নিজস্ব
প্রতিবেদক: বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা কাউন্সিলের
সদস্য ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আমিন উর রশীদ ইয়াছিনের
সাফল্যগাঁথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি
ফেসবুকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার ভাইরাল হয়েছে। তার সেই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে
কিভাবে নিজেই জুতা বানানোর পদ্ধতি শিখে হাজী ইয়াছিন হয়েছেন খ্যাতিমান
শিল্প উদ্যোক্তা। প্রমাণ করেছেন পরিশ্রম, সততা ও একাগ্রতা থাকলে মানুষের
স্বপ্ন সাফল্যে রূপান্তরিত হয়।
জানা যায়, ১১৯৪ সালে ইমিগ্রেশন ভিসা
নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমান হাজী আমিন উর রশীদ ইয়াছিন। ১৫ দিনের মধ্যেই
আমেরিকান গ্রীন কার্ড পেয়ে আনন্দ করতেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চলে যান
আটলান্টিক সিটিতে- যেখানে ক্যাসিনো রয়েছে। ক্যাসিনো খেলতে খেলতে এক পর্যায়ে
প্রায় সাড়ে ৭ হাজার ডলার লাভ করে ফেলেন। ডলার লাভ করার পর পরবর্তীতে হেরে
যাওয়ার চিন্তা থেকে আর খেলেননি ক্যাসিনো।
আমেরিকায় গেলেও তখনও তিনি কোন
কাজে যোগ দেননি। একদিন আটলান্টিক মহাসাগরের পাড় দিয়ে হাট ছিলেন। হাঁটতে
গিয়ে চোখে পড়ে পাট দিয়ে এক ধরনের জুতা তৈরি হয় এবং সেটি বিক্রি হচ্ছে। এটি
ছিল প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। তখনকার সময় পাটের তৈরিকৃত ওই জুতা বিক্রি
হয়েছিল আমেরিকায় প্রায় ১০ ডলার করে। আমেরিকায় থাকার সিদ্ধান্ত ওই জুতা
দেখেই পরিবর্তন করেন হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াসিন। ঠিক ওই সময়টায় বাংলাদেশে
পাটের মন ছিল মাত্র ৪০ টাকা। অবাক হয়ে বলেন আমি এখানে কেন। আমার দেশের পাট
ফ্রান্স ও স্পেনিশরা আমদানি করে ওইটা দিয়ে তারা জুতা তৈরি করে আমেরিকায়
বিক্রি করে ১০ ডলার করে। আমি কেন আমেরিকায় আসছি কাজ করার জন্য। বাংলাদেশেই
আমি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জায়গা আছে। যে কাজ সেই চিন্তা। ৫ দিনের মাথায় চলে যান
ফ্রান্সে। তখনকার সময় জীবনের প্রথম ফ্রান্সে গিয়েছেন অথচ একটা শব্দ
ফ্রান্সের ভাষা জানতেন না। কোথায় যেতে হবে তাও জানতে না। তখনকার সময়
বর্তমান সময়ের ইন্টারনেট বা গুগল কিছুই ছিল না। ফ্রান্সের প্যারিস
এয়ারপোর্ট থেকে ট্যুরিজম বুথে গিয়ে একটি হোটেল বুকিং করেন নাম হচ্ছে হোটেল
বেলফাস্ট। পাটের তৈরি একটি জুতাও সংগ্ৰহ করেন। ওই হোটেলে উঠার পর সেখানের
রিসিপশনে থাকা ম্যানেজারে সাথে কথা হয় এবং তিনি ইংরেজি বলতে পারতেন । তাকে
বুঝানোর চেষ্টা করেন এবং বলেন এ জুতা তৈরি করতে চাই , এটার কারখানা কোথায়।
শুভাগ্যক্রমে হোটেল ম্যানেজার ব্যক্তিটি ছিলেন ব্যবসায়ী মানসিকতার মানুষ
ছিলেন। তখন তিনি পাটের তৈরিকৃত এ জুতা তৈরি হয় দক্ষিণ ফ্রান্সে। যেটি এখান
থেকে অনেক দূরে। তখন হাজী ইয়াছিন মনস্থির করেন তিনি সেখানে যাবেন এবং তাকে
সঙ্গে যাওয়ার জন্য বুঝিয়ে রাজি করেন। সেই ৩০ বছর আগে তখন তাকে তার
