ঈদ
সারাবিশ্বের মুসলমানদের একটি বড় উৎসব। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর এই
বাংলাদেশে এটি অত্যন্ত আনন্দময় বৃহত্তম বাৎসরিক একটি উৎসব। মুসলমানরা ছাড়াও
অন্য ধর্মের মানুষেরাও এ উৎসবে শামিল হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব
মানুষ যার যার মতো করে এই আনন্দে সামিল হয়। ঈদ মানুষে-মানুষে আত্নিক
বন্ধনকে দৃঢ় করে। দিন যত যাচ্ছে ঈদকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত
শ্রেণীর মধ্যে উৎসবমুখীতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি একটি উপলক্ষ হিসেবে কাজ করছে
যাকে কেন্দ্র করে আর্থ-সামাজিক জীবনে অনেক নতুনত্ব যোগ হচ্ছে।
ঈদের
অর্থনীতির আকার দিনে দিনে বড় হচ্ছে। এক সময় এটা ভালোমন্দ খাওয়া-দাওয়ার
মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, দিনে দিনে এটির সাথে অন্যান্য অনুষঙ্গ যুক্ত হয়ে
‘ঈদ অর্থনীতি’ নামে নতুন একটি উপখাত যুক্ত হয়েছে। ঈদের দিনকে কেন্দ্র করে
পুরো রমজান মাস জুড়ে চলতে থাকে পরিকল্পনা। ক্রেতারা যেমন ভাবতে থাকেন কি
কিনবেন, কোথা থেকে কিনবেন, কার কার জন্য কিনবেন, কোন মানের ও দামের জিনিস
কিনবেন, কোথায় সাশ্রয়ী বা হ্রাসকৃত মূল্যে পাবেন, তেমনি বিক্রেতারা বা
দোকানীরা বা বড় বড় শপিং সেন্টার এর কর্ণধাররাও ভাবতে থাকেন এবার নুতন কি
আকর্ষণীয় ডিজাইন বা মানের পণ্য ক্রেতাদের উপহার দিতে পারেন। তাই রমজান
শুরুর আগ থেকেই বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু হয়। কোন কোন পণ্যে ছাড় দেয়া হবে তা
জানান দেয়া হয়, কেন তার পণ্যটি সেরা সেটারও ধামাকা প্রচার চলতে থাকে। দিন
যাওয়ার সাথে সাথে নতুন নতুন ধারণা যুক্ত হচ্ছে। যেমন কোন আউটলেট থেকে কিনলে
কত ছাড় পাওয়া যাবে, বিকাশ বা ক্রেডিট কার্ডে কিনলে কি সুবিধা পাওয়া যাবে,
কত পরিমাণ কিনলে কতটুকু ছাড় পাওয়া যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি বড় বড়
কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন এর কিউ আর কোড থেকে পণ্য বাছাই করলে সে
ক্ষেত্রে ছাড়ের সুযোগ রেখেছে। বড় বড় সেলিব্রেটিদের দিয়ে ঈদের বিজ্ঞাপনও
সাজানো হচ্ছে।
একসময় ঈদের দিনের জন্য নতুন পোষাক-জুতো হলেই চলতো।
কিন্তু এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে সাজ-গোজের অন্যান্য উপকরণ, জুয়েলারি পণ্য,
ঘর সাজাবার জিনিসপত্র, মোবাইল ফোনের মডেল পরিবর্তন, হেডফোন কেনা, ঈদের
ছুটিতে কোথায় কোথায় যাওয়া যাবে তা নির্ধারণ করা ইত্যাদি। এমনকি সাজ-গোজ
করার জন্য মেয়েদের বিউটি পার্লার এবং ছেলেদের জন্য সেলুনগুলো বিভিন্ন অফার
ঘোষণা করে। ঈদে অতিথি আপ্যায়নে মিষ্টি ও মজাদার খাবার কেনাকাটা বাবদ অনেক
খরচ হয়। এ সময় সুস্বাদু রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় মসলা কেনাকাটায় কয়েকশ কোটি
টাকা খরচ হয়। ঢাকার কাছে এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন রিসোর্ট ও পর্যটন
কেন্দ্রগুলোতে সাজ সাজ রব তৈরী হয়, এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করা
