বুধবার ১২ মার্চ ২০২৫
২৮ ফাল্গুন ১৪৩১
কুমিল্লা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেনসকে হত্যা
কেঁপে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য
প্রকাশ: বুধবার, ১২ মার্চ, ২০২৫, ১:৪০ এএম আপডেট: ১২.০৩.২০২৫ ২:১০ এএম |

কেঁপে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য
শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী, কুমিল্লার ফয়জুন্নেসা গার্লস স্কুলের অষ্টম ও সপ্তম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী,  ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের সাহসিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তাঁরা।  কুমিল্লার ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস জিওফ্রে বাকল্যান্ড স্টিভেনসকে হত্যা করে এক সাহসী বিপ্লবী অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে গতি দিয়েছিল। এই ঘটনা কুমিল্লার জন্য এক গর্বের বিষয়। যে কারণে শান্তি ও সুনীতির বীরত্ব আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় এবং তাঁদের সাহস ও আত্মত্যাগের গল্প বক্তৃতায় উচ্চকিতভাবে উচ্চারিত হয়।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদকের মাধ্যমে যখন জানতে পারি মহান বিপ্লবী সুনীতি চৌধুরীর মেয়ে ভারতী সেন এখনও বেঁচে আছেন। তখন তাঁর সাথে দেখা করার জন্য বেশ উদগ্রিব ছিলাম। করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ চার বছর অপেক্ষার পর ভারতের মুম্বাইয়ে তাঁর সাথে আমার দেখা হয়। ভারতী সেন তাঁর মায়ের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, যেখানে সেই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতিটি অংশ বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বইটি ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। এবার লন্ডন ভ্রমণের সময় হাতে বাড়তি সময় থাকায় ৯৪ বছর আগের এই ঘটনার প্রকাশিত খবরগুলো জানার আগ্রহ জাগে। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে পুরোনো পত্রিকাগুলো দেখে আমি রীতিমতো অবাক হয়ে যাই। একজন সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে।
১৯৩১ সালের ১৪ ডিসেম্বর কুমিল্লার ছোটরাস্থ ডিসি বাংলোয় ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যার খবর কীভাবে সেদিন বিকেলেই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে ইউরোপবাসীকে জানিয়েছিল লন্ডনের ‘দ্য শিল্ডস ডেইলি গেজেট’। রয়টার্সের পরিবেশিত খবরটি তারা প্রধান শিরোনাম করেছিল। এছাড়াও, পরের দিন ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের বেশিরভাগ পত্রিকা খবরটি প্রধান শিরোনাম অথবা গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পাতায় প্রকাশ করে।
সবচেয়ে অবাক হয়েছি ১৫ ডিসেম্বরের ‘দ্য ডেইলি মিরর’ দেখে। পত্রিকাটি প্রথম পাতার পুরোটায় স্টিভেন্স ও তার স্ত্রীর বিয়ের ছবি দিয়ে কাভার স্টোরি করেছিল। ৯৪ বছর পর এসেও এই ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রচার আমার কাছে এক বিরাট ধাঁধাঁ। আমি শুধু ভাবি, খবর পাওয়ার পর পত্রিকার সাংবাদিকরা কীভাবে স্টিভেন্সের লন্ডনের ব্ল্যাকহিথের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে বের করে, সেখানে গিয়ে ছবি সংগ্রহ করে, তারপর পজিটিভ করে পত্রিকায় ছাপতে পেরেছিলেন। অথচ, এর ৬০ বছর পর কুমিল্লার পত্রিকাগুলো পজিটিভে ছবি প্রকাশ করা শুরু করেছিল মাত্র।
