সোমবার ৩১ মার্চ ২০২৫
১৭ চৈত্র ১৪৩১
২৫ মার্চ বাঙালির ইতিহাসের কালো অধ্যায়
ওসমান গনি
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫, ১:৩৪ এএম আপডেট: ২৫.০৩.২০২৫ ২:২০ এএম |

 ২৫ মার্চ বাঙালির ইতিহাসের কালো অধ্যায়



আজ ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস। এ দিনটি ইতিহাসে একটি কলংকিত দিন। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মম গণহত্যা চালায়। এ রাতে সেই রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয় আর গ্রেপ্তার করা হয় কমপক্ষে তিন হাজার মানুষ। 
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন: ‘বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা মুছে দেওয়ার চেষ্টায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারপর ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। যে হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষ শোকে মর্মাহত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ এবং গণহত্যার বিষয়টি প্রতি বছর ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে বারবার উচ্চারিত হয়ে আসছে। ২৫ মার্চের কালরাতের কথা দেশে কমবেশি স্মরণ করা হয়েও থাকে। তবে মানুষের মূল মনোযোগটি যেহেতু ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবস পালনের দিকেই থাকে তাই স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে মানুষের উচ্ছাসের প্রভাব সঙ্গত কারণেই বেশি থাকে, ২৫ মার্চের গণহত্যার বিষয়টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। যত আমরা ইতিহাসের এই দিনটিকে বেশি পেছনে ফেলে আসছি ততো স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের বিষয়টিও প্রাধান্য পেয়ে থাকে। যারা ২৫ মার্চ এবং এর পরবর্তী সময়ে নিকটজনকে হারিয়েছিলেন তাদের কষ্টের দিকগুলো অবচেতনে কিছুটা হলেও চাপা পড়ে যেতে থাকে। অথচ পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ রাত ১১টার পরপরই ঢাকা শহরে ট্যাংক, কামান, গোলাবারুদ নিয়ে ঘুমন্ত বা জেগে থাকা মানুষজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। 
ফার্মগেটসহ আশপাশের রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা কিংবা পথচলা মানুষদের ওপর নির্বিচারে গুলি ছুড়তে থাকে তাতে কয়েক হাজার মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে নিহত বা আহত হন বলে বেঁচে যাওয়া কিংবা প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। তৎকালীন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল, বর্তমান শেরাটন হোটেলের অন্ধকার কক্ষ থেকে বিদেশি সাংবাদিক এবং নাগরিকরা যতটুকু পেরেছিলেন তা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করেছে এমন সংবাদ পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন যদিও এদের কাউকে অন্তত দুইদিন হোটেল থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি, ঢাকায় সান্ধ্যআইন বহাল রাখা হলো, বিদেশিদের তেজগাঁও বিমানবন্দর দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করা হলো।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প, পিলখানার ইপিআর ক্যাম্পকে চারদিক থেকে ট্যাংক কামান ও সামরিক জান্তার সদস্য দিয়ে ঘেরাও করে আক্রমণ করা হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, পুরান ঢাকা, লক্ষীবাজার, সদরঘাট, তেজগাঁও, মিরপুর, মোহাম্মদপুর যেখানে বাঙালি বসতি ছিল সেখানেই একইভাবে হামলা করা হলো। সেই রাত এবং পরবর্তী দিন ও রাতে গোটা ঢাকা শহরে কত মানুষ প্রাণ হারায় তার সংখ্যা ধারণা করা হয় ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বিশেষত বুড়িগঙ্গা পার হতে গিয়ে অনেক মানুষ পাকবাহিনীর আক্রমণের শিকার হন, কেরানীগঞ্জে গিয়ে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের অনেকেই পাকিস্তানিদের আক্রমণের মুখে পড়ে প্রাণ হারান। তখন ঢাকা শহর থেকে নারী-পুরুষ শিশু, বুড়ো সবাই প্রাণ নিয়ে বের হয়ে পড়েন, ঘর দরজা ফেলে রেখে বের হয়ে যান পায়ে হেঁটে চারদিকেই মানুষ উদ্বাস্তুর মতো ছুটে যেতে থাকেন। এসব মানুষের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়ে প্রাণ হারান।
২৫ মার্চ যে গণহত্যা ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করেছিল তা অন্যান্য শহরের বিশেষত সেনানিবাসের নিকটস্থ শহরগুলোতে প্রায় একই সময়ে পরিচালিত হয়। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রংপুর, সৈয়দপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, রাজশাহী, সিলেটসহ বিভিন্ন শহরের অবস্থা প্রায় অভিন্ন রূপ লাভ করে। বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি  জান্তার সঙ্গে বিহারি হিসেবে পরিচিত একটি জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ যোগ দেয়, রেল জংশনগুলোতে নিরীহ বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এরপর গণহত্যার বিষয়টি গ্রাম পর্যন্ত পাকিস্তানিরা বিস্তৃত করে। আন্তঃজেলা সড়কগুলোর আশপাশে মানুষের গ্রাম, হাটবাজার, থানা উপশহরগুলো একের পর এক হামলার শিকার হয়। গঠন করা হয় রাজাকার বাহিনী। এদের সহায়তায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম, আওয়ামী লীগের প্রভাব যেসব অঞ্চলে বেশি বলে  খ্যাতি ছিল, মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা যেসব অঞ্চলে অবস্থান করছে বলে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে খবর আসত সেসব স্থানে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করা হতো।
