ছাত্র-জনতার
গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে
পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ওইদিনই বিলুপ্ত হয় মন্ত্রিসভা। পরদিন ৬ আগস্ট
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। ৮ আগস্ট শপথ নেয়
অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ
পদগুলোতে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী আমলাদের ওএসডি করা হয়, অনেককে
বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
বর্তমানে প্রশাসনের শীর্ষ পদে রেকর্ড
সংখ্যক কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। একই সঙ্গে সর্বোচ্চ সংখ্যক
সচিব ও সিনিয়র সচিব ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) রয়েছেন।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে অনেক কর্মকর্তারা পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন।
অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখায় তাদেরকে দিয়ে কোন ছাড়াই
বেতন দিতে হচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে। আওয়ামী লীগ
সরকারের চরম দলীয়করণ ও নিয়ম-নীতিহীন পদায়ন-পদোন্নতির কারণে নাজুক
পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতির প্রয়োজনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ
সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। একই সঙ্গে গত সরকারের সময় শীর্ষ পদে থাকা বিপুল
সংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডি থাকতে হচ্ছে। হয়তবা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কমে যাবে। ওএসডি ব্যবস্থা গত আওয়ামী লীগ সরকার
রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চরম উদাহরণ সৃষ্টি করে। যে সরকার ক্ষমতায় থাকে
তাদের মতের বাহিরে বা ভিন্নমত কিংবা যারা অন্ধভাবে তাদের নির্দেশনা
মানেননি- এমন কর্মকর্তাদের বছরের পর বছর ওএসডি করে রাখা হয়। অনেকেই ওই
অবস্থায়ই নীরবে চোখের জল ফেলে চাকরি থেকে বিদায় নিয়েছেন।
২০১৮ সালের
নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা ৩৩ সাবেক ডিসিকে ওএসডি করা হয়। এ ছাড়াও ৫০
কর্মকর্তা ভূতাপেক্ষ সচিব, বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়ে
যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী,
বর্তমানে সচিব, সিনিয়র সচিব ও সমমর্যাদার পদ রয়েছে ৮৪টি। এর মধ্যে
মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিবসহ সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে
১৭ জন কর্মকর্তা চুক্তিতে রয়েছেন। অন্যদিকে সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে মোট
ওএসডি আছেন ১২ জন। তবে বর্তমানে প্রশাসনে সবমিলিয়ে ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা
৫ শতাধিক। এ ছাড়াও সারা দেশে অনেক শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান
কর্মক্ষেত্রে যেতে পারছে না। অনেক শিক্ষকের বেতন ভাতা ও বন্ধ।
জনপ্রশাসন
মন্ত্রণালয়ের ১১ র্মাচ ২০২৫ তারিখের তথ্য অনুযায়ী প্রশাসনে মোট ওএসডি আছেন
৫১৭ জন, এর মধ্যে ১২ জন সিনিয়র সচিব ও সচিব। এছাড়াও দুজন গ্রেড-১
কর্মকর্তা, ৩৩ জন অতিরিক্ত সচিব, ৭৬ জন যুগ্মসচিব, ১৩৬ জন উপসচিব, ১৫৫ জন
সিনিয়র সহকারী সচিব, ৯৪ জন সহকারী সচিব এবং আটজন সিনিয়র সহকারী প্রধানকে
ওএসডি করা হয়েছে।
ওএসডি ব্যবস্থায় মূলত কোনো কাজ ছাড়াই বিপুল সংখ্যক
কর্মকর্তাকে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগসুবিধা দিতে হচ্ছে সরকারকে । গত ৫
ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া জনপ্রশাসন
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো
কর্মকর্তাকে ওএসডি না করার জন্য সুপারিশ করা হলো। কোনো ওএসডি কর্মকর্তাকে
কাজ না দিয়ে বেতন-ভাতা দেওয়ার পরিবর্তে তাদের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি
করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাময়িকভাবে পদায়ন করা যেতে পারে।
বর্তমানে
সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকরির বয়স ৫৯ বছর। আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের
অবসরের বয়স ৬০ বছর। শুধুমাত্র বিশেষায়িত ও কারিগরি পদের ক্ষেত্রে যেখানে
দক্ষ লোকের সংখ্যা খুবই কম সেখানে শুধু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে
পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের শাসনামলে দেখা গেছে, যাদের
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তারা কেউই ওইসব পদে অপরিহার্য নন। মূলত
কোন নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ
দেওয়া হয়েছে। চাকরির মেয়াদ শেষে আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের পুরস্কার ছিল
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ।
শীর্ষ পদে চুক্তিতে আছেন যারা প্রশাসনে চুক্তিতে
নিয়োগ পাওয়া শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন- মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ
আব্দুর রশিদ, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমুল গনি, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) এম
এ আকমল হোসেন আজাদ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর
রহমান, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ, সড়ক
পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক, নির্বাচন কমিশনের
সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান
মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. নেয়ামত উল্লাহ ভূইয়া, ভূমি মন্ত্রণালয়ের
সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র
সচিব সিদ্দিক জোবায়ের, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ,
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী। এছাড়া ভূমি
সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব) এ জে এম সালাহউদ্দিন নাগরী, পরিকল্পনা
কমিশনের সদস্য (সচিব) কাইয়ুম আরা বেগম, বিশ্বব্যাংকে বিকল্প নির্বাহী
পরিচালক শরীফা খান, সচিব মর্যাদায় পর্তুগালে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত
মো. মাহফুজুল হক চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন।
এরা সবাই গত বছরের ৫ আগস্টের
পর নিয়োগ পেয়েছেন। ওএসডি সিনিয়র সচিবদের মধ্যে রয়েছেন- মো. মোস্তফা কামাল,
মো. মশিউর রহমান, মো. মনজুর হোসেন। এছাড়া ওএসডি সচিব মো. সামসুল আরেফিন,
মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, মো. আজিজুর রহমান, মো. নুরুল আলম, মো. খায়রুল আলম
শেখ, ফরিদ উদ্দিন আহমদ, রেহানা পারভীন, শফিউল আজিম, এ কে এম মতিউর রহমান।
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখা যায়
অতিরিক্ত আইজিপসিহ ৮২জন পুলিশ র্কমকর্তা ওএসডি।
প্রাথমিকভাবে ২০১৮
সালের বিতর্কিত নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে
দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ৩৩ জন কর্মকর্তাকে গত ১৯ জানুয়ারি ওএসডি করা
হয়েছে। এরা যুগ্ম সচিব হিসেবে বিভিন্ন দপ্তরে দায়িত্ব পালন করছিলেন। একই
কারণে এর আগে ১২ জন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়। তবে বিতর্কিত নির্বাচনে ডিসি
ও এসপি থাকা কর্মকর্তাদের যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর বা এর বেশি হয়েছে তাদের
বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। সেই অনুযায়ী গত ২০ জানুয়ারি ২২ জন সাবেক
ডিসিকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ার ফলে নিচ
থেকে উপরে উঠে আসার জন্য অপেক্ষা করছে, তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। তাই
চুক্তি কমিয়ে আনতে হবে। আমাদের দেশে যেরকম ওএসডি ব্যবস্থা, সেটি পৃথিবীর
কোনো দেশে নেই। আর ওএসডি সরকারের একটি বড় অপচয়। সিস্টেমে হতাশা তৈরি হয়,
বিরূপ প্রভাব পড়ে। এটা আর্থিক, নৈতিক সবদিক থেকেই নেতিবাচক। ওএসডির ইতিবাচক
দিক কম। তাই এই পদ্ধতি বন্ধ করা যেতে পারে।
প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ , কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।