পারিশ্রমিক হিসেবে প্রতিদিন ৫০ ডলার করে দিবেন এবং তিনি রাজি হোন দক্ষিণ
ফ্রান্সে পাটের জুতা তৈরির কারখানা ঘুরে দেখাবেন। সাথে যাতায়াত ও থাকা
খাওয়ার দায়িত্বটুকুও কাঁধে তুলে নেন। ৭-৮ দিনের ছুটি নিয়ে চলে গেলেন
দক্ষিণ ফ্রান্সের সেই কারখানায়। অঞ্চলটি ছিল পাহাড়ি। সংরক্ষিত এলাকা ও
গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়োজনে প্রকৃত পক্ষে বাহিরের কাউকে কারখানা ভিতর কাউকে
দেখাতে চান না মালিক পক্ষ। ভাগ্য ভালো হওয়ায় কথাবার্তা বলার পর কর্তৃপক্ষ
রাজি হোন কারখানা দেখাবেন। ভিতরে গিয়ে ঘুরে দেখলাম। জুতা তৈরিতে মেশিন বা
যন্ত্রাংশের কাজ খুব বেশি নেই, কিন্তু হাতের কাজ অনেক।
তখন হাজী
ইয়াছিনকে কারখানা কর্তৃপক্ষ বলেন তুমি জুতা তৈরির জন্য মেশিন কিনে নিতে
পারবে কিন্তু হাতের কাজ না জানলে জুতা বানানো যাবে না। তার সব কথায় রাজি
হয়ে গেলেন এবং কারখানার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি তার বাড়িতে থাকতে দেন।
হাজী
ইয়াছিন বলেন, নিজের হাতে ফ্রান্সে কারখানায় পাট দিয়ে জুতা সেলাইয়ে কৌশল
শিখেন। পরিবর্তে পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যকেও শিখিয়েছেন। বর্তমানে যে আমি
বিশাল বড় কারখানার মালিক, হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করে সেটি একদিনে হয়নি।
বহু শ্রম, সংগ্ৰাম এবং ত্যাগ এখানে লুকিয়ে আছে। এখনও আমি জুতা বানাতে পারি,
সেই ৩০ বছর আগে শিখেছি।
হাজী ইয়াছিন বলেন, আমি দেশে আসি, বয়স হয়ে যায়
দক্ষিণ ফ্রান্সে ওই কারখানা মালিকে। বাংলাদেশে এসেই কারখানা দেয়ার চেষ্টা
শুরু করি এবং ওই ব্যক্তির সকল মেশিন ও যন্ত্রপাতি কিনে নেয়া হয়। শর্ত ছিল
তিনি বাংলাদেশে এসে কারখানায় মেশিন স্থাপন করে দিবেন এবং শ্রমিক
কর্মচারীদের শেখাবেন।
সর্বপ্রথম কুমিল্লা হাউজিং এস্টেট এলাকায় একটি
বাড়ি ভাড়া করেন। ইতোমধ্যেই ঢাকার একটি কারখানায় জুতার সোল তৈরি করে শুরু
করেন। সোল নিয়ে এসেই জুতার হাতের কাজ শুরু করবেন। এখানে এসেই বাঁধে বড়
বিপত্তি। পাওয়া যাচ্ছে না শ্রমিক। কারণ জুতার কাজ হচ্ছে একেবারেই নিচু কাজ।
যেখানে মানসম্মান জড়িয়ে আছে। কেউ কাজ করবে না। পাওয়া যাচ্ছে না শ্রমিক
কর্মচারী। বহু কষ্টে কিছু শ্রমিক সংগ্ৰহ করা হয়। এরপর নারী শ্রমিকরা আসতে
লাগলো।
উদ্যোক্তা হাজী ইয়াছিন বলেন, যে জুতা নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি, সেই
জুতা সেলাইয়ের কাজ ছিল তখনকার মানুষের কাছে মানসম্মানের প্রশ্ন। চ্যালেঞ্জ
নিলাম। ধীরে ধীরে শ্রমিক বাড়লো। দক্ষিণ ফ্রান্সের ওই কারখানা মালিকের যে
বায়ার ছিল তাদের মাধ্যমে জুতা রপ্তানি শুরু হয়। ওই ব্যক্তিও লাভ করেন এবং
আমিও লাভ করতে থাকি। ব্যবসায়ীক জীবনে যত টাকা উপার্জন করেছি তুলনামূলক ভাবে
পাট দিয়ে জুতা তৈরির ব্যবসা থেকেই সবচেয়ে বেশি টাকা উপার্জন করেছি। এছাড়াও
রাষ্ট্রীয় সম্মান ও স্বর্ণপদক পেয়েছি এ ব্যবসা থেকেই।হ এ ব্যবসা করে
বহুবার সিআইপি হয়েছি। এরপর আর আমার আমেরিকায় যাওয়া হয়নি।