সোমবার ৩১ মার্চ ২০২৫
১৭ চৈত্র ১৪৩১
নামকরণ এবং নাম পরিবর্তনের সংস্কৃতি
ড. সুলতান মাহমুদ রানা
প্রকাশ: শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০২৫, ১:৪৫ এএম আপডেট: ২১.০৩.২০২৫ ২:২১ এএম |



  নামকরণ এবং নাম পরিবর্তনের সংস্কৃতি জাতীয় রাজনীতি, শিল্প, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রখ্যাত ব্যক্তির নামে ঐতিহাসিক স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণের রীতি উন্নত-অনুন্নত প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রচলিত রয়েছে। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক বিষয় নয়, এটি একটি দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক চেতনার প্রতিফলন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাস্তা, ভবন, প্রতিষ্ঠান, স্মৃতিস্তম্ভ, শহর কিংবা পুরো দেশের নাম পরিবর্তনের ঘটনা দেখা যায়।
 এই পরিবর্তনগুলোর পেছনে থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ঐতিহাসিক পুনর্মূল্যায়ন, সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা বা ঔপনিবেশিক অতীত থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। নামকরণ ও নাম পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা সমাজের মূল্যবোধ ও আদর্শকে প্রকাশ করে। কিন্তু শুধু সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশে বা দলবাজির কারণে নাম বদলের খেলা বোধহয় বাংলাদেশে ছাড়া অন্য কোথাও প্রদর্শিত হয় না। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নাম পরিবর্তন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। অবশ্য নাম বদলের এই ঐতিহ্য আমরা উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো কোনো সময় সংকীর্ণ দলীয় চিন্তার ঊর্ধ্বে থেকে জাতীয় নেতাদের সম্মানার্থে নামকরণের প্রবণতা দেখা গেছে। একসময় রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে সুন্দর এলাকাটির নাম রাখা হয় শেরেবাংলা নগর, ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের নাম দেওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের সবচেয়ে প্রশস্ত অ্যাভিনিউয়ের নাম রাখা হয় মানিক মিয়া (তফাজ্জেল হোসেন, যিনি ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের অকুতোভয় সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব) অ্যাভিনিউ। এসব নামকরণ বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিতে ক্রমেই নামকরণ ও নাম বদলের খেলাটি প্রতিযোগিতায় রূপ লাভ করেছে।
নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের একমাত্র বিমানবন্দরের নাম ছিল তেজগাঁও বিমানবন্দর। ১৯৭৯ সালে ঢাকার অদূরে কুর্মিটোলার আন্তর্জাতিক মানের নতুন একটি বিমানবন্দর চালু হলে তার নাম রাখা হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ১৯৮১ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়ার নামানুসারে তদানীন্তন বিএনপি সরকারের নাম দেয় জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কিন্তু ২০১০ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় শাসনামলে বিমানবন্দরটির নাম বদলিয়ে রাখা হয় ‘হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।’ এই নাম পরিবর্তনের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয় যে এ দেশের মানুষ যেহেতু সুফি-আউলিয়াদের শ্রদ্ধা করে, সেহেতু একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের স্মৃতি রক্ষার্থে এই নামকরণ হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রিসভার এক সিদ্ধান্তে বলা হয়, যেহেতু হাইকোর্ট কর্তৃক পঞ্চম সংবিধান বাতিল এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতা জবরদখলকারী অবৈধ শাসক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেহেতু তার নামে স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান রাখা যাবে না।
শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে উন্নীত করে স্বাধীনতা ঘোষণার পাঠক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের নামানুসারে রাখা হয় ‘এম এ হান্নান বিমানবন্দর’। পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সে নাম পাল্টিয়ে রাখে ‘শাহ্ আমানত বিমানবন্দর’। এ নাম এখনো বহাল রয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নির্মিত ভৈরব সেতুর নাম পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নামানুসারে রাখে ‘সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু’। জোট সরকার ওই নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু’। এই সেতু উদ্বোধনকালে বিএনপি নেতা সাইফুর রহমান মন্তব্য করেন, ‘কোথাকার কে নজরুল ইসলাম, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে ‘বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটর’ নাম দিয়ে দেশের প্রথম নভোথিয়েটরটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কর্তৃক উদ্বোধনের সময় এর নাম দেওয়া হয় ‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নভোথিয়েটার’। কিন্তু শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতার এসে বঙ্গবন্ধু নামটি পুনঃস্থাপন করেন। এভাবে অসংখ্য নামকরণ এবং নাম পরিবর্তনের বিষয়টি নিজেদের দলীয় সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। বিশেষ করে একই ব্যক্তির নামে অসংখ্য স্থাপনা এবং প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করার বিষয়টি অতিমাত্রায় দেখা গেছে। যেটি দেশের মানুষ কোনোভাবেই ইতিবাচক হিসেবে দেখেনি।