সে দিনের ঘটনা:
‘সুনীতি চৌধুরী, লাইফ অফ এ ফ্রিডম ফাইটার’ গ্রন্থে প্রখ্যাত বিপ্লবী-স্বাধীনতা সংগ্রামী সুনীতি চৌধুরীর মেয়ে ভারতী সেন সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন-‘১৯৩১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর । সেদিন স্কুলে বিশেষ পরীক্ষা ছিল। সুনীতি কুমিল্লা শহরের ডিগাম্বরীতলার বাসা থেকে তাঁর মাকে বলে আগেই বেরিয়ে যায়। শ্রীমতী চন্দ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল গার্লস স্কুলের সামনে ঘোড়ার গাড়ি অপেক্ষা করার কথা ছিল। সুনীতি সেই স্থানে পৌঁছালে ন্যাশনাল স্কুলের কয়েকজন মেয়ে তাকে চিনতে পারে। এই মেয়েরা ফয়জুন্নেসা স্কুল ছেড়ে ন্যাশনাল স্কুলে যোগ দিয়েছিল। তাই তারা সুনীতিকে সেখানে এত সকালে কী করছে তা জিজ্ঞাসা করতে শুরু করে। কিছু অস্পষ্ট উত্তর দিয়ে সুনীতি গাড়িতে উঠে পড়ে। গাড়িটি শান্তির বাড়ির দিকে চলতে শুরু করে। গাড়ির সাথে যে ব্যক্তি অপেক্ষা করছিল সে ছিল অপরিচিত। তার বর্ণনা সুনীতিকে দেওয়া হয়েছিল। তাই সুনীতি বর্ণনা মিলিয়ে তাকে চিনতে পারে। অনেক পরে সে জানতে পারে যে সে ব্যক্তিটি সতীশ রায় ছিল। ফয়জুন্নেসা স্কুলের পাশের বাসা থেকে শান্তি গাড়িতে উঠার পর সতীশ রায় রিভলভারগুলো হস্তান্তর করে চলে যায়। শান্তি ও সুনীতি সেগুলো তাদের চাদরগুলোর নিচে লুকিয়ে রাখে। গাড়িটি ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোতে পৌঁছে, তাদের গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। শান্তি ও সুনীতি বাংলোর বাগানে প্রবেশ করে। তখন মালিরা চারপাশে ঘুরছিল। শান্তি ও সুনীতিকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে সাক্ষাৎকারের স্লিপ দেওয়া হয়। স্লিপে তাদের নাম ছিল ইলা সেন (শান্তি) এবং মীরা দেবী (সুনীতি)। স্লিপ নিয়ে একজন ভিতরে যান। কিছুক্ষণ পর ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেনস বাঙালি এসডিও নেপাল সেনকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। শান্তি ও সুনীতি  মেয়েদের জন্য একটি সুইমিং পুল চালু করার আবেদনপত্র নিয়ে এসেছিল। আবেদনপত্রটি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে লেখা হয়েছিল। চিঠিতে শান্তি নিজেকে ঢাকার একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারের কন্যা হিসেবে বর্ণনা করে। তারা ম্যাজিস্ট্রেটকে পৃষ্ঠপোষক করতে চেয়েছিল। মিস্টার স্টিভেনস বলেন, ফয়জুন্নেসা গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মিসেস বিশ্বাস তাদের সাহায্য করতে পারবেন। শান্তি ও সুনীতি ফয়জুন্নেসা স্কুলের ছাত্রী ছিল, অথচ তারা ভান করে যে তারা ঢাকা থেকে এসেছে এবং শহরে নতুন এবং তাকে চেনে না। (গুজব ছিল যে মিসেস বিশ্বাস একজন ব্রিটিশের দালাল ছিলেন)। ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনপত্রে একটি সুপারিশ লাইন লিখতে ভিতরে যান। মেয়েরা একে অপরের দিকে তাকায়, হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকে। অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে। ম্যাজিস্ট্রেট যদি বেরিয়ে না আসেন এবং আবেদনপত্রটি একজন বাহকের মাধ্যমে তাদের কাছে পাঠানো হয়, তাহলে তারা কী করবে চিন্তা করছিল? সকাল ১০টা সময় ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই এসডিওকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। ম্যাজিস্ট্রেট যখন শান্তির হাতে আবেদনপত্র হস্তান্তর করছিলেন, তখন সুনীতি, যে তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল, তার রিভলভার বের করে তার বুকে গুলি করে। স্টিভেনস এবং এসডিও ভিতরে দৌড়াতে শুরু করেন। শান্তি এসডিওকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে, কিন্তু একজন বাধা দেয় এবং গুলিটি তার হাত ছুঁয়ে যায়। চাপরাশিরা তাদের পেছন থেকে শক্ত করে ধরে, মালিরাও তাদের সাথে যোগ দেয়। তাদের ওপর মারধোর চলতে থাকে, তারা এসডিওর চিৎকার শুনতে পায়, পাকড়ো, পাকড়ো (ধরো, ধরো)।
তাদের হাত থেকে রিভলভারগুলো ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তাদের যতটা সম্ভব শক্ত করে বাঁধা হয়। লাথি, চড়, ঘুষি অবিরাম চলতে থাকে। দুই বা তিন ঘণ্টা পর শান্তি ও সুনীতিকে প্রিজন ভ্যানে করে কুমিল্লা কারাগারের মহিলা ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের আদালতে নিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ ভয় পেয়েছিল যে মেয়েদের রাস্তা বা আদালত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হতে পারে। কোনো ঝুঁকি নেওয়ার দরকার নেই। তাই ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই শান্তি ও সুনীতিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ওয়ার্ডে আসেন। তিনি মন্তব্য করেন যে, ‘গুলিটি কত ভালোভাবে লক্ষ্য করা হয়েছিল যে ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থলেই মারা যান। শান্তি ও সুনীতি তাদের কর্মের সাফল্য অবশেষে নিশ্চিত হয়। দুজনেই অবশেষে স্বস্তি বোধ করে।’
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কাপন
মুহূর্তের মধ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেনসকে গুলি করে হত্যার খবর কুমিল্লা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। খবর ছড়িয়ে পড়ে কলকাতায়-লন্ডনেও। পুরো ইউরোপে সৃষ্টি হয় তোলপাড়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কাঁপন ধরে যায়। সেদিন বিকেলেই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে ইউরোপবাসীকে খবরটি জানিয়েছিল লন্ডনের ‘দ্য শিল্ডস ডেইলি গেজেট’। রয়টার্সের পরিবেশিত খবরটি তারা প্রধান শিরোনাম করেছিল। এছাড়া পরের দিন ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের বেশিরভাগ পত্রিকা খবরটি প্রধান শিরোনাম অথবা গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পাতায় প্রকাশ করে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি মিরর পর দিন ১৫ ডিসেম্বর কাভার স্টোরি প্রকাশ করে। সেখানে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেনস ও তার স্ত্রীর বিয়ের ছবি প্রকাশ করে প্রথম পাতা জুড়ে। শিরোনাম দেয় ‘ইয়ং ইন্ডিয়ান ওম্যান স্যুটস ব্রাইটন ডেড’। তাতে বলা হয়-বাংলার ত্রিপুরা জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টর চার্লস জিওফ্রে বাকল্যান্ড স্টিভেনস ১৪ ডিসেম্বর সকালে দুই ভারতীয় মহিলা নৈরাজ্যবাদী (ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীকে নৈরাজ্যবাদী বলা হতো) কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হন। জানা গেছে যে একজন বাঙালি মহিলা কুমিল্লার তার অফিসে মিঃ স্টিভেনসের কাছে একটি পিটিশন পেশ করেছিলেন এবং তিনি যখন এটি পড়ছিলেন তখন রিভলভার দিয়ে তার পেটে গুলি করেছিলেন। তাকে এবং অন্য একজন মহিলাকে তার সহযোগী বলে অভিযোগ করা হয়েছে এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছে।  