যেকোনো
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল অনুঘটক হলো বিনিয়োগ। বিনিয়োগ ছাড়া
প্রবৃদ্ধি হয় না। আমাদের দেশে যেটা দেখছি, ২৪-২৫ শতাংশের মধ্যে বিনিয়োগ
থমকে আছে কয়েক বছর। ক্রেডিট নেওয়া হয় ব্যাংক থেকে বিনিয়োগের জন্য, এখানেও
স্থবিরতা দেখছি। আমরা দেখছি যে, আমদানি ক্রেডিটের মেশিনারি আমদানির মাধ্যমে
যন্ত্রপাতি এনে যে বিনিয়োগ করা হয়, সেই আমদানি নিয়েও একটা স্থবিরতা আছে।
সবটা
মিলিয়ে বিনিয়োগে একটা বড় ধরনের স্থবিরতা আছে। সুতরাং, আমাদের অবশ্যই
বিনিয়োগে চাঞ্চল্য আনতে হবে। আর দ্বিতীয় কথা হলো, আমি কত ইউনিট বিনিয়োগ করে
১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথ করতে পারি। আমি যদি রেশিও কমাতে পারি, তার মানে হলো-
আমার উৎপাদনশীলতা ভালো। আমি যদি ৪ ইউনিট দিয়ে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথের
পরিবর্তে ৩ ইউনিট বিনিয়োগ করে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথ করতে পারি, এটাই
উৎপাদনশীলতা। এই উৎপাদনশীলতাটুকু জরুরি।
অন্তর্র্বতী সরকার সংস্কার
কমিটি করেছে। সেই সংস্কার কমিশন কাজ করেছে। তারা বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ
দিচ্ছে। আমার মনে হয় যে, একটা হতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয়ত
হতে হবে প্রযুক্তির বাস্তবায়ন। প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এখন যে
সিস্টেম আছে, এটাতে বড় ধরনের পরিবর্তন করতে হবে। এনবিআরের নিজস্ব যে
জনশক্তি আছে, তা দিয়েই কাজ পরিচালনা করতে হবে। এনবিআরের নীতিমালা প্রণয়ন
এবং নীতিমালা বাস্তবায়ন দুই ভাগে ভাগ করতে হবে। এনবিআরে যারা কাজ করেন
তাদের ওপরের দিকে ওঠার রাস্তা যাতে রাখা হয়, এমন ধরনের সংস্কার করতে হবে।
এটার একটা দিক আছে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। প্রযুক্তিকে যত বেশি কাজে
লাগানো যাবে তত বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব হবে। আমরা ইতিবাচক একটা দিক দেখলাম
যে, এবার ই-সাবমিশন বা ইলেকট্রনিক সাবমিশন অনেক ভালো হয়েছে।
করপোরেটের
ক্ষেত্রে, ব্যক্তি খাতের ক্ষেত্রে এগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। ডিজিটাল
প্রস্তুতিটা রাখতে হবে। আমাদের কাস্টমস, ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স- এগুলোর
মধ্যে একটা সমন্বয় করতে হবে। যে সফটওয়্যারগুলো তারা ব্যবহার করেন সে
ক্ষেত্রে ইন্টার অপারেবিলিটি থাকে। একটার সঙ্গে আরেকটার সংযোগ একই সঙ্গে
সমন্বয় থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে থাকে- যাতে
ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেম আমরা করতে পারি। আমাদের প্রত্যক্ষ কর মাত্র ৩২-৩৩
শতাংশ। এটাকে আরও কীভাবে বাড়ানো যায় তা ভাবতে হবে। সেটা করতে গেলে
ইন্টার-অপারেবিলিটি অব দ্য সিস্টেমস অর্থাৎ কাস্টমস, ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স-
এগুলোর সমন্বয় করতে হবে। বেশি বেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইনকাম ট্যাক্সের
কাজকে কেন্দ্রীয়ভাবে করতে হবে। এটা বিভিন্ন দেশে আছে। ট্যাক্স-জিডিপির
অনুপাত বাড়ানোর বিশাল সুযোগ আমাদের আছে। সাধারণ জনগণের ওপর অপ্রত্যক্ষ কর
বাড়িয়ে নয়, প্রত্যক্ষ কর কীভাবে আমরা বাড়াতে পারি সেই চিন্তা করতে হবে।
যাদের
কর দেওয়ার শক্তি আছে, কিন্তু দেন না, যাদের বিভিন্ন সময় শুল্ককর ১০ শতাংশ
দিলেই সব সাদা করা যাবে, রিয়েল এস্টেট, বিনিয়োগ করলে সাদা করা যাবে- এ
ধরনের যারা আছেন, তাদের প্রণোদনা দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি।
তা থেকে সরে এসে ডিজিটালাইজেশনে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং এনবিআরের মধ্যে
জবাবদিহি এবং প্রণোদনা দুটির সমন্বয় করে আমাদের এগুলো মোকাবিলা করতে হবে।
কারণ দেখা যাচ্ছে যে, রাজস্ব যা আহরণ করি, রাজস্ব ব্যয়ে তা চলে যায়। পুরো
উন্নয়ন ব্যয়টা হয়ে গেছে ঋণনির্ভর। হয় অভ্যন্তরীণ, নয় বৈদেশিক। এটা টেকসই