যেসব অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করত সেখানে বাড়িঘর পোড়াপুড়ি, নিরীহ মানুষদের একত্রিত করে হত্যা করা, নারীদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করার ঘটনা পাকিস্তানিদের কাছে সাধারণ নিয়ম ছিল। ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কয়েক হাজার গ্রাম, হাটবাজার তথা লোকালয় আছে যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে আক্রমণ পরিচালনা করে গণহত্যা সংঘটিত করেছিল। যুদ্ধের ৯ মাস মানুষজন গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেড়িয়েছেন, আক্রমণের মুখে পড়েছেন। তবে সীমান্তবর্তী অঞ্চলসমূহে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘাঁটি স্থাপন করে অনেক জায়গাতেই নিরীহ মানুষদের ওপর আক্রমণ করত, তাতে অনেকেই প্রাণ হারান। প্রায় প্রতিটি শহরে একাধিক নির্যাতন ক্যাম্প ছিল যেখানে গ্রাম ও শহরে চলাচলকারী মানুষদের মধ্য থেকে সন্দেহভাজন তরুণদের আটক করে নেওয়া হতো, টর্চার সেলে নিয়ে গিয়ে অনেকের ওপরই অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো, মেরে ফেলা হতো, চোখ উপড়ে ফেলা হতো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অসংখ্য তরুণ, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পীকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন ক্যাম্পে রাখা হতো, অনেকেই সেখানে মৃত্যুবরণ করেন, বহু নারী তাদের নির্যাতনের শিকার হন।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। তাদের আত্মসমর্পনের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা অব্যাহত রাখে। নদী, খাল, বিল ও বঙ্গোপসাগরে এসব মানুষের মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হতো, গ্রামগঞ্জে অকস্মাৎ আক্রমণে যারা নিহত হতেন তাদের অনেককেই গণকবরে পুঁতে ফেলা হয়েছে। সে কারণেই বাংলাদেশের অসংখ্য জায়গায় গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে, অনেক গণকবর হয়তো ভবিষ্যতে আবিষ্কৃত হবে। নিষ্ঠুর এমন গণহত্যার বিষয়টি আমাদের জানা থাকলেও বিদেশে অনেকেরই জানা নেই।
তাছাড়া বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে যে বিশ্ব রাজনৈতিক বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় তখন বেশ কিছু বড় বড় রাষ্ট্র আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি, তারা স্বীকার  করতে চায়নি এখানে পাকিস্তানি জান্তাদের সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, নারী নির্যাতন, জ্বালাও-পোড়াও কর্মকাণ্ড। ফলে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের নেতৃত্বে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। অথচ বিশ শতকে প্রথম ও দ্বিতীয়  বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতার চাইতে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ, গণহত্যার বিষয়সমূহ অনেক বেশি পৈশাচিক ছিল। এছাড়া ভিয়েতনাম, লাউস, কম্বোডিয়া, নামিবিয়া, সার্বিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যেসব গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল সেগুলোর চাইতে এখানে গণহত্যার ব্যাপকতা, নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা অনেকাংশে বেশি হয়েছিল। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশে ১৯৭১-এর গণহত্যার বিষয়টি আরও বেশি আলোচনায় আসা প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল। ফলে এর প্রকৃত তথ্য ও ইতিহাস পৃথিবীতে অনেক কম আলোচিত হচ্ছে। এই না হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যার বিষয়টি আমরাও যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি।
দেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে গুরুত্ব না দেয়ার অপশক্তির অভাব নেই। তারা মুক্তিযুদ্ধকে অনেক ক্ষেত্রেই বিতর্কিত করতে সচেষ্ট। ফলে গণহত্যার মতো বিষয়টি তাদের শাসনামলে উপেক্ষিত হয়েছে, সেভাবে আলোচিত হয়নি। মূলত মিডিয়াতে কিছু কিছু লেখালেখি ও আলোচনা স্থান পেলেও দেশের নতুন প্রজন্মকে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চেতনায় গড়ে তোলার উদ্যোগ সেভাবে গৃহীত হয়নি। এখন নতুন করে ১৯৭১-এর গণহত্যাকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে নতুন প্রজন্ম আগের চাইতে বেশি বেশি জানার সুযোগ পাবে, দেশ ও জাতির ইতিহাসের প্রতি অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার সুযোগ পাবে। এ বছর থেকে প্রতি বছর ২৫ মার্চ পাকিস্তানিদের অত্যাচার নির্যাতন এবং গণহত্যার বিষয়টি মানুষের জানার খুব কাছাকাছি আসবে, পৃথিবীর মানুষও জানতে পারবে এখানে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী কীভাবে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করেছিল, পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো আমাদের কষ্টের ইতিহাস সবার জানার সুযোগ হবে, একদিন হয়তো ২৫ মার্চ পৃথিবীর মানুষের কাছে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হওয়ার সিদ্ধান্তও গৃহীত হতে পারে। ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি যেভাবে ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে, একইভাবে নিকট ভবিষ্যতে ২৫ মার্চও গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তখন পৃথিবীর মানুষের কাছে আরও বেশি শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হবে আমরা সেই প্রত্যাশাই করতে পারি। 
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট












সর্বশেষ সংবাদ
মুসল্লিদের ঢল নেমেছিল কুমিল্লা কেন্দ্রীয় ঈদগাহে। স্বস্তির ঈদ জামাত
কুমিল্লায় আইনজীবী আবুল কালাম হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার
কুমিল্লায় ঈদের প্রধান জামাত সকাল সাড়ে ৮টায়
এলো খুশির ঈদ
কুমিল্লার ৩৮পরিবারে ‘বিষাদের ঈদ’
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা জিলা স্কুলে গ্র্যান্ড ইফতার মাহফিল
কুমিল্লায় আইনজীবী আবুল কালাম হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার
কুমিল্লায় ঈদের প্রধান জামাত সকাল সাড়ে ৮টায়
কুমিল্লার ৩৮পরিবারে ‘বিষাদের ঈদ’
হরিশ্চর ইউনিয়ন হাই স্কুল এন্ড কলেজের চতুর্থ পুনর্মিলনী
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২