আপনার
সোনামণি কী খাবে, কোন পোশাক পরবে, কী দিয়ে খেলবে, কীভাবে চলাফেরা করবে,
প্রসাধন কী হবে- এই সিদ্ধান্তগুলো কে নিচ্ছে? চোখ বন্ধ করে আপনি বলে দেবেন,
'আমিই সিদ্ধান্ত নিই।' আসলেই কি তাই?
প্রথম প্রশ্ন- নবজাতক কী
খাচ্ছে? বুকের দুধ, না ফর্মুলা ফুড? যদি বুকের দুধ খাওয়ান, আপনাকে
অভিনন্দন। ফর্মুলা ফুড হলে, এই সিদ্ধান্ত আপনি কীভাবে নিচ্ছেন? ডাক্তার
প্রেসস্ক্রাইব করলে সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু বুকে পর্যাপ্ত দুধ থাকা
সত্ত্বেও ফর্মুলা ফুড কেন খাওয়াচ্ছেন? কারণ বিজ্ঞাপনে আপনি দেখেছেন অমুক
ব্রান্ডের দুধ বা সাপ্লিমেন্ট খেলে শিশু তাড়াতাড়ি বাড়ে, বুদ্ধিমান ও
শক্তিশালী হয়। অথচ আপনি জানেন, কৌটার দুধের তুলনায় মায়ের দুধ অনেক সমৃদ্ধ ও
উপকারী।
এক বছরের শিশু কী খাচ্ছে? খাবার না বিজ্ঞাপন? চিপস, চকলেট,
নুডুলস, কৌটার জুস, ফাস্ট ফুড, চায়নিজ ফুড, কোল্ড ড্রিংকস ইত্যাদি এখন
শিশুদের প্রাত্যহিক খাবার। শহর কিংবা গ্রাম যেখানেই যান, মুদিদোকানদারও এসব
বিষাক্ত খাবারের পসরা সাজিয়ে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করছেন। মনে হবে, ‘এটাই তো
স্বাভাবিক‘। অথচ এগুলো যে স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, তা কমবেশি
সবাই জানি।
চিপস তৈরির সময় অতিতাপে আলু পোড়ানোর ফলে ট্রান্স ফ্যাট
নামে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ তৈরি হয়, যা ক্যানসার সৃষ্টির জন্য দায়ী।
চায়নিজ ও ফাস্ট ফুডকে মুখরোচক করার জন্য টেস্টিং সল্ট মেশানো হয়, যা হরমোন ও
স্নায়ুতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করে। ফাস্ট ফুড ও চকলেট খেয়ে শিশুরা মুটিয়ে
যাচ্ছে। নুডুলসে ব্যবহৃত মসলা নিয়ে পুষ্টিবিজ্ঞানীদের ঘোর আপত্তি রয়েছে।
কোল্ড ড্রিংকস বা এনার্জি ড্রিংকস খাওয়ানো বিষ খাওয়ানোরই নামান্তর। বাজারে
দৃষ্টিনন্দন মোড়কে যেসব জুস পাওয়া যায়, অধিকাংশই রাসায়নিক ছাড়া আর কিছু নয়।
আপনি
জানেন, এসব খাবার খেয়ে শিশুর মনোদৈহিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
তারপরও কেন দিচ্ছেন? কারণ, শিশুরা এখন খাবার খায় না, বিজ্ঞাপন খায়! চটকদার
বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে শিশুও এসব খাবারের প্রতি আগ্রহ দেখায়। অধিকাংশ
মা-বাবাই বুঝে হোক, অথবা না বুঝেই হোক শিশুর মুখে এসব খাবার তুলে দিচ্ছেন
অথবা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
আগে শিশুকে কী কিনে দেবেন, কী দেবেন না- সেটা
মা-বাবা সিদ্ধান্ত নিতেন। বিজ্ঞাপনের কারণে এই সিদ্ধান্ত এখন শিশুরা নেয়।
কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন কৌশলও পাল্টে গেছে। আগে মা-বাবাকে লক্ষ্য করে
বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো। শিশুখাদ্যের বিজ্ঞাপনে পুষ্টিমানকে প্রাধান্য
দেওয়া হতো, যাতে অভিভাবকেরা প্রভাবিত হয়। এখন সরাসরি শিশুদের টার্গেট করে
বিজ্ঞাপন তৈরি হয়, যাতে তারা প্রলুদ্ধ হয়।
শিশুরা সত্য-মিথ্যা যাচাই
করতে পারে না, বিজ্ঞাপনে যা দেখে তা-ই বিশ্বাস করে। বিশেষ খাবার, বিস্কুট,
চকলেট, ক্যান্ডি, কোমল পানীয়র বিজ্ঞাপন দেখে ওই খাবারের প্রতি আগ্রহ দেখায়।
শিশু যখন মা-বাবার সঙ্গে বের হয়, তখন (বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রভাবিত) পছন্দের
জিনিস কিনে দেয়ার জন্য বায়না ধরে। না দিলে, এমন আচরণ করে যেন মা-বাবা কিনে
দিতে বাধ্য হয়।
এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে। আগে বলা হতো, শিশুকে কোলেপিঠে
মানুষ করা। এখন এই ধারনা পাল্টে যাচ্ছে। ইদানীং পশ্চিমা অনুকরণে শিশুকে
কোলে না নিয়ে পুশচেয়ার (শিশুকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার গাড়ি) অথবা বেবি ওয়াকার
ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর ফলে, শিশুর যে ক্ষতি হচ্ছে- তা আমরা
কয়জন জানি? শিশুকে বেশিক্ষণ পুশচেয়ার বা বেবি ওয়াকারে রাখলে মায়ের সঙ্গে
তার বন্ধন (ধঃঃধপযসবহঃ) কম হয়, প্রয়োজনীয় অনেক উদ্দীপনা থেকে শিশু বঞ্চিত
হয়। বিশেষ করে কোলে কাতচিৎ হওয়ার ফলে শিশু যে উদ্দীপনা (াবংঃরনঁষধৎ
ংঃরসঁষধঃরড়হ) পায়, পুশচেয়ারে বা বেবি ওয়াকারে তা পায় না। ফলে শিশুর নড়াচড়া
করার দক্ষতা সঠিকভাবে বিকশিত হয় না।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বেবি ওয়াকার
ব্যবহারে শিশু দ্রুত হাঁটতে শেখে না; বরং তাতে আরও বিপদ বাড়ে। ওয়াকার
ব্যবহারের কারণে মেরুদণ্ডের হাড় শক্ত হয় না। অনেক শিশু সারা জীবনের জন্য
কুঁজো হয়ে যায়। ভারসাম্য রেখে হাঁটতে শেখে না। অথচ শিশুকে কোলে নিয়ে অথবা
কোনো কাপড় দিয়ে পিঠে কিংবা সামনে বেঁধে বহন করলে, মায়ের সঙ্গে আত্মিক বন্ধন
গড়ে ওঠে। শিশুও নিরাপদ বোধ করে।
বিজ্ঞাপন এবং পশ্চিমা অনুকরণ আরও কিছু
ক্ষেত্রে ক্ষতিসাধন করছে। শিশুকে সারাক্ষণ ডায়াপার পরিয়ে রাখার সংস্কৃতি এর
মধ্যে একটি। বাসার বাইরে গেলে সতর্কতামূলক ডায়াপার পরান, সেটা ভিন্ন
জিনিস। কিন্তু ঘরের মধ্যে সারাক্ষণ ডায়াপার পরিয়ে রাখতে হবে- এটা একধরনের
আহাম্মকি। অবশ্য কিছু বাস্তব কারণও এজন্য দায়ী। কর্মজীবি মা-বাবার পরিবারে
শিশুর যত্ন নেয়ার মতো যদি তেমন কেউ না থাকেন, তখন ডায়াপার বা ন্যাপিতে তারা
স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অনেক মা-বাবা ঝামেলা এড়াতে ডায়াপার পরান। বার বার
শিশুর যত্ন নেয়া, কাপড় ধোয়া, শুকিয়ে ইস্ত্রি করা ইত্যাদি কাজকে তারা
বিড়ম্বনা মনে করেন। কেউ কেউ আবার ডায়াপার পরানোকে আভিজাত্য মনে করেন!
এ
ব্যাপারে আপনাকে প্রলুদ্ধ করার জন্য পুঁজিবাদীরাও তৎপর। ‘দেরিতে টয়লেট
ট্রেনিং শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য ভালো'- এ ধরনের তথ্য তারা মিডিয়ায়
প্রচার করে বেড়ায়। আসলে এর অন্তরালে লুকিয়ে আছে বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য।
শিশুকে যত দেরিতে শৌচকাজের প্রশিক্ষণ দেবেন, তত বেশি ডায়পার ব্যবহার করবেন।
এ ছাড়া বেশিক্ষণ ডায়াপার পরিয়ে রাখলে শরীরে একধরনের র্যাশ বা ঘা হয়,
ছুটতে হয় ডাক্তারের কাছে বা ফার্মেসিতে। দিন শেষে লাভের গুড় পুঁজিবাদীদের
পকেটেই যায়।
এখানেই শেষ নয়। সারাক্ষণ ডায়াপার পরা থাকলে শিশু মলত্যাগের
সময় ইঙ্গিত দেয় না। আপনার পক্ষেও বোঝা সম্ভব হয় না, শিশু কখন
প্রস্রাব-পায়খানা করবে। ফলে প্রস্রাব-পায়খানার সঠিক অভ্যাস গড়ে ওঠে না।
সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনা হয় স্কুলে ভর্তির আগে। মলত্যাগে নিয়ন্ত্রণ না আসার
কারণে স্কুলে এই শিশুরা সমস্যায় পড়ে, সহপাঠীদের সাথে সামাজিক অভিযোজন
বিঘ্নিত হয়।
শিশুর টিকা নিয়েও চলছে বাণিজ্য। বহুজাতিক ঔষধ কোম্পানিগুলো
বিভিন্ন অসুখের ভয়ভীতি প্রচার করে ভ্যাকসিন বা টিকা বিক্রির চেষ্টা করে।
মুনাফাই এদের মূল লক্ষ্য। এদের বিজ্ঞাপনে প্ররোচিত হওয়া যাবে না। পৃথিবীতে
অসংখ্য রোগ আছে, সব রোগের টিকা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রতিটি
টিকারই কিছু প¦ার্শপ্রতিক্রিয়া আছে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ এবং সরকারি
নীতিমালায় যে টিকাগুলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোই দেয়া উচিত।
বিজ্ঞাপন
আগ্রাসনের এরকম অসংখ্য উদাহরণ চারপাশে বিদ্যমান। মিডিয়া খুললেই দেখবেন,
শিশুকে প্রলুদ্ধ করার জন্য হাজারো আয়োজন। দুঃখের বিষয়, এগুলো দেখার কেউ
নেই। বিজ্ঞাপন-আগ্রাসনে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম যে ঝুঁকির মধ্যে, সেটা আমরা
দেখেও না দেখার ভান করছি। তাই বুদ্ধিজীবী এবং নীতিনির্ধারকদের নীরবতা দেখে
মনে প্রশ্ন জাগে, তাদের বিবেককে কে লালন করছে- বিজ্ঞাপন নাকি মুনাফা?
লেখক- প্যারেন্টিং কলাম বইয়ের লেখক