প্রায় আট দিন
মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চলে গেলেন মাগুরার শিশু কন্যা আছিয়া। বিবেকবান
মানুষের অন্তরকে ব্যথিত করার জন্য এ রকম একটি ঘটনাই যথেষ্ট। সামনে ঈদ।
শিশুটির মা হয়তো তাকে ঈদের জামা উপহার দিয়ে খুশি হতেন, অথচ কাফনের কাপড়
পরিয়ে তাকে আতর্নাদ করতে হয়েছে। কী নির্মম বাস্তবতা!
এ তো গেল একটিমাত্র
ঘটনা। এ রকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। আগে শুনতাম, কন্যাশিশুরা যৌন নির্যাতন
বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এখন অপরাধীরা ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, হত্যাও
করছেন। পত্রিকার পাতা ওল্টালেই দেখতে পাই কন্যাশিশুদের ধর্ষণের পর হত্যার
অসংখ্য খবর। কেন এ ধরনের ঘটনা মহামারি আকার ধারণ করেছে? যারা এ ধরনের
হত্যাকাণ্ড করছে, তাদের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য নিঃসন্দেহে গবেষণার প্রয়োজন
আছে।
একটু খেয়াল করলে দেখবেন, এ ধরনের অপরাধ যারা করছে তারা পরিচিতজন
অথবা খুব কাছের মানুষ। অপরিচিত কেউ ধর্ষণ করলে অপরাধ করেই পালিয়ে যায়।
কিন্তু পরিচিত কেউ এ ধরণের অপরাধ করলে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় না, হত্যাও
করে। এর একটি কারণ হতে পারে- ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে সমাজে সে আর মুখ
দেখাতে পারবে না।
যেহেতু অপরাধীরা পরিচিতজন বা কাছের মানুষ, তাই তাদের
শনাক্ত করা খুব কঠিন। উদ্বেগের বিষয়টা এখানেই। আপনি নিজেও হয়তো জানেন না,
কোন ভদ্রবেশী শয়তান আপনার কন্যাশিশুর ক্ষতি করার জন্য সুযোগের অপেক্ষায়
আছে। বাস্তব সত্য হচ্ছে, কন্যাশিশুদের অধিকাংশই নিজ পরিবারে অথবা নিকট
আত্মীয় অথবা পরিচিত মানুষজন দ্বারা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। অনেক ক্ষেত্রেই
নীপিড়ক হচ্ছে আপন মামা, চাচা, চাচাতো ভাই, দারোয়ান, গৃহশিক্ষক, এমনকি
মাদকাসক্ত পিতা।
অধিকাংশ শিশুই লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পারে না অথবা
বয়স এতটাই কম থাকে যে নিজেও বুঝতে পারে না, অথবা মা-বাবাকেও বোঝাতে পারে
না। অনেক সময় মা-বাবাকে জানালে উল্টো তাদের কাছ থেকে অপবাদের শিকার হতে হয়।
আবার অনেক মা-বাবা বিষগুলো জানলেও শিশুর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চেপে
যায়।
ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, এই অভিজ্ঞতাকে ধামাচাপা দিলেও শিশুর অবচেতন
মনে তা ট্রমা বা ক্ষত হিসেবে থেকে যায়। এটা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশকে
মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। পরিণত বয়সেও এই ট্রমা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। পরিণত
বয়সে নারীদের আচরণগত সমস্যা ও দুর্বল ব্যক্তিত্বের একটি কারণ হচ্ছে শৈশবের
যৌন নিগ্রহ (যা তিনি কাউকে বলতে পারছেন না)। দুঃসহ এই স্মৃতিগুলো নীরবে
নিঃশেষ করে দেয় একজন নারীর অসীম সম্ভাবনা ও সাবলীল জীবনযাপনকে।
প্রশ্ন
হলো, ভদ্রবেশী এসব ধর্ষক থেকে কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা দেবে কে? এরা তো
আপনার শিশুর চারপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে, সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে আছে।
রাষ্ট্র কি পারবে আপনার কণ্যাশিশুর নিরাপত্তা দিতে? সহজ উত্তর হলো,
রাষ্ট্রের পক্ষে সব নাগরিকের বাড়ির অন্দরের নিরাপত্তা দেয়া খুব কঠিন, বলা
যায় অসম্ভব। বড়জোড় অপরাধ সংঘটনের পর অপরাধীর বিচার করতে পারবে। তাহলে এসব
ভদ্রবেশী হায়েনার ছোবল থেকে কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা দেবে কে?
