নিরাপদ ও যানজটমুক্ত সড়কের প্রত্যাশায় ট্রাফিকিং বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছে কুমিল্লার রোভার স্কাউটরা। প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা রোজার মধ্যে রোদ্রকে উপেক্ষা করে দক্ষতার সাথে করে যাচ্ছে। আর্তমানবতার সেবা, বিভিন্ন দুর্যোগ বিপদে-আপদে মানুষের পাশে রোভার স্কাউট সদস্যরা বছরব্যাপী বহুবিধ স্বেচ্ছাসেবা প্রদানসহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে।
সেবাই রোভার স্কাউটের মলূমন্ত্র। রোভারা নিজের সুখ ও সুবিধার কথা বিবেচনা না করে অপর মানুষের উপকার করায় আনন্দ পায় বেশি। পরের উপকার করলে পৃথীবিতে মানুষের বসবাস সুখের হয়। আর নিজের মনে আসে প্রশান্তি। অনেকে নিজের লাভের জন্য অপরকে শোষণ করে। ফলে এক জনের কাছ থেকে অর্থ-সম্পদ অপর জনের হাতে চলে যায়। পরিণামে মানুষের মাঝে উঁচু-নিচু পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। দুনিয়াতে কিছু লোকের জীবন সুখে ভরা। আর বেশির ভাগ লোকের জীবনে সুখের পরিমান কম। কিছু মানুষ দুবেলা পেট ভরে খেতে পারে না এমন ও অনেক আছে। অভাব-অনটনে দুঃখ-কষ্টে অনেক লোকের দিন কাটছে। এতে পৃথিবীর জীবনে পরিপূর্ণ সুখ আসতে পারে না। এই বেদনাকাতর পৃথিবীতে শুধু নিজের কথা চিন্তা করলে তাকে যথার্থ মানুষ বলে মনে করা যায়?
নিজের সুখ ভোগের ইচ্ছা কারও সবটুকু মিটে না। আশার কোন শেষ নেই। সে জন্য নিজের মনে লাভের লোভ থাকলে কখনও শান্তি আসতে পারে না। পরোপকারের মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত রোভার স্কাউটেরা তাই নিজের লাভের কথা ভুলে গিয়ে অপরের কল্যাণের জন্য কাজ করে। নিজের জীবন সফল করা ও পরের জীবনে হাসি ফোটানোর যে সাধনা রোভার স্কাউটদের তা রূপ লাভ করে পরোপকারের ইচ্ছা থেকে।
রোভার প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করতে বাইরের জগতে রোভার স্কাউটরা বিচরণ করে। তারা মানুষের সাথে মিশে মানুষের দুঃখ বেদনা বোঝে। কিভাবে কাজ করলে তাদের দুঃখ দূর হবে তা তারা জানে। রোভার স্কাউটরা মনে করে যে, নিজের স্বার্থের কাজ করার মাঝে কোন আনন্দ নেই। সকল মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করাতেই জীবনের সফলতা। পরের উপকারের মহৎ প্রেরণা রোভার স্কাউটদের মনে সজাগ থাকে বলে তারা প্রতিজ্ঞা বাণীতে সর্বদা উপরকে সাহায্য করার কথা বলে। যারা মানুষের উপকার করবে বলে শপথ নিয়ে থাকে, তাদের কাছে পরের কল্যাণ করা ছাড়া আর কোন বড় কাজ নেই।
স্কাউটিং বিশ্বব্যাপী একটি অরাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবামূলক আন্দোলন। আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রবার্ট স্টিফেনসন স্মিথ লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল অব গিলওয়েল। ১৯০৭ সালে ইংল্যান্ডের ব্রাউন সি দ্বীপে ব্যাডেন পাওয়েল মাত্র ২০ জন ছেলে নিয়ে একটি পরীক্ষামূলক ক্যাম্প আয়োজন করেন। তারপর ধীরে ধীরে এই আন্দোলন ইংল্যান্ড, আমেরিকা হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র ২০ জন থেকে এখন সারা বিশ্বে স্কাউটের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সাল থেকে এ দেশে স্কাউটিং কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে বাংলাদেশে স্কাউট আন্দোলনে জড়িত প্রায় সাড়ে ২২ লাখ। পরিসংখ্যানের হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান সারা বিশ্বে পঞ্চম। বাংলাদেশের স্কাউট আন্দোলন তিনটি শাখায় বিভক্ত প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৬ থেকে ১০ বছর বয়সীদের জন্য কাব স্কাউটিং। স্কাউট শাখার বয়সসীমা ১১ থেকে ১৬ এবং রোভার স্কাউটদের বয়সসীমা ১৭ থেকে ২৫ বছর। এছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রশিক্ষণ নিয়ে ইউনিট লিডার বা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এছাড়া সেবার মানসিকতাসম্পন্ন যে কেউই স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে স্কাউট আন্দোলনে জড়িত হতে পারেন সব সময়।