হয়। এ সময়ে কক্সবাজার, কুয়াকাটাসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলো পর্যটকদের
পদভারে সরগরম হয়ে উঠে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)
এর মতে, এ বছর ঈদকে কেন্দ্র করে পর্যটন খাতে ২ হাজার কোটি টাকার টার্গেট
করা হয়েছে। ঈদকে কেন্দ্র করে যাকাত ও ফিতরা বিতরণ বাবদ অর্থনীতিতে লেনদেন
হয়। যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাকাত সংগ্রহ করা সম্ভব হত তাহলে তা ১ লক্ষ কোটি
টাকা ছাড়িয়ে যেত বলে একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
ঈদের ছুটিতে
পরিবারের সাথে সময় কাটাতে মানুষ যেমন গ্রামমুখী হয়, তেমনি পর্যটন কেন্দ্রে
যাওয়াকে কেন্দ্র করে বাস, ট্রাক, লঞ্চ, বিমান এর টিকেট কাটা নিয়েও ব্যস্ততা
তৈরী হয়। ধারণা করা হচ্ছে পবিত্র ঈদ উল ফিতর উপলক্ষে রাজধানী ঢাকা ও
নিকটবর্তী জেলাগুলো থেকে প্রায় ১ কোটি ৭৩ লক্ষ মানুষ ঈদযাপন করতে গ্রামে
যাবেন। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষ সড়কপথ ব্যবহার করবেন বাকি ৪০ শতাংশ নৌ ও
রেল পথে যাবেন। এ যানবাহনের ভাড়া বাবদ বড় একটি আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন হবে।
ভ্রমণের সময় মালামাল বহনের জন্য বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন দামের
ব্যাগ/স্যুটকেস এর চাহিদা তৈরী হবে। মোদ্দা কথা ঈদকে কেন্দ্র করে
অর্থনীতিতে বিরাট একটা প্রেষণা তৈরী হয়। বিরাট আকারের অর্থনৈতিক লেনদেন
সংঘটিত হয়। কোন কোন দোকানি সারাবছর এ ঈদকে কেন্দ্র করে বেচাকেনার জন্য
অপেক্ষা করেন, এ সময়ের অর্জিত লাভকে সারাবছর এর ব্যবসার সাথে সমন্বয় করে
টিকে থাকার চেষ্টা করেন।
ঈদের অর্থনীতির লেনদেন এর বিষয়ে তেমন কোন
গবেষণা পাওয়া যায় না। তবে দোকান-মালিক সমিতির নিজেদের একটি হিসাব মতে ২০২৪
সালে ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো লেনদেন হয়েছে,
এর মধ্যে ৩৭,৪০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে কাপড় কেনাকাটা বাবদ। ঈদকে কেন্দ্র
করে বেশ বড় আকারে রেমিট্যান্স দেশে আসে। এ রেমিট্যান্সের অর্থ ঈদের
কেনাকাটায় ব্যয় হয়ে অর্থনীতিতে যুক্ত হয়। ঈদে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের
বোনাস, প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স, বেসরকারি খাতে
কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বোনাস, অপ্রতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিতদের প্রাপ্ত বাড়তি
মজুরি সবই অর্থনীতিতে যুক্ত হয়। এর আকার প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়ায়।
বোনাসকে কাজে লাগিয়ে অনেক পরিবারেই হাউজহোল্ড জিনিষ যেমন: ফ্রিজ, এসি,
মাইক্রোওয়েভ ওভেন ইত্যাদি ক্রয় করে থাকে। ঈদকে কেন্দ্র করে আমদানি বৃদ্ধি
পায়, সেটা মেটাতে অর্থনীতি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বেরিয়ে যায়।
ঈদকে
কেন্দ্র করে বিভিন্ন মিডিয়া হাউজগুলো ব্যস্ত সময় পার করে। ঈদের জন্য নাটক,