রয়টার্স বলছে, মহিলাদের মধ্যে একজনের বয়স মাত্র বিশ বছর  এবং আরেকজন একুশ বছর বয়সী। অপরাধের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক বলে মনে করা হয়। ভারতীয় সন্ত্রাসী প্রচারে এই প্রথম মহিলারা খুনি (তাদের ভাষায়) হিসেবে সক্রিয়ভাবে মাঠে নেমেছে। এতদিন তারা শুধুমাত্র বিপ্লবীদের সহযোগী হিসেবে যোগ দিয়েছে, যেমন ভাইসরয়ের ট্রেনে বোমা হামলার ঘটনা, যার বিচার এখন দিল্লিতে চলছে। অভিযোগ করা হয়েছে যে অনেক মহিলা সেই মামলায় অধীনস্থ ভূমিকা পালন করেছে। মিঃ স্টিভেনসের বাড়ি ব্ল্যাকহিথে, তার বয়স ছিল বিয়াল্লিশ বছর। তিনি ওল্ড মার্চেন্ট টেইলরস স্কুল এবং ইমানুয়েল কলেজ, কেমব্রিজে শিক্ষিত হন এবং ১৯১৩ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে নিযুক্ত হন। তিনি বাংলায় সহকারী কমিশনার এবং কালেক্টর হিসেবে কাজ করেন এবং ১৯২২ সালে ডেপুটি কমিশনার হন। তিনি ১৯২৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টর ছিলেন।
মিঃ স্টিভেনসের মা, যিনি ওল্ড ডিয়ার পার্ক-গার্ডেনস, রিচমন্ড, সারেতে থাকেন, গতকাল সোমবার বলেছিলেন: “আমার ছেলে গত দুই বছর ধরে কুমিল্লায় বসবাস করছিল। প্রায় দুই বছর আগে তার বিয়ে হয়েছিল এবং তার একটি সন্তান ছিল।” মিঃ স্টিভেনসের বাবা, যিনি এখন মৃত, ইপসউইচ এবং পিটারবরোতে পোস্টমাস্টার ছিলেন।
লন্ডনের আরেক বিখ্যাত পত্রিকা ‘দি ডেইলি হেরাল্ড’ পত্রিকায় ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ১৪ ডিসেম্বর সকালে কুমিল্লায় আরেকটি সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে, যখন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সি. জি. বি. স্টিভেনসকে তার অফিসে একজন মধ্যবয়সী মহিলা এবং ২০ বছর বয়সী একটি মেয়ে গুলি করে হত্যা করে। শান্তি ঘোষ এবং সুনীতি চৌধুরী নামে মহিলারা একটি সাঁতার প্রদর্শনীতে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে একটি আবেদনপত্র নিয়ে মি. স্টিভেনসের অফিসে প্রবেশ করে। তিনি যখন আবেদনপত্রটি পড়ছিলেন, তখন তারা তাকে গুলি করে হত্যা করে, রিভলভার দিয়ে খুব কাছ থেকে তার বুকে গুলি চালায়। উভয় মহিলাকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই দুই মহিলা ভাইসরয়ের নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল দ্বারা প্রথম বিচার করা হবে।  স্টিভেনসের স্ত্রী এই জেলার একমাত্র শ্বেতাঙ্গ মহিলা, নতুন বছরে আবগারি কমিশনার হিসেবে কলকাতায় বদলি হওয়ার কথা ছিল। তিনি দুই বছর আগে বিবাহ করেছিলেন এবং ভারতীয়দের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন।
যখন মি. স্টিভেনসকে গুলি করা হয় (রয়টারের সংযোজন), একজন পিয়ন তৎক্ষণাৎ পরিস্থিতি বুঝে মহিলাদের দিকে ছুটে যায় এবং তাদের ও মি. স্টিভেনসের মধ্যে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। তিনি বাহুতে আহত হন এবং হাসপাতালে স্থানান্তরিত হন। অভিযুক্ত মহিলাদের মধ্যে একজন, মিস শান্তি ঘোষ, কুমিল্লা কলেজের প্রয়াত অধ্যাপক দেবেন্দ্র ঘোষের কন্যা। এই ঘটনার খবর জেলায় ছড়িয়ে পড়লে কুমিল্লা, চাঁদপুর এবং চট্টগ্রামের সরকারি অফিস এবং অন্যান্য অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিনের বাকি অংশের জন্য বন্ধ ছিল। স্থানীয় বার অ্যাসোসিয়েশনের সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে “কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডের” নিন্দা জানিয়ে প্রস্তাব পাস করা হয়।
