জাতির মূল
চাওয়া আসলে কি? যে কোনো জাতি যখন স্বাধীনতা পায় বা লাভ করে তখন থেকে তার
উদ্দেশ্য বা আদর্শে থাকে দেশের মঙ্গল। এই মঙ্গলবোধটা না থাকলেই বিপদ। যাদের
আছে তারা ধীরে ধীরে বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের জায়গা করে নেয় । তাদের জন্য
অন্য দেশ ও জাতির সম্মান আর ভালোবাসা বাড়তে থাকে নদীর পানির মতো। জোর করে
বা ভয় লাগিয়ে এসব আদায় করা যায় না। এগুলো আসে ইতিহাস ঐতিহ্য আর ভবিষ্যতের
দিকে যাত্রা থেকে। আমাদের বাংলাদেশ একাত্তরে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে
সেটাই আমাদের ভিত্তি ।
আজকাল বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানের পর শোনা যায়
আমরা আবারও স্বাধীন হয়েছি। কথাটা একদিক থেকে অসত্য নয়। বুকের ওপর চেপে বসা
পাথরের মতো ভারি স্বৈরাচারের নাগপাশ থেকে মুক্তিকে আপনি স্বাধীনতা বলতেই
পারেন। কিন্তু এ কথা মনে রাখতে হবে স্বৈরাচার বা একনায়কের শাসন মানে একজন
মানুষ বা তার সাঙ্গপাঙ্গদের শাসন। জায়গা বা দেশ বিশেষে পরিবারের শাসন।
আমাদের বেলায়ও তাই হয়েছিল। মূলত পরিবার আর ব্যক্তি মিলেই একনায়ক হয়ে ওঠায়
পালানোর মতো অপমানজনক বাস্তবতা মানতে বাধ্য হয়েছে তারা। কিন্তু এই তারাই তো
সব নয়। সব নয় বলেই সিংহভাগ মানুষ বিরোধিতা করেছে। পথে নেমেছিল তাদের পতন
ঘটাতে। তাহলে মানুষের অর্জিত স্বাধীনতা পদদলনকারী মুষ্টিমেয়ের জন্য কেন
আমাদের একাত্তরের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে ? কেন আমরা সে স্বাধীনতা বা
মুক্তিযুদ্ধকে আমাদের আপন মনে করব না? আমি বলছি না যে কেউই তা মনে করছে না।
কিন্তু আজকাল সামাজিক মিডিয়াসহ নানান মিডিয়ায় চোখ রাখলেই মনে হয় একাত্তর
কি তার আলো হারাচ্ছে? জোর করে কি নিভিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার আলো বা দ্যুতি?
আমার
বা আমাদের এই ধারণা অমলূক হলে খুশি হব। সবার আগে আমাদের বুঝতে হবে
স্বাধীনতা ও কথা বলার অধিকার অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটি না থাকলে আরেকটি
মৃত। আপনাদের হয়তো মনে থাকতে পারে রাশিয়ার সেই বিখ্যাত গল্পটি। ক্রুশ্চেভ
তখন প্রধানমন্ত্রী পলিটব্যুরোর এক সভায় তিনি দুঃখ করে বলছিলেন, অনেক কথা
আমরা স্তালিনের আমলে বলতে পারতাম না। এমন সময় নীরব সভাস্থলের মাঝখান থেকে
কে যেন বলে উঠেছিল, কেন , বলতে পারতেন না কেন? তখন তো আপনি পলিটব্যুরোর
সদস্য ছিলেন।
ভাষণ থামিয়ে ক্রুশ্চেভ জানতে চাইলেন, কে বললেন এই কথা? কেউ
কিছু বলে না। থমথমে নীরবতা । প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় কন্ঠে জানালেন , আমি কথা
দিচ্ছি আপনি দাঁড়ান আপনার কোন অসুবিধা হবে না। বরং আপনাকে দেখে অনেকেই সাহস
পাবে। তবু কেউ দাঁড়াল না। কয়েকবার বলার পর তিনি হাসলেন। হাসতে হাসতে
বললেন, ঠিক এক ই কারণে আমরাও তখন বলতে সাহস পেতাম না ।
স্বাধীনতার জন্য
দুটি বিষয় অনিবার্য। একটি ভোট আরেকটা কথা বলার অধিকার। কথা বলা মানে কিন্তু
তোতার মতো শেখানো বুলি আওড়ানো নয় । গঠনমূলক আর সত্য বলার অধিকারের নামই
মুক্তি। সে জায়গা থেকে আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের ৫৩ বছরে কোন সরকারই