স্কাউটেরা নিজেদের পৃথক পরিচয়ের জন্য গলায় যে স্কার্ফ পরে তাতে তারা একটি গেরো দিয়ে রাখে। ভাল কাজ করার কথা মনে রাখার জন্য এই গেরো দেয়া। যখন কোন ভাল কাজ করা হয়ে যায় তখন সে গেরো খুলে ফেলা হয়। ভাল কাজের গেরো দিয়ে স্কাউটেরা নিজেদের সুন্দর মনের চমৎকার পরিচয় দান করে।
বাংলাদেশ স্কাউটস রোভার অঞ্চলের লিডার ট্রেইনার প্রতিনিধি অধ্যাপক মো. আবু তাহের রোভার স্কাউটের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, রোভার স্কাউট একটি অনন্য সংগঠন যার মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘সেবা’। সেবার মনসিকতা নিয়ে আত্মপ্রত্যয়ী রোভার ছেলে ও মেয়েরা সমাজের মানুষের সেবায় তাৎক্ষণিক সাড়া দিয়ে থাকে। রক্ত দান কার্যক্রম, বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, হজ¦ ক্যাম্পে হাজীদের সেবা প্রদান, স্বাস্থ্য সেবা ও টিকাদান কার্যক্রমে রোভারগণ সেবা প্রদান করে থাকে। বিশেষ সময়ে ট্রাফিক সেবা, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিভিন্ন জনসচেতনতা সৃষ্টি ও বিপন্ন মানুষের প্রতি সেবার হাত প্রসারিত করতে রোভারগণ সদা প্রস্তুত থাকে।
জীবনকে সফল করতে হলে পৃথিবীকে সুখকর করে তুলতে হবে। স্কাউটরা এ কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে ও নিজেদেরকে সেভাবে তৈরি করে। মানুষের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ানোর মত সাহস তাদের আছে। যে কোন রকম সমস্যা মোকাবিলায় রোভারা কৌশলী ভুমিকা রাখে। কোন দুর্ঘটনায় প্রাথমিক প্রতিবিধান দেয়ার শিক্ষা আছে স্কাউটদের। নানা রকম শিক্ষার সুযোগে যে কোন অবস্থাতেই স্কাউটরা বিপদে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে।
নিজের ভাবনা নিয়ে এ জগতে সবাই ব্যস্ত। কিন্তু রোভার স্কাউটেরা একটু ব্যতিক্রম। অপরের জন্য কিছু করতে হবে এমন বিবেচনা করার লোকের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু পরের জন্য দরদ থাকা সমাজের চাহিদার মধ্যে পরে। যেখানে অপরের প্রতি সহানুভূতি নেই, বরং নিজের জন্যই কেবল ভাবনা থাকে, সেখানে যথার্থ মানুষের কোন গুণ থাকে না। রোভার স্কাউটরা সুখী হতে চায় অপরে সুখের সুযোগ এনে দিয়ে। মানুষ হওয়ার জন্য পরোকারের মত মহৎ গুণের চর্চা দরকার। এ প্রসঙ্গে স্কাউট আন্দোলনের প্রবর্তক ব্যাডেন পাওয়েলের একটা কথা মনে করা যায়: সুখ লাভের আসল উপায় হল অপরকে সুখী করা। পৃথিবীটাকে যেমন পেয়েছ তার চেয়ে অধিক সুন্দর করে রেখে যেতে চেষ্টা কর।
একথার মাঝে মানুষের দায়িত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পৃথিবীতে বর্তমানে যারা বসবাস করছে তাদের সুখের জন্য অতীতে বহু মানুষ কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে গেছে। তাই এখনকার মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন হলে চলবে না। ছোট হোক কিংবা বড় যে কোন কাজ যদি পরের উপকারে আসে তাতেই মহৎ মনের পরিচয় প্রকাশ পায়। রোভার স্কাউটদের হাতে খুব বড় কাজ করার তেমন সুযোগ হয়ত আসে কম। কিন্তু ছোট ছোট উপকারের ফলেও মানুষের অনেক কল্যাণ ঘটতে পারে। পরোপকারের এমন মহান আদর্শ সব রোভার স্কাউটকে প্রেরণা দেয়। তাদের কাজে কর্মে সে প্রেরণা সার্থকভাবে ফুটে ওঠে।
লেখক: সম্পাদক, বাংলাদেশ স্কাউটস, কুমিল্লা জেলা রোভার, ও প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