এখানেই
সঠিক প্যারেন্টিংয়ের প্রাসঙ্গিকতা এসে যায়। শুধু আইন প্রয়োগ করে এসব অপরাধ
কমানো যায় না। সবার আগে প্রয়োজন অভিভাবকদের সচেতনতা। কন্যাশিশুদের ক্ষেত্রে
মা-বাবাকে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হয়, যা ছেলে শিশুদের ক্ষেত্রে না থাকলেও
চলে। কন্যাশিশুদের লালন পদ্ধতি একটু ব্যতিক্রম।
বাস্তবতা হচ্ছে,
অধিকাংশ মা-বাবা বুঝতেই পারেন না, ঠিক কী ধরনের বাড়তি সতর্কতা নেওয়া
প্রয়োজন। মা-বাবার প্রথম দায়িত্ব শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি
করা। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সুবিধা হলো: শিশু যেকোনো বিষয়ই আপনার কাছে
শেয়ার করবে, ফলে আপনি দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
তবে সবচেয়ে ভালো
পন্থা হচ্ছে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, যার প্রথম ধাপ হলো স্পর্শের রকমফের
শিশুকে বুঝিয়ে দেওয়া। কোনটা ভালো স্পর্শ, কোনটা মন্দ স্পর্শ এটা শিশুকে
জানানো। তাকে জানাতে হবে- যে স্পর্শের কথা কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না, সেটাই
মন্দ স্পর্শ। কেউ স্পর্শ করার পর যদি কাউকে এ কথা বলতে মানা করে, বুঝতে হবে
এটা মন্দ স্পর্শ। কেউ যদি ঠোঁটে, বুকে অথবা নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত
স্পর্শ করে এটাও মন্দ স্পর্শ।
কেউ যদি এ ধরনের স্পর্শ করে, তাহলে প্রথম
সুযোগেই মা-বাবাকে বলতে হবে- এ কথা শিশুকে জানিয়ে রাখবেন। পাশাপাশি কিছু
প্রতিরক্ষামূলক কৌশলও শিখিয়ে দিতে হবে। 'আমি এটা পছন্দ করছি না' কথাটি যেন
শিশু বলতে পারে, তা শিখিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া অপরিচিত কেউ যদি তাকে চকলেট বা
বিস্কুট দিতে চায়, সে যেন তা গ্রহণ না করে।
পরিবারে নিকটাত্মীয় বা
পরিচিতজন দ্বারা শিশু মন্দ স্পর্শের শিকার হচ্ছেন কিনা- এটা বোঝার একটি
উপায় হচ্ছে, নীপিড়ককে দেখলে শিশু কাছে যেতে চাইবে না, কুঁকড়ে যাবে। তবে
এগুলো ঘটলেই যে মন্দ স্পর্শের শিকার হয়েছে, এটা বলা ঠিক হবে না। তারপরেও
আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। বাসায় মেহমান এলে শিশুকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে
মেহমানের কোলে তুলে দেবেন না। শিশুকে রাতে অনিরাপদ কারও কাছে ঘুমাতে দেবেন
না। ডাক্তারের চেম্বারে শিশুকে যখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, সঙ্গে মা-বাবা
অবশ্যই থাকবেন।
শিশু কিছুটা বড় হতে থাকলে আশেপাশের বখাটে দ্বারা টিজ বা
বাজে মন্তব্যের শিকার হতে পারে। তাকে জানিয়ে রাখতে হবে, সে যেন এগুলোকে
পাত্তা না দেয়, কোনো প্রকার বিতর্ক বা প্রতিক্রিয়া না দেখায়। তবে অবশ্যই
মা-বাবাকে জানাতে হবে। এ ছাড়া স্কুলে বা অন্য কোথাও বাথরুমে আটকে গেলে শিশু
