দেশে
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান
শিক্ষাবঞ্চিত অথবা শ্রমিক। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় অনেকেই লেখাপড়ার
পরিবেশ থেকে দূরে সরে গেছে। এই অভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের
চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই নেওয়ার কথা। তা এখনো অগোছালো অবস্থায় রয়েছে।
ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের কারণে সংখ্যালঘু অনেক মানুষ নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে
দিন-রাত কাটাচ্ছেন এখনো। বহু কারখানা অচল হয়ে বর্তমানে হাজার হাজার শ্রমিক
বেকার। বহু শ্রমিককে বকেয়া মজুরির জন্য এখনো পথে নামতে হচ্ছে। বেশির ভাগ
জিনিসপত্রের দাম এখনো সেই ক্রয়ক্ষমতার ওপরেই আছে। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ এখনো
বিশ্বের মধ্যে নিকৃষ্ট। যানজট, দুর্ঘটনা বা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত
আছে।
যেসব প্রকল্প ও চুক্তি বাংলাদেশের জনগণের জন্য বিপজ্জনক,
বাংলাদেশের প্রাণপ্রকৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ এবং যা বড় আর্থিক বোঝা তৈরি
করতে পারে- এসব প্রকল্প এবং চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন দরকার।
যেগুলো খুবই
ক্ষতিকর, সেগুলো বাতিল করা দরকার। সেজন্য এগুলোর বোঝা থেকে কীভাবে বাংলাদেশ
ও মানুষকে রক্ষা করা যায়- সেটা নিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া শুরু করা এই সরকারেরই
দায়িত্ব। অন্যদিকে বৈষম্যবাদী রাজনীতির নড়াচড়া ক্রমেই বাড়ছে। ’৭১-এর
মুক্তিযুদ্ধকে খাটো বা অস্বীকার করে এই জনপদের মানুষের লড়াইয়ের ঐতিহ্যকে
খারিজ করা, সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকে মহিমান্বিত করার প্রবণতা ক্রমেই
দৃশ্যমান হচ্ছে। জোরজবরদস্তি, ট্যাগিং, মব ভায়োলেন্স ও নারীবিদ্বেষী তৎপরতা
দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন মাত্রায়। বলাই বাহুল্য, গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা
পূরণ করতে গেলে এসবের পরিবর্তন হতে হবে। এসবের বিরুদ্ধে সরকারের সরব ও
সক্রিয় হওয়াই প্রধান পদক্ষেপ হতে পারে। এখন পর্যন্ত সরকারের ভূমিকা খুবই
দুর্বল বলতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, যাদের
এই সরকারের না চেনার কথা নয়। এ ছাড়া আবার শুরু হয়েছে চাঁদাবাজি, যা
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে কাজ করে এবং এগুলো বহুদিন ধরেই চলছে। এই যে
কতিপয় গোষ্ঠীর বাজার নিয়ন্ত্রণ, এটা আগের সরকার ভাঙার বদলে পৃষ্ঠপোষকতা
দিয়েছে। বর্তমান সরকারও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এতে
সরকারের বিশেষ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংককে একটা কার্যকর
প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো, যেসব ব্যাংক রাজনৈতিক ও কতিপয় গোষ্ঠীকে
সুবিধা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল সেগুলোকে পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাস বা
কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্ধ করে দেওয়া, মূল্যস্ফীতি ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয়
মুদ্রানীতি প্রণয়ন এগুলো করার জন্য কমিশনের সংস্কার কর্মসূচি বা কমিশনের
রিপোর্টের অপেক্ষার দরকার নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার যদি ঠিকমতো হয়,
ব্যাংকিং ক্ষেত্রে অনিয়মগুলো যদি দূর হয়, বাজারে মুদ্রাব্যবস্থা যদি সুস্থ
অবস্থায় আসে, ডলার এক্সচেঞ্জ রেট স্বাভাবিক অবস্থায় আসে, এসবই মূল্যস্ফীতির
ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এগুলো নিয়ে আগেই সক্রিয় ভূমিকা দরকার ছিল।
সে ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভাষ্য বা কার্যকর উদ্যোগ এখনো আমরা দেখতে পাইনি।
সরকারকে
আস্থা তৈরি করতে হবে। অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অন্তর্র্বতী সরকার
হঠাৎ করে গত সরকারের স্টাইলে মানুষের ওপর ভ্যাট ও করের বোঝা চাপিয়ে দিল তা
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আস্থা কমাবে, আরও কঠিন অবস্থা তৈরি করবে
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য। শেখ হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত অর্থনীতির যে
গতি বা ধারা ছিল, সেখানে অচিন্তনীয় মাত্রায় কতিপয় গোষ্ঠীর লুণ্ঠন, দুর্নীতি