রাতে পুলিশ অ্যাডভোকেট কামিনী দত্তকে গ্রেপ্তার করে, যিনি গত এপ্রিলে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযানের সাথে জড়িত অভিযুক্ত “সন্ত্রাসীদের” পক্ষে আইনজীবী ছিলেন এবং অনন্ত সিংয়ের বোন মিসেস ইন্দুমতী সিংকেও গ্রেপ্তার করা হয়, যিনি অভিযানের কথিত নেতা। ভাইসরয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী পুলিশ সপ্তাহান্তে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে আরও অনেককে গ্রেপ্তার করার পর এই গ্রেপ্তারগুলি করা হয়েছে।
স্কটল্যান্ডের অ্যাবারদিন প্রেস এন্ড জার্নাল পত্রিকায় ২১ ডিসেম্বর সংখ্যায় ‘বাংলার ম্যাজিস্ট্রেট খুন’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়-‘কলকাতা “স্টেটসম্যান”-এর কুমিল্লা সংবাদদাতা ১৪ই ডিসেম্বর নিহত কুমিল্লা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ স্টিভেনসের মৃত্যু সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। মিঃ স্টিভেনস যখন একজন মহকুমা কর্মকর্তার সাথে তার অফিসে ছিলেন, তখন দুইজন মেয়ে তাকে দেখার জন্য বারান্দায় আসে। কর্মকর্তা বাইরে গিয়ে তাদের সাঁতার প্রদর্শনীর বিষয়ে কলেজের মহিলা প্রধানের কাছে যেতে বলেন। মিঃ স্টিভেনস তখন বেরিয়ে আসেন এবং মেয়েদের অনুরোধে একটি আবেদনে স্বাক্ষর করতে রাজি হন। তিনি যখন আবেদনপত্রটি এক মেয়ের হাতে ফেরত দিচ্ছিলেন, তখন অন্যজন ভারী রিভলভার দিয়ে ৩ ফুট দূরত্ব থেকে তাকে গুলি করে। মিঃ স্টিভেনস অফিসারের উপর পড়ে যান এবং তারপর নিজেকে সামলে চিৎকার করে বলেন, “আমি আঘাত পেয়েছি,” এবং অফিসের দিকে দৌড়ে যান। দুবার গুলি করা হয়েছে। মহকুমা কর্মকর্তা মেয়েটিকে ধরে ফেলেন, যে তাকে দুবার গুলি করেছিল। অফিসার এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়া একজন পুলিশ সদস্য তাকে আটক করে। পিয়নরা অন্য মেয়েটিকে ধরে ফেলে এবং সাধারণ ধস্তাধস্তিতে একজন পিয়নের বাম হাতে গুলি লাগে। মিসেস স্টিভেনস কিছু দূর থেকে গুলির শব্দ শুনে দ্রুত বাড়িতে ফিরে এসে তার স্বামীকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। পুরো ঘটনাটি তিন মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। অভিযুক্ত খুনি (পড়ুন মুক্তিযোদ্ধা) একটি জবানবন্দী দিয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রায় একই ধরনের খবর বেশিরভাগ দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়। বেশিরভাগ পত্রিকা স্টিভেনসের বিয়ের ছবি প্রকাশ করে। ‘দ্য ইলেস্টেটেড লন্ডন নিউজ’ নামের পত্রিকা অন্যান্যদের ছবির সাথে স্টিভেনসের পরিচ্ছন্ন একটি ছবি প্রকাশ করে তাদের পার্সোনালিটি অব দ্য উইক পাতায়। এরপর প্রতিদিনই পত্রিকাগুলো ফলোআপ খবর প্রকাশ করে।
কেঁপে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য
মণীন্দ্র রায় চৌধুরী গ্রেফতার
