সোমবার ৩১ মার্চ ২০২৫
১৭ চৈত্র ১৪৩১
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন
কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক শরৎ বাবু ও পালোয়ান দেবেন্দ্র হত্যা যে কারণে-
প্রকাশ: শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫, ১২:৩৪ এএম আপডেট: ২২.০৩.২০২৫ ১:২৭ এএম |

কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক শরৎ বাবু ও পালোয়ান দেবেন্দ্র হত্যা যে কারণে-

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কুমিল্লা ছিল এক উর্বর ভূমি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মাধ্যমে কুমিল্লার যুবকরা তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। ১৯০৬ সালে বাংলা ও আসামের লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফুলার কুমিল্লায় আসলে তাকে স্বাগত জানাতে নির্মিত তোরণ কুমিল্লার সাহসী যুবকরা পুড়িয়ে দেয়। ঠিক তেমনি বঙ্গভঙ্গের পক্ষ নেওয়া ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ খান কুমিল্লায় আসলে তাকেও প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয়। এর ফলে কুমিল্লার যুবকরা ব্রিটিশদের নজরে পড়ে। ঢাকা থেকে অনুশীলন সমিতি কুমিল্লায় শাখা স্থাপন করে। তারা বুঝতে পারে, বিপ্লবের জন্য কুমিল্লাই উপযুক্ত স্থান। কুমিল্লায় শাখা স্থাপনের পর তারা অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহে মনোযোগ দেয়। এজন্য তারা রাজনৈতিক ডাকাতি করে অর্থ সংগ্রহ করে। ১৯০৯ সালে এই অনুশীলন সমিতিকে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর তারা গুপ্ত সমিতি গঠন করে। এই গুপ্ত সমিতিও ডাকাতির মাধ্যমে অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ করে। লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে পাওয়া পত্রপত্রিকায় অনেকগুলো রাজনৈতিক ডাকাতির খবর প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে কয়েকটি ডাকাতি ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। লেখাটি দীর্ঘ হয়ে যেতে পারে এবং পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে, তাই আলোচিত তিনটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হলো।
কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক শরৎ বাবু ও পালোয়ান দেবেন্দ্র হত্যা যে কারণে-
কুমিল্লায় সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল ডাকাতি নয়, ডাকাতির চেষ্টা। ১৯১২ সালের ১ নভেম্বর বৃষ্টিভেজা রাতে কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে এক স্বর্ণকারের দোকান থেকে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সহযাত্রী পালোয়ান দেবেন্দ্র কুমার ঘোষ এই ঘটনা ফাঁস করে দিয়েছেন সন্দেহে বিপ্লবীরা তাকে গুলি করে হত্যা করেন। ১৯ দিন জেরার পর বিচারিক আদালত এই ১২ জনকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেন। এই ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত কুমিল্লার জামতলার রমেন ব্যানার্জি পরবর্তীতে কুমিল্লার দাঙ্গায় নিহত হন। তার বাড়ি বিপ্লবীদের আস্তানা ছিল। এই ঘটনার দুই বছর পর আরেকটি আলোচিত ঘটনা ঘটে কুমিল্লা শহরের ইউসুফ হাই স্কুল রোডে। ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাসার সামনে কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক শরৎ চন্দ্র বসুকে গুলি করে হত্যা করেন বিপ্লবীরা। পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করলেও প্রমাণের অভাবে তাদের খালাস দেওয়া হয়। নিহত প্রধান শিক্ষক শরৎ চন্দ্র বসুর অপরাধ ছিল, তিনি ‘দেশ বিরোধী লিফলেট বিতরণ’ করার বিষয়ে দুই ছাত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন।
১২ বিপ্লবীর সাত বছর সাজা 
পালোয়ান দেবেন্দ্র হত্যা
১৯১২ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে একটি বেনামী চিঠিতে কুমিল্লায় ১লা নভেম্বর রাতে ডাকাতির পরিকল্পনার তথ্য পেয়ে যায় পুলিশ। তারা সতর্ক অবস্থান নেয়।  ১লা নভেম্বর মধ্যরাতে চৌকিদার ফজলল ও মুজাব আলী কান্দিরপাড়ে দুইজন সন্দেহভাজনকে দেখতে পান। একজনকে ধরার চেষ্টা করলে চৌকিদার আঘাতপ্রাপ্ত হন। ঘটনাস্থল থেকে একটি ছেনি ও ইস্পাতের ধারক পাওয়া যায়। পাঁচ-সাতজন লোক দুর্গা চরণ মুক্তারের বাড়ির দিকে দৌড়ে যায়। পরে চৌকিদার ফজলল থানায় গিয়ে খবর দেন। দারোগা যতীন বাবু ঘটনাস্থলে এসে প্রভাত চন্দ্র কর্মকারের কুঁড়েঘরে তল্লাশি চালিয়ে ১২ জন অভিযুক্তকে স্বর্ণকারের দোকানে জড়ো অবস্থায় ধরে ফেলে এবং মাচানের নিচে দুই টুকরো একটি ব্রিচ-লোডিং বন্দুক, ছাদে কাপড়ের বান্ডিল, দুটি রিভলভার, একটি হাতুড়ি ও কার্তুজ, আটটি মুখোশ, আটটি হ্যাভারস্যাক, চারটি লাঠি ও দুটি চাবুকসহ একটি ছোট বান্ডিল উদ্ধার করেন। উদ্ধার করা ছেনি কুলিয়ারচর ডাকাতির ঘটনায় ব্যবহৃত ছেনির মতো ছিল। গ্রেপ্তারকৃত ১২ জন হলেন  কুমিল্লার সিঙ্গার অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজার রমেশ চন্দ্র ব্যানার্জী, কুমিল্লা গিরিধারী স্কুলের শিক্ষক রমেশ দাশগুপ্ত , রামকৃষ্ণ মিশনের সদস্য কুমুদ নাগ, কালাচাঁদ রায়, সর্বতিকান্ত ঠাকুরদাস, প্রভাত চন্দ্র কর্মকার, হরি চরণ, নয়ন (তাঁর নাম একটি কাগজে পাওয়া গেছে, তবে তার পরিচয় পরিষ্কার নয়), দ্রেবেন্দ্র বনিক, ব্রজেন চক্রবর্তী প্রমুখ। রমেশ চন্দ্র ব্যানার্জীর বাসা ছিল শহরের জামতলায় (পরে দাঙ্গায় তিনি নিহত হন)। বাকিরা ঢাকা, যশোর, নোয়াখালী এবং ত্রিপুরা তথা কুমিল্লার বাসিন্দা। ডাকাতির পরিকল্পনাটি ফাঁস হওয়ার বিষয়ে বিপ্লবীরা পালোয়ান দেবেন্দ্র কুমার ঘোষকে সন্দেহ করেন। পুলিশের তালিকায়ও তিনি সন্দেহভাজন ছিলেন।
