কুমিল্লা শহরের একটি সাংস্কৃতিক পরিবারের প্রধান বেগম লতিফা আজিমের প্রয়াণ ঘটেছে। ৮ মার্চ ২০২৫ শনিবার গভীর রাতে ঢাকার ইউনাইটেড হসপিটাল এর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসারত অবস্থায় মিসেস আজিমের প্রয়াণ ঘটে। তিনি ছিলেন ফৌজিয়া হাসান, মনজুরুল আজিম পলাশ,খায়রুল আজিম শিমুল, ফাহমিদা আজিম কাকলি এবং ফারহানা আজিম শিউলির মাতৃময়ী মা। মিসেস আজিমের স্বামী ছিলেন লেখক ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জনাব আনোয়ারুল আজিম যিনি ১৯৭৬ সালেই অকাল প্রয়াত।
বেগম লতিফা আজিমের প্রয়ানে তাঁর নিকট আত্মীয়স্বজন ছাড়াও দেশ বিদেশের অজস্র মানুষ শোকাহত হয়েছেন এবং মরহুমার পরিবারের কাছে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে মিসেস আজিমের অসুস্থতার সংবাদ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে এবং অসংখ্য মানুষ তাঁর জন্য দোয়া-প্রার্থনা করতে থাকে। কিন্তু প্রকৃতির প্রস্থানের নিয়ম এক পর্যায়ে মিসেস আজিমের ক্ষেত্রেও সত্যি হয়। তিনি পরপারে চলে যান পবিত্র মাসে, শনিবার আন্তর্জাতিক নারী দিবসে। শনিবার শহরের প্রধান জানাজা শেষে দেবিদ্বার উপজেলার ভৈশেরকুট গ্রামে তাঁকে আজিম পরিবারের পারিবারিক কবরস্থান-এ দাফন করা হয়েছে। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে আগামীতে মিসেস আজিমের স্মৃতি রক্ষায় নানা উদ্যোগ নেয়া হবে।
শনিবার অনুষ্ঠিত দুটি জানাজায় মিসেস আজিমের বড় ছেলে মনজুরুল আজিম পলাশের দেওয়া বক্তব্যের যে সারাংশ সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্য দিয়ে আমরা মরহুমার জীবন সম্পর্কে কিছুটা হলেও একটু ধারণা পাবো।
জানাজায় বক্তব্যের সারাংশ-
“প্রিয় সমবেত সমাজ। আপনারা সবাই আমার সালাম জানবেন। এই পবিত্র মাসে দুপুর/বিকেল বেলায় রোজা রেখে আম্মার জানাজায় কষ্ট করে যে আপনারা উপস্থিত হয়েছেন তার জন্য পরিবারের সবার পক্ষ থেকে আপনাদের ধন্যবাদ। শুধু উপস্থিত মুসল্লিগণ নন, আমাদের ঘোষণা শুনে শহর এবং দূর থেকেও অনেক পরিচিতমুখ মানুষ এখানে এসেছেন জানাজায় অংশ নিতে। যারা এতক্ষণ জানাজার জন্য অপেক্ষা করছেন তাদের কাছে আমি করজোড় ক্ষমাপ্রার্থী।
আমি আপনাদের কাছে আম্মা সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলেই জানাজার মূল পর্বে প্রবেশ করবো।
আমাদের আম্মা ছিলেন সংগ্রামী একজন নারী। আব্বার অকাল প্রয়াণের পর তিনিই ছিলেন একত্রে আমাদের বাবা-মা। আম্মা আমাদের কোলেপিঠে বড় করেছেন, শিক্ষা দীক্ষায় উন্নীত করেছেন, আমাদের উন্নতি এবং সম্মানজনক সমাজলগ্ন জীবন দেখে যেতে পেরেছেন। তাঁর আরো একটি বিশেষ ভূমিকা হচ্ছে শৈশবে উত্তরাধিকার সূত্রে দাদা থেকে পাওয়া জমি-আশ্রয়টুকু তিনি আমাদের জন্য আগলে রেখেছেন।
ঝাউতলা এই মসজিদের জমি আর আমাদের জমি সংলগ্ন এবং সম্পর্কিত। আম্মা এই মসজিদের পাঁচ ওয়াক্ত আজান শুনেছেন। আমাদের প্রকল্প শুরুর দিকে আম্মা এই মসজিদ এর হুজুর দিয়ে দোয়া পাঠ করেছেন। এতসব ধর্মীয়-আবেগগত কারণে এই মসজিদে আম্মার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠান করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।
আমরা পাঁচভাইবোন আপনাদের স্বাক্ষী দিতে পারি যে আমাদের আম্মা ছিলেন আমাদের জন্য আজীবনের এক মমতাময় আশ্রয়। আম্মা তাঁর সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন আমাদের জন্য এবং মানবতার সেবা করে। আম্মা সংস্কৃতি-সমাজ সচেতন একজন মানুষও ছিলেন। তিনি সমাজের নানা কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। উদ্বোধন করেছেন নানা আয়োজন-অনুষ্ঠানের। আম্মা ছিলেন উদার আধুনিক এবং অসাম্প্রদায়িক একজন মানুষ। তিনি ধারাবাহিকভাবে একটাই সত্তা-পরিচয়-সাংস্কৃতিক অবয়ব রক্ষা করেছেন।
প্রিয় উপস্থিতি। আম্মা ভালো মানুষ ছিলেন এবং অজটিল ছিলেন। কখনো কারো অকল্যাণ করেননি। আম্মা এক অনায়াস অসাধারণ সাধারণ সরল জীবনের অধিকারী ছিলেন। একটি সম্ভ্রান্ত-স্বচ্ছল পরিবার থেকে থেকে এসে আব্বাদের শিক্ষিত কিন্তু তুলনামূলক অজৌলুশ পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে পরবর্তীতে আব্বার অকাল প্রয়াণের পর দারুন বৈরী পরিবেশে আমাদের নিয়ে যুদ্ধ করে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। আম্মা ছিলেন যোদ্ধা। পরে আমরাও তাঁর সহযোদ্ধা হয়েছি।
আম্মা বিশ্বাসী ছিলেন।
বিশ্বাসী একজন মানুষ হিসেবে আম্মা পরকালে আস্থা রাখতেন। আপনাদের আমি বলতে পারি সেই সম্ভাব্য পরবর্তী জীবনে আম্মা সর্বোচ্চ ভালো স্থানে ঠাঁই পাবার যোগ্য। আমরা পাঁচভাইবোন এবং আম্মাকে জানা সব মানুষ এই কথার স্বাক্ষী দেবে।
পবিত্র একটি মাসে এবং নারী দিবসে আম্মার প্রয়াণ ঘটেছে।
আপনারা প্রাণভরে আমাদের আম্মার জন্য দোয়া করবেন।
সবাইকে আবারো ধন্যবাদ সময় দেয়ার জন্যে।