হবে না। যার ফলে বিনিয়োগ পরিষেবার ভার ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। আমরা যদি রাজস্ব
আদায় বাড়াতে পারি, তাহলে উদ্বৃত্ত রাজস্ব দিয়েও উন্নয়ন ব্যয়ের একটা অংশ
মেটাতে পারব। ঋণনির্ভরতা এবং সুদাসলের কারণে বড় ধরনের একটা অঙ্ক আমাদের
বাজেটে রাখতে হচ্ছে; যা রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এটা টেকসই হয় না
এবং এটা থেকে আমাদের ফিরে আসতে হবে।
আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা ভালো করতে
হবে। এসব জায়গায় আমাদের বড় ধরনের একটা দুর্বলতা রয়েছে। এটাকে মোকাবিলা করতে
হবে। বর্তমান সরকার ১০০টা প্ল্যানের জায়গা থেকে সরে এসে ১০টা স্পেশাল
জোনকে ভালোভাবে চালু করতে চাচ্ছে। আমরা কিন্তু আগেই বলেছিলাম, ১০০টা
স্পেশাল জোন করার জন্য জমি অধিগ্রহণ না করে ১০ থেকে ১২টা করে ভালোভাবে
চালান। বর্তমান সরকার এ পদক্ষেপগুলোই এখন নিচ্ছে। আমার মনে হয় এটা খুব ভালো
যে, তারা এটা করতে চাচ্ছে। এটা হলে বিনিয়োগে চাঙাভাব আসবে। বৈদেশিক
বিনিয়োগ যদি বাড়ানো যায় তাহলে রপ্তানি বাজারে একটা ভালো সংযোগ থাকে। আমাদের
রপ্তানিও বাড়ে।
সুতরাং যারা আমদানি করবে, রপ্তানি করবে এবং স্পেশাল
জোনগুলো ব্যবহার করবে, তাদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিসের ক্ষেত্রে গ্যাস,
বিদ্যুৎ, সেন্ট্রাল প্ল্যান, দক্ষ জনশক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করতে হবে।
শুধু জোন করলেই হবে না। আরও অনেক সমান্তরাল কাজ আমাদের করতে হবে। সেসব
জায়গায় এখনো অনেক দুর্বলতা আছে। যা এখন উদ্যোগ-উদ্যম নিয়ে চেষ্টা করা
হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক একটা পুনর্গঠন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার বিভিন্ন
ধরনের পলিসিগত পরিবর্তনও আনার চেষ্টা চলছে এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টাও
চলছে। বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি হবে না, কর্মসংস্থান হবে না, মানুষের
ক্রয়ক্ষমতা, জীবনমান উন্নত হবে না। সেই বিনিয়োগ মূলত ব্যক্তি খাতেই করতে
হবে।
শুধু শিল্পোদ্যোক্তা নয়, সার্ভিসেস সেক্টর, ই-সার্ভিস, আইটি
অ্যানাবল সার্ভিসেও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। যারা আসতে চাচ্ছেন তাদের
জন্য দেশের শিল্প খাতের উন্নয়নের জন্য আমাদের ইনসেনটিভ আছে। সেবা খাতে যে
উদ্যোক্তা ইয়াং জেনারেশন, তাদের জন্য স্পেশাল উইনডো সৃষ্টি করা দরকার।
এগুলোতে আরও উদ্যোগ-উদ্যম নিয়ে কাজ করতে হবে। ইন্টারনেটের স্পিড বাড়ানো,
তার খরচ কমানো- আইটি অ্যানাবল সার্ভিসে যারা আসে তাদের জন্য এ সুযোগগুলো
অবারিত করতে হবে। নতুন নতুন খাতে সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের যে প্রণোদনা
কাঠামো আছে, তার পরিবর্তন লাগবে। রেডিমেট গার্মেন্টসের ভেতরেও অনেক
সম্ভাবনা আছে।
আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে বাংলাদেশও ভিয়েতনামের মতো বড়
রপ্তানিকারক দেশ হতে পারবে। রপ্তানির ভেতরে টেকনোলজিক্যাল যে কম্পোনেন্ট,
আমাদের দেশে উচ্চ টেকনোলজি কম্পোনেন্ট ১ শতাংশেরও কম আর ভিয়েতনামে ৪৩
শতাংশের বেশি। সেই রকম একটা টেকনোলজিক্যাল রেডিয়েশন করে আমাদের কিন্তু
তুলনামূলক যে সুবিধাগুলো আছে, তাকে প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় রূপান্তরিত করার
একটা সুযোগ আছে। আগামীতে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হচ্ছে, তখন অনেক রেফারেন্স
সুবিধা, বাজারসুবিধা, শুল্কমুক্ত সুবিধা, কোটামুক্ত সুবিধা চলে যাবে।
সেখানেও আমাদের উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে হবে। যাতে করে এই বাজার
সুবিধানির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থেকে তারা দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতানির্ভর
প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় উত্তীর্ণ হতে পারে।
লেখক: সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)