ও সম্পদ পাচারের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল। ফলে দীর্ঘমেয়াদি অনেক ক্ষতি হয়েছে।
এতে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যেতে থাকে। অতি
ব্যয়ে করা ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলোর জন্য ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকে।
মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় ব্যাপকভাবে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার উঁচু দেখালেও তা
কর্মসংস্থানের সমস্যা কমাতে পারেনি। অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির
সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বাড়ে। এর সঙ্গে সম্পদ কেন্দ্রীভবন,
বৈষম্য বৃদ্ধি- এগুলো যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে, তাতে হাসিনা
সরকারের পতন না ঘটলে, এই সংকটগুলো আরও বেশি ঘনীভূত হতো। এসব ঋণ শোধের চাপ
সামনে আরও বাড়বে।
তবে জনগণের নামে একটা ভূমিকা নিতে পারে সরকার। বলতে
পারে, এগুলো যেহেতু অনির্বাচিত সরকার জনসম্মতির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেরা কমিশন
পাওয়ার জন্য এবং কিছু গোষ্ঠী থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য নিয়েছে, যেহেতু
দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচার হয়েছে এর বড় অংশ, সেহেতু এর দায়িত্ব আমরা কেন
নেব? এই প্রশ্ন তুলতে হবে। দরকষাকষি করে সময় বাড়াতে হবে, সুদ এবং আসল কমাতে
হবে। এসব প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না বরং পূর্ণমাত্রায় সচল
রাখতে হবে। এরকম একটি দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে সরকারকে এবং সে অনুযায়ী
ব্যবস্থা নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের দায়িত্ব
সরকারের কোনো কোনো প্রতিনিধিকে নিতে হবে।
শিক্ষা নিয়ে যথাযথ উদ্যোগ
এখনো নেওয়া হয়নি। পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। তবে তা যেন নতুন
সমস্যা তৈরি না করে সেদিকে নজর রাখতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে যেকোনো রাজনৈতিক
দলের দাপট দূর করা উচিত। তবে রাজনৈতিক সচেতনতা, সুস্থ বিতর্ক, অন্যায়ের
বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ইত্যাদি বিষয় অবশ্যই থাকতে হবে। বৈষম্যহীন
শিক্ষাব্যবস্থা তৈরির জন্য পুরো ব্যবস্থার বদল দরকার। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে
বৈষম্য সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের বৈষম্যের ভিত তৈরি করে। শিক্ষা হতে হবে
সব নাগরিকের অধিকার এবং তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। অভিন্ন এবং উন্নত
মানের শিক্ষা শ্রেণি, জাতি, লিঙ্গ, ধর্মনির্বিশেষে সবার জন্য নিশ্চিত করতে
হবে একই সঙ্গে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য অভিভাবকদের আর্থিক দুশ্চিন্তা বা
সংকটের সমাধান করতে হবে।
অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে মৌলিক কিছু
পার্থক্যের সূচনা করতে হবে সরকারকে। আগের সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার
জন্য সামরিক-বেসামরিক আমলা ও পুলিশকে অনেক বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। কতিপয়
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক খাত।
বিপরীতে যারা বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য ও চাপের সম্মুখীন হয়েছেন তার মধ্যে
প্রধানত হচ্ছে সর্বজনের জন্য প্রয়োজনীয় খাতগুলো। যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য
খাতে বরাদ্দ, নিয়োগ, অবহেলার কারণে এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। এর
পাশাপাশি শ্রমিকদের কথাও আমরা বলতে পারি। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে গেলে
শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বরাদ্দের বর্তমান চিত্র পরিবর্তন করে তা আন্তর্জাতিক
মানে নিয়ে আসতে হবে। জিডিপির শতকরা কমপক্ষে ছয় ভাগ বরাদ্দের ধারা তৈরি
করলে ব্যয় বাড়বে বর্তমানের তিন থেকে পাঁচ গুণ। তার যথাযথ ব্যবহারের জন্য এই
দুটি খাতে বড় ধরনের পুনর্বিন্যাস দরকার আছে। পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে
প্রয়োজনীয় সব খাতেই সংস্কারের কাজগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার।
লেখক: শিক্ষাবিদ