১৯৩১ সালে ২১ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক সংবাদে জানা গেছে, ত্রিপুরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সি.জি.বি. স্টিভেনসের গুলি চালানোর পর গ্রেফতার হওয়া মেয়েদের একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দি দিয়েছে। মেয়েদের দখলে থাকা রিভলভারগুলো লাইসেন্সবিহীন বলে জানা গেছে। ১৭ ডিসেম্বর সকালে পুলিশ মণীন্দ্র রায় চৌধুরী নামে এক কলেজ ছাত্রকে গ্রেফতার করেছে। 
অখিল চন্দ্র নন্দী গ্রেপ্তার
করাচি থেকে ১৯৩১ সালে ২১ ডিসেম্বর প্রকাশিত ‘সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট’ পত্রিকায় ‘স্টিভেনস হত্যা, মেয়েদের পুরুষ সহযোগীদের গল্প’ শিরোনামে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের একটি সংবাদ লিড হিসেবে ছাপা হয়। তাতে বলা হয় শনিবার আখাউড়া স্টেশনে আসাম-বাংলা রেলওয়েতে আখিল নন্দী নামের এক বাঙালিকে গ্রেফতার করা হয়েছে । জানা গেছে, তিনি ‘লুঙ্গি’ পরেছিলেন, নকল দাড়ি লাগিয়েছিলেন এবং রেলওয়ে শেডের পেছনে লুকিয়ে ছিলেন। তিনি কুমিল্লা থেকে আট মাইল দক্ষিণে লালমাই থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার টিকিট কিনেছিলেন। জেলা গোয়েন্দা শাখা, স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় লোকটিকে হেফাজতে নিয়েছে। জানা গেছে, পুলিশ দীর্ঘদিন ধরে নন্দীকে খুঁজছিল এবং সাম্প্রতিক ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হতে পারে।
জানা গেছে, কয়েকজন যুবক মেয়েদের জন্য একটি ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করেছিল, যাদের ত্রিপুরা জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সি.জি.বি. স্টিভেন্স হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা তাদের ফৌজদারি আদালত ভবন পর্যন্ত নিয়ে যায়, সেখানে তাদের নামিয়ে দেয় এবং চালককে কালেক্টরের বাংলোতে নিয়ে যেতে বলে। গ্রেফতারকৃত মেয়েরা রিভলভার রাখার কথা স্বীকার করেছে বলে জানা গেছে। আরও জানা গেছে, মিঃ স্টিভেনসের শরীরে একটি .৩২০ বোরের বুলেট পাওয়া গেছে, যা মেয়েদের ব্যবহৃত অস্ত্রের মতো। দুই মেয়ের প্রত্যেকে দুটি করে গুলি চালিয়েছে বলে অভিযোগ। তাদের মধ্যে একজনের .৪৫০ বোরের “বুলডগ” প্যাটার্নের রিভলবার ছিল, অন্যজনের একটি ওয়েবলি ছিল, যা আকারে অনেক ছোট। বাংলার পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং অপরাধ তদন্ত বিভাগের উপ-মহাপরিদর্শক তদন্ত তদারকি করতে কলকাতা থেকে কুমিল্লায় এসেছেন।
নীলিমা নন্দী গ্রেপ্তার
কেঁপে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য
২৩ ডিসেম্বর সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়  ২১ ডিসেম্বর ফয়জুন্নেসা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী নীলিমা নন্দীকে (সম্ভবত প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম) গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. সি. জি. বি. স্টিভেনসের হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পর্কিত অভিযোগে রায় বাহাদুর সুরেশ চন্দ্র সিংয়ের বাড়িসহ শহরের বিভিন্ন বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে। জেলার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা একটি সভায় প্রয়াত মি. স্টিভেনসের স্মৃতি চিরস্থায়ী করার জন্য একটি উপযুক্ত স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং এ উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। 