১৯১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় কুমিল্লায় রাজনৈতিক সন্দেহভাজন দেবেন্দ্র কুমার ঘোষ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। দুই জন তাকে গুলি করে হত্যার পর পালিয়ে যায়। নিহত হওয়ার আগে তিন-চারজন লোক রাস্তায় তার সাথে ধস্তাধস্তি করেছিল। দেবেন্দ্রকে রিভলভার দিয়ে গুলি করা হয়েছিল।  সিভিল সার্জন একটি ময়নাতদন্ত করেন। পুলিশ সম্প্রতি রাজনৈতিক ডাকাতির প্রস্তুতির অভিযোগে যে ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল, তারা ভেবেছিল দেবেন্দ্র কুমার ঘোষ পুলিশকে তথ্য দিয়েছেন।
ঘটনার পরদিন রাতে রায় বাহাদুর অনঙ্গ মোহন নাহার ছেলেকে সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে পুলিশ হেফাজতে রাখে।  বিকেলে অঘোর চন্দ্র দত্ত নামে আরও এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। রায় বাহাদুরের বাড়ি সারাদিন পুলিশ প্রহরায় ছিল।
লন্ডনের ওয়েস্টার্ন ডেইলি প্রেস ১৬ জানুয়ারি এবং লাহোরের সিভিল ও মিলিটারি গেজেট পত্রিকায় ১৭ জানুয়ারি খবরটি ছাপা হয়। পত্রিকায় অভিযুক্তদের নাম পাওয়া যায় নি। তবে শাশ্বত ত্রিপুরা গ্রন্থে ‘ত্রিপুরা ও স্বাধীনতা সংগ্রাম’ প্রবন্ধে বিপ্লবী অখিলচন্দ্র নন্দী লিখেছেন-এই হত্যায় অংশ গ্রহণ করেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রমেশ চৌধুরী ও পুলিন মুখার্জি। পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে নি। অখিলচন্দ্র নন্দী তার লেখায় রায় প্রদানের পর দেবেন্দ্রকে হত্যার কথা উল্লেখ করলেও সে সময় মামলার বিচার কাজ শুরু হয় নি।
কুমিল্লায় ডাকাতির প্রস্তুতির অভিযোগে ১২ জন বাঙালির বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা ১৩ই ফেব্রুয়ারি সেশন জজ মি. ওয়ার্ডের আদালতে বিচার শুরু হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে মি. এন গুপ্ত, রায় বাহাদুর শশাঙ্ক কুমার ঘোষ, মৌলভী আব্দুল করিম ও বাবু গোপাল চন্দ্র ব্যানার্জী উপস্থিত ছিলেন। অভিযুক্ত রমেশ ব্যানার্জীর পক্ষে মি. এন. সেন, বাবু দিজেন্দ্র নাথ দত্ত ও ভূধর দাস এবং অন্যান্য স্থানীয় আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। ১২ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ৩৯৯ ও ৪০২ ধারার অভিযোগ পড়ে শোনানো হলে তারা দোষ স্বীকার করেনি।
মি. গুপ্ত মামলার শুরুতে জানান, অক্টোবরের শেষ দিকে একটি বেনামী চিঠিতে ১লা নভেম্বর রাতে ডাকাতির পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া যায়। পুলিশ সতর্ক অবস্থান নেয় এবং মধ্যরাতে চৌকিদাররা দুইজন সন্দেহভাজনকে দেখতে পান। একজনকে ধরার চেষ্টা করলে চৌকিদার আঘাতপ্রাপ্ত হন। ঘটনাস্থল থেকে একটি ছেনি ও ইস্পাতের ধারক পাওয়া যায়। পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে ১২ জন অভিযুক্তকে স্বর্ণকারের দোকানে জড়ো অবস্থায় ধরে ফেলে। তাদের কাছ থেকে ডাবল ব্যারেল বন্দুক, দুটি রিভলভার, আটটি মুখোশ, আটটি হ্যাভারস্যাক, চারটি লাঠি ও দুটি চাবুক উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা ছেনি কুলিয়ারচর ডাকাতির ঘটনায় ব্যবহৃত ছেনির মতো ছিল।