সত্য বলতে দিতো না। কেউ আংশিক, কেউ খণ্ডিত, কেউ তাদের মনের মতো করে বলার
অধিকার দিলেও মূল কথা বলতে পারা ছিল কঠিন। যার কারণে একাধিক সরকারকে বিদায়
নিতে বাধ্য করেছে জনগণ। তারপর ও কারো কোন শিক্ষা হয়নি। কেউ তা থেকে পাঠ
নেয়নি। নিলে দেশ ছেড়ে ভেগে যাবার মতো বাস্তবতা দেখতে হতো না।
বলছিলাম
দেশ বা জাতির মূল আকাঙ্ক্ষা আসলে কি? মানুষ যখন সুশাসন চায় বা কামনা করে
তখন তার মাথায় থাকে বাজারের জিনিসের দাম। রাস্তাঘাটে নিরাপত্তা , জান মালের
নিরাপত্তা আর বলা বা চলার স্বাধীনতা । বাংলাদেশে যখনই কোন পরিবর্তন সাধিত
হয় জনগণ উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। যা খুব ই স্বাভাবিক। বন্দিদশা থেকে মুক্তির মতো
আচরণ করা মানুষগুলো কদিন পরই আবার হতাশার সাগরে ডুবতে শুরু করে দেয়। ওই যে
বললাম কোনটা আসলে জরুরি? বাংলা ভাষার পাশাপাশি উর্দু চালু করা? বঙ্গবন্ধু
এভিনিউকে আবার জিন্নাহ এভিনিউ করা না আইনের শাসন চালু করা? এখনও এই সব
পুরোপুরি হয়নি। এমন যদি হয়, যারা পরাজিত তাদের অনেক বাস্তবতা মানতে হয়,
এটাই স্বাভাবিক। কাজেই তাদের আহাজারি বা কান্নার কথা বলছি না। তাদের এই
কান্না বা শোক কবে শেষ হবে তার বিচারক সময়। এর মধ্যে তাদের কি শাস্তি বা
প্রতিদান পেতে হয়ে সেটাও সময়ই বলে দেবে। আমরা বলছি জরুরি বিষয়গুলোর কথা।
পরিবর্তন পরিমার্জনের চাইতে দরকার মানুষকে ভালো রাখা। মানুষ যেন ফিল করে বা
অনুভব করে যে তারা আগের চাইতে নিরাপদ।
আশা নিয়েই দেশ স্বাধীন হয়েছিল
একাত্তরে। সে আশার ব্যতিক্রম বা ভরাডুবিতেই বারবার মানুষ প্রতিবাদ করেছে।
কিন্তু নিশ্চিতভাবে প্রতিহিংসা জয়ী হয়। মনে করতে পারেন ইন্দিরা গান্ধীর
হত্যাকাণ্ডের কথা। তিনি নিহত হওয়ার পর ভারতজুড়ে নৈরাজ্য আর হানাহানিতে বহু
নিরীহ শিখ নিহত হন। সে দাঙ্গা প্রশমনে সবচাইতে চমৎকার ভূমিকা রেখেছিলেন সে
দেশের সুদর্শন নেতা পরবর্তীকালে বোমায় উড়ে যাওয়া ভারতের প্রাক্তন
প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। রাজীব জানতেন এক চোখের বদলে অন্য চোখ নেওয়ার
ধারা থাকলে মানুষ অন্ধ হতে বাধ্য। একসময় পুরো জাতিই অন্ধ হয়ে যাবে। তাই
তিনি শুরুতেই বলে দিয়েছিলেন , আমার মা নিহত হয়েছে। আমি যদি শান্ত থাকতে
পারি তোমাকেও থাকতে হবে। দাঙ্গা থামানোর জন্য এমন শান্তি স্থাপনের নামই
নেতৃত্ব।
স্বাধীনতা আমাদের এমন শিক্ষা দিক যাতে আমরা বুঝতে পারি পাহাড়ি
সমতল বা যে কোন এলাকার স্বদেশী মানেই আমার আত্মীয়। যে দলকানা অন্ধ রাজনীতি
হেলমেটের ভেতর দিয়ে নিজেদের শক্তি বজায় রাখতে চেয়েছিল তারা এখন জেনে গেছে
হেলমেটের তলায় আসলে কি বা কারা ছিল? না লুকোচুরি নয়। সে কারণেই আমরা চাই
স্বচ্ছতা। দেশকে নতুনভাবে সাজানোর জন্য মুক্ত করার জন্য যারা জীবন দিলেন
তাদের প্রতি ভালোবাসা আর মানুষকে নির্ভয়ে বাঁচতে দেওয়ার নাম ই স্বাধীনতা।
প্রাজ্ঞ প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্যরা তা বোঝেন।
একাত্তর থেকে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা আর মুক্তির সংজ্ঞা নির্ধারিত হলেই আমরা ভালো থাকতে পারব, ভালো থাকব।
লেখক: ছড়াকার, প্রবান্ধিক ও কলাম লেখক।