যেন জোরে চিৎকার দেয়। তিন বছর বয়স থেকেই এই প্রশিক্ষণগুলো দেওয়া শুরু করতে
হবে, যাতে সে আরেকটু বড় হলে তা ভালোভাবে রপ্ত করতে পারে।
কন্যাশিশুর
বয়ঃসন্ধিকালে অভিভাবকদের বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। বিকাশের এই পর্যায়ে
কন্যাশিশুরা যৌন সক্ষমতা অর্জন করে। রজঃস্রাব শুরু হয়। এই স্বাভাবিক
পরিবর্তন সম্পর্কে শিশুকে জানাতে হয়। অভিভাবক হিসেবে আপনার দায়িত্ব এসব
বিষয়ে লুকোচুরি না করা। আপনার কাছ থেকে সঠিক তথ্য না পেলে, শিশু তার
বন্ধুবান্ধব বা অন্য কোনো উৎস থেকে জানার চেষ্টা করবে। বিভ্রান্তিকর তথ্য
নিয়ে বেড়ে উঠলে, পরে তাদের জীবনে নানা ধরনের যৌন জটিলতা (ব্যভিচার, যৌন
বিকৃতি, দাম্পত্য অসংগতি ইত্যাদি) দেখা দিতে পারে।
এ সময় কিশোরীদের
মন-মেজাজ ও আবেগ খুব ওঠানামা করে। ঝোঁক বা উত্তেজনার বশে অনেক কিছু করে
ফেলে, যার জন্য পরে চরম মূল্য দিতে হয়। এ সময়ে শিশু ভালো-মন্দ,
করণীয়-বর্জনীয় ইত্যাদি যথাযথ বুঝতে পারে না। প্রায়ই শুনতে পাই, মিথ্যা
প্রলোভনে পড়ে মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে
আপনার খেয়াল রাখতে হবে, শিশু যেন বিপরীত লিঙ্গের কারও সঙ্গে কথাবার্তা এবং
মেলামেশার ক্ষেত্রে নৈতিক সীমা কোনভাবেই অতিক্রম না করে। বিশেষ করে অবাধ
যৌনতার ভয়াবহ পরিণাম (অকাল গর্ভধারণ, গর্ভপাত, যৌনবাহিত রোগ ইত্যাদি) এবং
এর ফলে শিক্ষাজীবনসহ ভবিষ্যত জীবন কীভাবে দুঃসহ হয়ে ওঠে, তা শিশুকে বুঝিয়ে
বলতে হবে। শেখাতে হবে এক্ষেত্রে ধর্মের শিক্ষা কী।
বাস্তবতার আরেকটি
শিক্ষা কন্যাশিশুকে জানিয়ে রাখতে হবে। ছেলেশিশুদের তুলনায় মেয়েশিশুরা
মানসিক পরিপক্কতায় কমপক্ষে দুই বছর এগিয়ে থাকে। অর্থাৎ ছেলেদের তুলনায়
সমবয়সী মেয়ে শিশুদের সহজাত বিচারবুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞান কিছুটা বেশি থাকে। তাই
কন্যাশিশুদের প্রতি অভিভাবকদের পরামর্শ থাকবে, কোনো ছেলেবন্ধু যখন তাকে
কোনো মতামত বা প্রস্তাব দেবে, সে যেন সতর্ক থাকে এবং যাচাই-বাছাই করে।
এ
ছাড়া প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারে তারা যেন খুব সাবধান থাকে। ফেসবুক, টুইটার,
ইনস্টাগ্রামসহ সব সামাজিক মাধ্যমে যেন ব্যক্তিগত ছবি কিংবা তথ্য শেয়ার না
করে। এ ক্ষেত্রে সামান্য ভুল তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে।
অভিভাবক হিসেবে আপনি নিজে শিশুর সামনে মোবাইল অথবা সামাজিক মাধ্যমে বুঁদ
হয়ে থাকবেন না। আপনার দেখাদেখি শিশুও এই বিষয়টি রপ্ত করতে পারে।
এ ধরনের
সচেতনতা হয়তো কন্যাশিশুদের নিপীড়ন পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবে না। তবে যৌন
নিগ্রহ থেকে আপনার কন্যাশিশুকে বহুলাংশে নিরাপদ রাখতে পারবেন।
লেখক: প্যারেন্টিং কলাম বইয়ের লেখক