এক
দশকে উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র। গত কয়েক দিনে এ
চিত্র আরও ভয়ংকরভাবে আমাদের সামনে এসেছে। আমরা উদ্বিগ্ন আমাদের
কন্যাসন্তানদের নিয়ে। এই পরিবার বা সমাজেই ঘাপটি মেরে বসে আছে সেই নরপিশাচ।
গড়নে মানুষ হলেও প্রকৃত মানুষের গুণাগুন নেই তাদের মধ্যে। তাদের কাছে
একবিন্দুও নিরাপদ নয় পরিবারের কন্যাসন্তানরা। আমরা দেখেছি গত ৬ মার্চ,
বৃহস্পতিবার মাগুরা শহরের নিজনান্দুয়ালী গ্রামে শিশু আছিয়ার সঙ্গে ঘটেছে
এমনই এক বীভৎস ঘটনা। আপন বোনের স্বামী ও ভাসুর বোনের শ্বশুর দ্বারা ধর্ষণের
শিকার হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে ছোট্ট মেয়েটি। ক্ষোভে ফেটে পড়েছে দেশের
মানুষ।
আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে। এর একমাত্র কারণ বিচারের
বাণী নিভৃতে কাঁদে। অপরাধীর বিচার বা শাস্তি না হওয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াতে
ধর্ষকের শাস্তির জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্ষোভ প্রকাশ করা হচ্ছে। নারী দিবসের
প্রথম প্রহরে একজন নারী শিশুর ওপর এমন অমানবিক ও পাশবিক নির্যাতন কোনোভাবেই
মেনে নিতে পারছেন না দেশের বিবেকবান নারী ও পুরুষরা। সবচেয়ে কষ্টকর বিষয়
হচ্ছে, ধর্ষিত নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়। এমনকি পুড়িয়ে ফেলার নজিরও রয়েছে
এ দেশে। নারী নির্যাতনসংক্রান্ত মামলাগুলোর বিচার আটকে থাকে দীর্ঘসূত্রতার
জালে। বিচারের সময় আসামির জামিন ভুক্তভোগী নারীর জীবনকে হুমকির মধ্যে
ফেলে। জামিন নিয়ে ফিরে এসে তারা ভিকটিমকেই বিভিন্নভাবে হত্যার হুমকি দিতে
থাকে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত ‘নারীদের ওপর
সহিংসতা’ শীর্ষক জরিপ ২০২৪-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন। সেখানে উঠে এসেছে দেশে
নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা গত এক দশকে বেড়েছে। প্রায় ৭৬ ভাগ নারী তাদের
জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সহিংসতার
পাশাপাশি নির্যাতনমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন। প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে,
সহিংসতার শিকার নারীদের মধ্যে মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ নারী আইনের আশ্রয় নেন।
বাকি ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশ নারী এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেন না। এ ছাড়া সহিংসতার
শিকার ৬৪ শতাংশ নারী তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কারও সঙ্গে শেয়ার
করেন না।
নারীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্যাতন ও সহিংসতার বিষয়ে পদক্ষেপ
না নেওয়ার মূলে রয়েছে সামাজিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা। সেই সঙ্গে
আছে বিচার প্রক্রিয়ার জটিলতা। অনেক সময় অপরাধীরা সমাজের ক্ষমতাবানদের
আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকে। তাদের কাছ থেকে ভুক্তভোগী নারীরাই হুমকি-ধমকি পেয়ে
থাকে। বাইরে কিছু জানালে মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়। সহিংসতার শিকার
নারীরা আইনি ব্যবস্থা নিতে গেলে সমাজের সহযোগিতা তো পানই না, পাশাপাশি
পুলিশ এবং আইনজীবীদের দ্বারাও তারা হয়রান হন। এসব কারণে নারীরা আইনের
আশ্রয় নিতে চান না। নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে বিচারব্যবস্থাপকে ঢেলে
সাজাতে হবে। এ জন্য অন্তর্র্বতী সরকারকে যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত আইন
প্রণয়ন করতে হবে। সহিংসতা ও ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ
করতে হবে। সর্বোপরি নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়রোধে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর
ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ একটি সামাজিক অপরাধ।
আইনের আওতায় এনে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীর দ্রুত বিচার সম্পন্ন করতে
হবে।