প্রথম সাক্ষী, প্ল্যান-ড্রয়ার, জেরা করেন। এরপর চৌকিদার মুজাব আলী সাক্ষ্যে জানান, তিনি কান্দিরপাড়ে দুইজন সন্দেহভাজনকে চ্যালেঞ্জ করলে আঘাত পান এবং তারা পালিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থল থেকে ছেনি ও ধারক উদ্ধার করা হয়। জেরা শেষে আদালত দিনের মতো মুলতবি করা হয়। আদালতে সারাদিন দর্শকদের ভিড় ছিল। মামলায় তৃতীয় সাক্ষী চৌকিদার ফজলল  জবানবন্দি দেন যে তিনি টহল দেওয়ার সময় মুজাব আলীর চিৎকার শুনে ঘটনাস্থলে যান। মুজাব আলী দুইজন কম্বল ঢাকা লোককে দেখতে পেয়ে চ্যালেঞ্জ করলে তারা পালিয়ে যায়। ফজলল ও মুজাব আলী তাদের অনুসরণ করলে পাঁচ-সাতজন লোক দুর্গা চরণ মুক্তারের বাড়ির দিকে দৌড়ে যায়। পরে ফজলল থানায় গিয়ে খবর দেন। দারোগা যতীন বাবু ঘটনাস্থলে এসে কর্মকারের কুঁড়েঘরে তল্লাশি চালান এবং মাচানের নিচে দুই টুকরো একটি ব্রিচ-লোডিং বন্দুক, ছাদে কাপড়ের বান্ডিল, দুটি রিভলভার, একটি হাতুড়ি ও কার্তুজসহ একটি ছোট বান্ডিল উদ্ধার করেন। অভিযুক্তদের কাপড় ভেজা ছিল এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি।
কুমিল্লা কলেজের কেরানি সুরেন্দ্র মোহন চক্রবর্তী সাক্ষ্যে জানান, অধ্যাপকের (দেবেন্দ্র নাথ ঘোষ) চিঠি পেয়ে মালি বসন্তকে নিয়ে অধ্যাপকের বাসায় যান এবং জঙ্গল পরিষ্কারের জায়গা দেখান। গিরিধারী স্কুলের মালিক সারকুমার গুপ্ত জানান, তিনি অভিযুক্ত রমেশ গুপ্তকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন এবং স্কুলের রসিদ বইয়ে তার স্বাক্ষর রয়েছে। আদি নাথ চৌধুরী জানান, অভিযুক্ত রমেশ ব্যানার্জী কুমিল্লায় সিঙ্গার অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজার ছিলেন। পৌরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান এবং কুমিল্লা কলেজের ভারপ্রাপ্ত সচিব বাবু সতীশ চন্দ্র রায় জানান, কলেজ খোলার আগের শনিবার মালি বসন্ত অধ্যাপকের বাড়িতে গিয়ে ব্যাগটি দেখায়। ব্যাগে একটি শাবল ও ৫-৬টি ছেনি পাওয়া যায়, যা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গঙ্গা চরণ কর জানান, কুমিল্লাতে পাওয়া বন্দুক ও রিভলভারের কোনো লাইসেন্স ছিল না। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জে. টি. র‌্যাঙ্কিন জানান, জবানবন্দির তালিকায় শেষ নাম “নয়ন” হিসেবে ছিল এবং তা পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছিল। মহিম চন্দ্র দত্ত জানান, অভিযুক্ত কুমুদ তাকে “মামা” বলে ডাকত। তবে কুমুদ ১ নভেম্বরের আগের দিন তার বাড়িতে ছিল কিনা, তা তিনি নিশ্চিত নন। ১৭ ফেব্রুয়ারি জেরায়, সাব-ইন্সপেক্টর যতীন্দ্র মোহন রায় বলেন যে, বন্দুক পাওয়ার আগে তিনি কুঁড়েঘরের লোকদের ডাকাত বলে সন্দেহ করেননি। তবে তিনি রমেশকে চিনতে পেরেছিলেন। বন্দুক পাওয়ার পরও তিনি অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার না করে পালানো রোধে ব্যবস্থা নেন। তিনি থানায় খবর দেননি এবং গ্রেপ্তারের সময় অভিযুক্তদের পরিচয় নিশ্চিত করেননি।
