ফিতরা
বা ফেতরা আরবি শব্দ, যা ইসলামে জাকাতুল ফিতর (ফিতরের জাকাত) বা সদকাতুল
ফিতর নামে পরিচিত। (আল-মুজামুাল ওয়াসিত, পৃষ্ঠা ৬৯৪) ইসলামি শরিয়তের হুকুম
মোতাবেক এটি একটি ওয়াজিব আমল। ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় পর্যন্ত
জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী ছাড়া নেসাব পরিমাণ বা অন্য কোনো
পরিমাণ সম্পদের মালিকদের পক্ষ থেকে গরিবদের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণের একটি
অর্থ প্রদান করার বিশেষ আয়োজনকে সদকাতুল ফিতর বলা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর
যুগে মোট চারটি পণ্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা হতো- খেজুর, কিশমিশ, জব
ও পনির। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমাদের সময় ঈদের দিন এক সা খাদ্য
দ্বারা সদকা আদায় করতাম। আর তখন আমাদের খাদ্য ছিল জব, কিশমিশ, পনির ও
খেজুর। (ইবনে মাজাহ, ২২৮২)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে গমের ভালো ফলন ছিল
না বিধায় আলোচিত চারটি পণ্য দ্বারাই ফিতরা আদায় করা হতো। এর পর হযরত
মুয়াবিয়া (রা.)-এর যুগে গমের ফলন বেড়ে যাওয়ায় গমকে আলোচিত চারটি পণ্যের
সঙ্গে সংযোজন করা হয়। আর তখন গমের দাম ছিল বাকি চারটি পণ্যের তুলনায় বেশি।
আর মূলত এই দাম বেশি থাকার কারণেই হযরত মুয়াবিয়া গমকে ফিতরার পণ্যের
তালিকভুক্ত করেছিলেন। অতএব গম দ্বারা আদায় করলে আধা সা বা এক কেজি ৬২৮
গ্রাম দিলেই ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। আর বাকি চারটি পণ্য অর্থাৎ খেজুর, জব,
পনির ও কিশমিশ দ্বারা আদায় করার ক্ষেত্রে জনপ্রতি এক সা বা তিন কেজি ২৫৬
গ্রাম দিতে হবে।
নারী-পুরুষ, স্বাধীন-পরাধীন, শিশু-বৃদ্ধ, ছোট-বড় সব
মুসলিমের জন্য ফিতরা প্রদান করা ওয়াজিব। ইবনে উমর (রা.) থেকে জানা যায়,
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক স্বাধীন ক্রীতদাস, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়
মুসলমানের জাকাতুল ফিতর এক ‘সা’ পরিমাণ খেজুর বা যব ফরজ করেছেন। তিনি
লোকদের ঈদের নামাজে বের হওয়ার আগেই তা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন। (বুখারি ও
মুসলিম)
ফিতরা দেওয়ার সামর্থ্য আছে (এক দিন ও এক রাতের খাদ্যের অতিরিক্ত
পরিমাণ সম্পদ থাকলে) এ রকম প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজের ও পরিবারের সব
সদস্যের পক্ষ থেকে ফিতরা প্রদান করা ফরজ, যাদের লালন-পালনের দায়িত্ব শরিয়ত
কর্তৃক তার ওপরে অর্পিত হয়েছে। (আল-মুগনী, ৪/৩০৭) যার নিকট এক-দুই বেলার
খাবার ছাড়া অন্য কিছু নেই তার ফিতরা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। গরিব, দুস্থ,
অসহায়, অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিরাই ফিতরার দাবিদার। তবে যার জন্য জাকাত খাওয়া
জায়েজ এবং যার ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়, এমন ব্যক্তিকে ফিতরা প্রদান করা যাবে।
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে জাকাতুল ফিতর
দান করতাম এক সা খাদ্যদ্রব্য কিংবা এক সা যব কিংবা এক সা খেজুর কিংবা এক সা
পনির কিংবা এক সা কিশমিশ (বুখারি)। এ হাদিস থেকে কয়েকটি বস্তুর নাম পাওয়া
গেল তা হলো, কিশমিশ, পনির এবং খাদ্যদ্রব্য। উল্লেখ থাকে যে, নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিগত হওয়ার পর মুয়াবিয়া (রা.)-এর খেলাফতে
অনেকে গম দ্বারাও ফিতরা দিতেন। (বুখারি, ১৫০৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর
যুগে মুদ্রা হিসেবে দিরহাম প্রচলিত ছিল। দিরহামের দ্বারা কেনাকাটা,
দান-খয়রাত করা হতো। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়,
রাসুলুল্লাহ (সা.) খাদ্যবস্তু দিয়ে ফিতরা প্রদান করতেন। এ জন্য
ইসলামবেত্তাদের বড় অংশ টাকা দিয়ে ফিতরা প্রদানের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ
করেন।
ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নতের বরখেলাফ
হওয়ার কারণে আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, তা যথেষ্ট হবে না। (মুগনী, ইবনু
কুদামাহ, ৪/২৯৫) তবে প্রয়োজনে টাকা দিয়েও ফিতরা আদায় করা বৈধ। বাংলাদেশের
মুসলিমরা টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করতে চাইলে ২: ৪০ মধ্যমানের চালের মূল্য
দিতে হবে।
বড়ই পরিতাপের ব্যাপার! পুরো দেশের সব শ্রেণির লোক বছর বছর ধরে
সর্বনিম্ন মূল্যের হিসেবে ফিতরা আদায় করে আসছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত
সবাই ফিতরা দিচ্ছে একই হিসাবে জনপ্রতি ১১০ টাকা করে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়
সবাই ভুলেই গেছে গম হচ্ছে ফিতরার পাঁচটি দ্রব্যের একটি—যা সর্বনিম্ন
মূল্যের।
উত্তম হলো, নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী বেশি মূল্যের
খাদ্যবস্তুকে মাপকাঠি ধরে ফিতরা আদায় করা। কেননা সদকার মূল লক্ষ্যই হলো
গরিবদের প্রয়োজন পূরণ ও তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ। এ ছাড়া আদায়কারীর
সামর্থ্যকেও বিবেচনায় রাখা উচিত। কেননা কেউ এক হাজার টাকা মূল্যের খেজুর
খেতে অভ্যস্ত হয়ে যদি পঁচিশ/ত্রিশ টাকা মূল্যের গমের হিসাবে ফিতরা দেন—তবে
তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? সে প্রশ্ন বিবেকের কাছে থেকেই যায়।