ছয় যুবক গ্রেফতার
২৫ ডিসেম্বর সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ডাক্তার ও আইনজীবীর পুত্রসহ চার যুবককে ২৩ ডিসেম্বর  সোমবার সকালে প্রয়াত মিঃ সি. জি. বি. স্টিভেনসের হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পর্কিত হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের মহকুমা কর্মকর্তার সামনে হাজির করা হয়েছিল এবং হেফাজতে পাঠানো হয়েছিল। এছাড়া আজ কুমিল্লার একটি স্থানীয় কলেজের ব্যাচেলর অফ আর্টস ক্লাসের দুই ছাত্রকে পরীক্ষার হলে গ্রেফতার করা হয়েছে।
শান্তি-সুনীতির বিরুদ্ধে চার অভিযোগ
কেঁপে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য
ফয়জুন্নেসা স্কুল সাময়িক বন্ধ
১৯৩২ সালের ৪ জানুয়ারি সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ১৪ই ডিসেম্বর সকালে ত্রিপুরা জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ সি.জি.বি. স্টিভেনস হত্যার ঘটনায় পুলিশ শান্তি ঘোষ এবং সুনীতি চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। এই দুই মেয়েকে হত্যার পরপরই গ্রেফতার করা হয়েছিল। মেয়েদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো হলো: হত্যা (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা), হত্যার চেষ্টা (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৭ ধারা), ষড়যন্ত্র (ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০-বি ধারা), সহায়তা (ভারতীয় দণ্ডবিধির ১০৯ ধারা)। শহরের সর্বত্র পুলিশ প্রহরা বসানো হয়েছে। ফয়জুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয় সরকার কর্তৃক সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
কুমিল্লায় আরও গ্রেপ্তার
১৩ জানুয়ারি প্রকাশিত সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট পত্রিকার খবরে বলা হয়-ফয়জুন্নেসা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তণ প্রধান শিক্ষিকা মিস লাবণ্যলতা চন্দ এবং মিস নবনীতাকোমালা সিনহাকে ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সের অধীনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ত্রিপুরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ সি.জি.বি. স্টিভেনসের কথিত হত্যাকারীরা (স্বাধীনতা সংগ্রামীরা) ফয়জুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল।

(পরের অংশ এই লিংক https://www.comillarkagoj.com/news/201465)













সর্বশেষ সংবাদ
স্ত্রীসহ সাবেক এমপি বাহারের ফ্ল্যাট ও ব্যাংক হিসাব জব্দ
৫ দফা দাবি আদায়ে কুমিল্লায় ইন্টার্ণ চিকিৎসকদের কর্মবিরতি - ভোগান্তিতে রোগী ও স্বজনরা
তাওবা ও ক্ষমা
কুমিল্লায় র‌্যাবের অভিযানে অস্ত্র ও গুলিসহ যুবক গ্রেফতার
কুমিল্লায় বিদেশী পিস্তলসহ দুই ডাকাত গ্রেফতার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
স্ত্রীসহ সাবেক এমপি বাহাউদ্দিনের ফ্ল্যাট ও ব্যাংক হিসাব জব্দ
কুমিল্লায় সর্প দংশনে এক যুবক নিহত
চাঁদাবাজির অভিযোগে দেবিদ্বারের দুই ভুয়া সাংবাদিক খাগড়াছড়িতে গ্রেপ্তার
‘ফারজানা’ কাউন্টারে তালা ঝুলিয়ে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বিক্ষুব্ধরা
‘বিয়ের জন্য চাপ দেয়ায় খুন!’ গ্রেপ্তার ২
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২