শহরের কনস্টেবল বেধভূষণ সরকার জেরায় বলেন, তিনি অভিযুক্ত কুমুদ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানতেন না। অন্য সাক্ষী ফজলল জানান, ঘটনার রাতে মুজাব আলী একজন সন্দেহভাজনকে ধরেছিলেন, কিন্তু অন্যজন আঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে ফজলল ঘটনাস্থলে ছেনি ও ধারক খুঁজে পান এবং যতীন দারোগাকে খবর দেন। যতীন বাবু মাচানের নিচে দুই টুকরো বন্দুক খুঁজে পান। শশী বাবুর (সাব-ইন্সপেক্টর শশী কুমার ভট্টাচার্য) নির্দেশে ফজলল ছাদে উঠে হাতুড়ি ও বীজের বান্ডিল খুঁজে পান। জেরায় তিনি জানান, অভিযুক্তদের সঙ্গে যতীন বাবুর কথোপকথন শোনেননি কারণ তখন বাতাস ও বৃষ্টি হচ্ছিল।
২৮শে ফেব্রুয়ারি সাব-ইন্সপেক্টর যতীন্দ্র কুমার সেন জেরার জন্য সাক্ষ্য দেন, তিনি নিম্ন আদালতে বলেছিলেন, তিনি একজন অভিযুক্তকে রাজনৈতিক নজরদারিতে রেখেছিলেন। পরবর্তী সাক্ষী, সাব-ইন্সপেক্টর শশী কুমার ভট্টাচার্য, যতীন্দ্রের বক্তব্যের সাথে যোগ করে জানান যে তিনি ২ নভেম্বর সকাল ৬টার দিকে কর্মকারের কুঁড়েঘরের পূর্ব কক্ষ তল্লাশি করেন, যার মধ্যে বই এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ছিল। জেরায় সাক্ষী জানান, তিনি টেবিলের সামনে বসেছিলেন যেখানে প্রথম তথ্য রেকর্ড করা হয়েছিল।  সাব-ইন্সপেক্টর শশী কুমার ভট্টাচার্যকে জেরা করা হয়। এরপর প্রসিকিউশন তাদের মামলা শেষ করে। আসামিপক্ষ কোনো সাক্ষ্য দেয়নি। অভিযুক্তরা লিখিত বিবৃতি জমা দেয় এবং দোষ স্বীকার করেনি। অভিযুক্ত কুমুদের বাড়িতে তল্লাশির সময় জব্দ করা কিছু জিনিস প্রসিকিউশন আদালতকে পড়ে শোনায়। শুনানিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নন্দ কুমার বসু সাক্ষ্য দেন যে, তিনি রাত দেড়টায় ঘটনাস্থলে পৌঁছান এবং মুক্তারের বৈঠকখানায় ১২ জনকে গ্রেফতার অবস্থায় পান। কুঁড়েঘরে প্রবেশ করার পর তিনি দুটি রিভলভার, একটি ডাবল ব্যারেল বন্দুক, দুটি হাতুড়ি, একটি ছেনি, ধারক, বীজ, লাঠি, মাচানে ভেজা কাপড় এবং কিছু অন্যান্য জিনিস আবিষ্কার করেন। তিনি একটি কাগজে “নয়ন” নাম দেখেন এবং সেই কাগজটি আদালতে পাঠানো হয়। অভিযুক্তদের অনেকেই তাদের অবস্থান এবং কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করেন, যেমন রমেশ ব্যানার্জী জানিয়েছেন যে তিনি স্টেশনে গিয়েছিলেন সুরেন্দ্রকে আনতে এবং কুমুদও স্টেশনে যাওয়ার সময় গ্রেপ্তার হন। এছাড়া অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট গঙ্গা চরণ চ্যাটার্জী জানিয়েছেন যে তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং বেশ কিছু অস্ত্র ও অস্ত্রাংশ যেমন রিভলভার এবং বন্দুক দেখতে পান। তিনি তদন্তে অংশগ্রহণ করেন এবং তল্লাশি তালিকা প্রস্তুত করেন। মুস্তাফিজুর রহমানের অভিযোগে আরো সাক্ষ্য দেন মণীন্দ্র নাথ নিয়োগী, যিনি একটি ডাবল ব্যারেল বন্দুকের সম্পর্কে জানান, যা ১৯০৩ সালে বিক্রি করা হয়েছিল। পরে আরও কয়েকজন সাক্ষী, যেমন দুর্গা চরণ দে এবং মুরারী মোহন বসু, ঘটনাস্থলে পাওয়া জিনিসপত্র সম্পর্কিত তথ্য দেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিস্টার ওয়াটলিং সাক্ষ্য দেন যে ঘটনাস্থলে তাদের উপস্থিতি ছিল এবং তারা তল্লাশির মাধ্যমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস উদ্ধার করেন। মামলার শুনানিতে মিস্টার ওয়াটলিং জানান যে, তিনি কুঁড়েঘরটি বাইরে থেকে পরীক্ষা করে একটি ফাঁক লক্ষ্য করেন এবং বাইরের থেকে জিনিসপত্র ঢোকানো সম্ভব কিনা তা দেখতে চান। তিনি কুঁড়েঘরের অবস্থার কোনো নোট নেননি। কনস্টেবল ফকিরাচাঁদ রেবতীকে গ্রেপ্তার করেন, যিনি দ্রুত হাঁটছিলেন এবং কোনো উত্তর দেননি। পরবর্তী সাক্ষী কেদারনাথ মাক্সোমদার জানায়, গোয়ালন্দ ও নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টিমারগুলোর সাথে ট্রেন সংযোগ ঘটেছিল। শশীর চাকর ষষ্ঠী চরণ দে সাক্ষ্য দেন, তিনি শশীর কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন। কুমিল্লা কলেজের অধ্যাপক দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ জানান যে তিনি সুরেন্দ্র চক্রবর্তীর মাধ্যমে একজন মালী নিয়োগ করেছিলেন, যিনি পরবর্তীতে ঘটনাস্থলের কাছে একটি ব্যাগ ও দুটি ছেনি খুঁজে পান।
১৯ দিন জেরার পর ১২ মার্চ এই মামলায় রমেশ চন্দ্র ব্যানার্জি এবং ১১ জনকে কুমিল্লার সেশন জজ ডাকাতির প্রস্তুতির জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন এবং প্রত্যেককে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। ৩৬ পৃষ্ঠায় এ রায় প্রদান করা হয়।  ১৭ এপ্রিল ইংলিশম্যান ওভারল্যান্ড মেইল পত্রিকার খবরে উচ্চ আদালতে মামলাটির আপিল গ্রহণ করার তথ্য পাওয়া যায়। বলা হয়- শুক্রবার বিচারপতি হ্যারিংটন এবং কক্সের হাইকোর্টে, বাবু মন্মথ নাথ মুখার্জি কুমিল্লা রাজনৈতিক ডাকাতি মামলা নামে পরিচিত মামলায় অভিযুক্তদের পক্ষে আপিল গ্রহণের জন্য আবেদন করেন। 
কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু শরৎ চন্দ্র বসুকে হত্যা
১৯১৫ সালের ৪ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় গুলি করে হত্যা করা হয় কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু শরৎ চন্দ্র বসুকে। কুমিল্লা ইউসুফ হাই স্কুলের সামনের রাস্তায় তাঁর বাড়ির সামনে তাকে গুলি করা হয়। এসময় শরৎ চন্দ্র বসুর  গৃহকর্মী এবং কোচম্যান হামলাকারীদের ধরার চেষ্টা করলে, তারাও গুলিবিদ্ধ হন এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কাছাকাছি থাকা একজন মহিলাও এ সময় আহত হয়েছেন। ঘটনার পরপরই দুই ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই দুই ছাত্রের বিরুদ্ধে প্রধান শিক্ষক বাবু শরৎ চন্দ্র বসু পূর্বে রিপোর্ট করেছিলেন। সে রিপোর্টে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী লিফলেট বিতরণের অভিযোগে আনা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পর কুমিল্লায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। এ খবরটি ৬ মার্চ প্রকাশিত হয় লাহোরের সিভিল ও মিলিটারি গেজেট পত্রিকায়।
