্রেণির জন্য উচ্চতর শিক্ষার আয়োজনের প্রতি
পক্ষপাত দেখিয়েছেন প্রস্তুত ভূমিকে কর্ষণ করাই যে বুদ্ধিমানের কাজ,
অপ্রস্তুত অরণ্যকে নিয়ে ধস্তাধস্তি করার তুলনায়, তাদের এই পরামর্শ
অস্বাভাবিক ছিল না। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও,
বঙ্কিমচন্দ্র যে লাখ কথার এক কথা, ‘আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি’ এই
সত্য কথাটায় বিশ্বাস রেখেছিলেন সেটাও অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। স্বার্থের
অনুরাগী ছিলেন তারা জাতীয়তাবাদী হওয়া সত্ত্বেও, কৃষকপ্রেম থাকা সত্ত্বেও।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যে মানুষে মানুষে ব্যবধানের, অযোগাযোগের একটি
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তরূপ পরিখা খনন করেছিল তা ভরাট করা পরের কথা, তার ওপরে
কোনো একটা প্রশস্ত ও মজবুত সেতু তৈরিতেও অনীহা ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়