আনন্দ মেলা, টেলিফিল্ম, সিনেমা জগতে নতুন ছবি মুক্তি দেওয়ার হিড়িক পরে যায়।
এক মাস ধরে চলতে থাকে এগুলোর প্রচার-প্রচারণা। ঈদ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন
পত্রিকা হাউজ থেকে নামকরা লেখকদের ছোট গল্প, উপন্যাস, রম্য গল্প, ভ্রমন
কাহিনী ইত্যাদির সংকলন করে ঈদের বিশেষ ম্যগাজিন বের করা হয়। এর জন্যেও অনেক
পাঠক, দর্শক, নাটক ও সিনেমা প্রেমীরা বাজেটের একটা বড় অংশ খরচ করে।
ঈদকে
কেন্দ্র করে বড় বিজনেস হাউজ এর চেয়ে খুচরা বিক্রেতারাই বেশী প্রভাবিত হন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘বিতরণ ব্যবসা জরিপ-২০২২’ প্রতিবেদন মতে খুচরা
ব্যবসা খাতে অধিকাংশ আয় অর্জিত হয় ঈদুল ফেতরকে কেন্দ্র করে। এ সময়
দেশব্যাপী প্রায় ২৫ লাখ দোকানে কেনাকাটা সম্পন্ন হয়। বর্তমান সময়ে অনেক
ক্রেতা মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটার ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনলাইনে কেনাকাটা
সম্পন্ন করেন। ঈদকে কেন্দ্র করে অনেক নতুন উদ্দোক্তা তৈরী হয়।
ঈদকে
কেন্দ্র করে অনেক সামাজিক কার্যক্রম সংগঠিত হয়। এ সময় এ উৎসব উপলক্ষ্যে
পরিবারের সদস্যদের একত্রিত হওয়ার সুযোগ তৈরী হয়। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে
অনেক পরিবার বিয়ে-শাদি বা অন্যান্য পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন
করে থাকে। এতে করে ঈদের উৎসব পর্বটি আরো একটু প্রলম্বিত হয়। ইদানীং কালে ঈদ
পরবর্তিতে বিভিন্ন সামাজিক/সাংস্কৃতিক সংগঠন ঈদ পুণর্মিলনী, ঈদ আনন্দমেলা
ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এসব অনুষ্ঠান একদিকে যেমন পারিবারিক ও
সামাজিক বন্ধনকে আরো দৃঢ় করে তেমনি এসব আয়োজনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে
লেনদেন সংঘটিত হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঈদ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
পর্ব। ক্রেতা-বিক্রেতা দুইই সারা বছর এই সময়ের জন্য মুখিয়ে থাকেন। সব
মিলিয়ে ঈদে বিপুল পরিমাণ লেনদেন হয় যা দেশের অর্থনীতিতে মোট দেশজ উৎপাদন
বৃদ্ধি করে, নতুন ব্যবসায়ি ও উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরী করে, বিপুল সংখ্যক
শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়। অর্থনীতিতে সুখী সুখী ভাব তৈরী হয়। অর্থনীতিতে
সুখী ভাব জন্মানো দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য খুবই ভাল একটা প্রভাব তৈরীতে
ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথে অভ্যন্তরীন
চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া এবং এ চাহিদা মেটাতে যে আর্থিক লেনদেন হয় তা আসলে
মানুষে-মানুষে এক ধরণের সুখ এর বিনিময় হয় বলে ধারণা করা যায়। এই সুখ এর
বিনিময় এর ক্ষেত্রে আমাদেরকে পিছিয়ে পড়া মানুষদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সবার মধ্যে সুখের অনুভুতি ছড়িয়ে দিতে হবে, সবাইকে নিয়ে সুখি হওয়ার চেষ্টা
করতে হবে।
লেখকঃ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।