একই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর বিচারিক আদালত কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রয়াত প্রধান শিক্ষকের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত দুই যুবককে খালাস  প্রদান করেন। তাদেরকে প্রথমে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণের অভাবে অবশেষে খালাস দেওয়া হয়। ১ অক্টোবরের ইংলিশম্যান ওভারল্যান্ড মেইল পত্রিকায় খবরটি ছাপা হয়। কিন্তু এই দুই জনের নাম পত্রিকাগুলোর কোন প্রতিবেদনে পাওয়া যায় নি। 
বিপ্লবীদের অন্যান্য ডাকাতি
১৯১৫ সালের ১২ই এপ্রিল আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের কুমিল্লার নয়নপুর স্টেশন থেকে ১ মাইল দূরে বলদা গ্রামে ধনী মহাজন বাবু উপেন্দ্রচন্দ্র দে-র বাড়িতে রাজনৈতিক ডাকাতি করা হয়। বাড়ির নগদ টাকা ও গয়না নিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৩৩ সালের ১৩ মার্চ কুমিল্লার ইটাখোলা পোস্ট অফিসের একজন রানার যখন রেলওয়ে স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন তিনজন যুবক রিভলভার দেখিয়ে তাকে থামায়। কাছাকাছি আরও তিনজন লুকিয়ে ছিল। তারা ৩,০০০ টাকার বেশি মূল্যের দুটি বীমা করা ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। রানার চিৎকার করলে গ্রামবাসীরা ছুটে আসে এবং তাদের ধাওয়া করে। বিপ্লবীরা গুলি চালায়, এতে একজন গ্রামবাসী ঘটনাস্থলেই নিহত হন এবং আরও তিনজন গুরুতর আহত হন, যাদের মধ্যে একজন পরে মারা যান। নিহত গ্রামবাসীর ভাই বিপ্লবীদের ধাওয়া করে এবং তাদের মধ্যে একজনকে ধরে ফেলে, যার নাম আশিত ভট্টাচার্য বলে সন্দেহ করা হয়, একজন পলাতক বিপ্লবীকে বর্শা দিয়ে আঘাত করা হয়। অন্য দুজন বিপ্লবীকেও পরে ধরা হয়, যাদের মধ্যে একজন মালিয়া শুটিং কেসের সাথে জড়িত ছিল। ধৃত বিপ্লবীদের কাছ থেকে ১,৭৫০ টাকা মূল্যের একটি বীমা করা কভার উদ্ধার করা হয়। ২০ মার্চ সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট পত্রিকা এ খবর ছাপে। 
মতামত জানাতে-+৮৮০১৭১১১৫২৪৪৩













সর্বশেষ সংবাদ
মুসল্লিদের ঢল নেমেছিল কুমিল্লা কেন্দ্রীয় ঈদগাহে। স্বস্তির ঈদ জামাত
কুমিল্লায় আইনজীবী আবুল কালাম হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার
কুমিল্লায় ঈদের প্রধান জামাত সকাল সাড়ে ৮টায়
এলো খুশির ঈদ
কুমিল্লার ৩৮পরিবারে ‘বিষাদের ঈদ’
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা জিলা স্কুলে গ্র্যান্ড ইফতার মাহফিল
কুমিল্লায় আইনজীবী আবুল কালাম হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার
কুমিল্লায় ঈদের প্রধান জামাত সকাল সাড়ে ৮টায়
কুমিল্লার ৩৮পরিবারে ‘বিষাদের ঈদ’
হরিশ্চর ইউনিয়ন হাই স্কুল এন্ড কলেজের চতুর্থ পুনর্মিলনী
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২