ধারণা করা হয়েছিল, ২০২৪-এর আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নামকরণের এই নেতিবাচক প্রবণতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেষ হবে। এমনকি পরস্পরকে দোষারোপ বা ঘায়েল করার সংস্কৃতিও শেষ হবে। কিন্তু বিগত সময়ের রাজনৈতিক সরকারগুলোর মতোই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে নাম পরিবর্তন কিংবা নামকরণের। কিছুদিন ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, অন্তর্র্বতী সরকার শুধু পুরোনো ধারার রাজনীতি উৎসাহিতই করছে না; কোনো কোনো ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার শাসনের চিহ্ন মোছার নামে বাঙালির ইতিহাসকে মুছতে শুরু করেছে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আমাদের চোখে পড়ছে। এ বিষয়ে খুলনা এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ সামনে আনা যেতে পারে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু হলের নাম পরিবর্তন করে শাহ আজিজুর রহমানের নাম দেওয়া হয়েছে। সব মহলেই এ বিষয়ে সমালোচনা হচ্ছে যে বাংলাদেশের একজন স্বাধীনতাবিরোধীর নামে নামকরণ করার বিষয়টি কোনোভাবেই মানানসই নয়। এ ছাড়া উল্লেখ্য, গত ৮ ফেব্রুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৯টি স্থাপনার নতুন নামকরণ করা হয়েছে। এটা করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জগদীশচন্দ্র বসু, কবি জীবনানন্দ দাশ, লালন সাঁই, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শহিদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, জি সি দেব, ডা. আলীম চৌধুরীসহ বেশ ক’জন ক্ষণজন্মা মনীষীর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, যারা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাঙালি জাতিসত্তার মনন নির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন। বিষয়টি নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হতাশা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই এটিকে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার একটি প্রয়াস হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
বিগত সরকার বা অন্যান্য সরকার কোনো বিজ্ঞানী, কোনো মনীষীকে বিগত সরকার সম্মান দিয়ে বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করেছিল- সেটিকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে পারি। যেসব বিজ্ঞানী কিংবা মনীষী তাদের কাজের মাধ্যমে যুগে যুগে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ঋদ্ধ করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন, তাদের নাম বাদ দেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কোনো স্থাপনার নামকরণ নিছক শেখ হাসিনার আমলে হয়েছিল বলেই তা মুছে ফেলতে হবে- এটি কোনো যৌক্তিক কার্যক্রম হতে পারে না। আবার নামকরণের বা পরিবর্তনের এই সংস্কৃতিতে কোনো স্বাধীনতাবিরোধীর নাম বসানোর বিষয়টিও দেশের মানুষ ভালোভাবে নেবে না বা নিচ্ছে না। বিগত সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারগুলো মূলত প্রতিহিংসা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে নামকরণ ও নাম হরণের প্রতিযোগিতা শুরু করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসেও এমন সংস্কৃতি বজায় থাকার বিষয়টি কোনোভাবেই ন্যায্য এবং যুক্তিসংগত নয়।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়














সর্বশেষ সংবাদ
মুসল্লিদের ঢল নেমেছিল কুমিল্লা কেন্দ্রীয় ঈদগাহে। স্বস্তির ঈদ জামাত
কুমিল্লায় আইনজীবী আবুল কালাম হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার
কুমিল্লায় ঈদের প্রধান জামাত সকাল সাড়ে ৮টায়
এলো খুশির ঈদ
কুমিল্লার ৩৮পরিবারে ‘বিষাদের ঈদ’
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা জিলা স্কুলে গ্র্যান্ড ইফতার মাহফিল
কুমিল্লায় আইনজীবী আবুল কালাম হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার
কুমিল্লায় ঈদের প্রধান জামাত সকাল সাড়ে ৮টায়
কুমিল্লার ৩৮পরিবারে ‘বিষাদের ঈদ’
হরিশ্চর ইউনিয়ন হাই স্কুল এন্ড কলেজের চতুর্থ পুনর্মিলনী
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২