‘ শিল্পের গ্যাস আবাসিকে ব্যবহারের অভিযোগ’ ৬০% নারী কর্মী, যাদের বেতন ভাতাও পর্যাপ্ত নয়

কুমিল্লার
বিজয়পুর মৃৎশিল্প কারখানার পরিচিতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। আগেও
বিচ্ছিন্নভাবে বিজয়পুর থেকে মাটির তৈরী ফুলের টব, মটকা, তৈজসপত্র, টেরাকোটা
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে বিদেশে রপ্তানি হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সরাসরি
মাটিরপাত্র রপ্তানি হয়েছে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়। দেশে ও দেশের বাইরে
মাটির তৈরী পণ্যের ভালো চাহিদা থাকলেও শুধুমাত্র জ¦ালানি গ্যাসের সঙ্কটে
থেমে গেছে রপ্তানিপণ্য উৎপাদন। অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনবল থাকা সত্ত্বেও ধুঁকছে এই
শিল্প প্রতিষ্ঠানটি। সমবায় সমিতির মাধ্যমে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি
অভিযোগ, শিল্পের গ্যাস অনিয়ম করে দেয়া হয়েছে আবাসিকে। যে কারণে পর্যাপ্ত
চাপ না থাকায় প্রয়োজনীয় উত্তাপে পোড়ানো যায় না রপ্তানিযোগ্য মাটিরপণ্য। তবে
অভিযোগ সঠিক নয় বলে জানিয়ে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস্ লিমিটেড বলছে,
পর্যাপ্ত গ্যাস পেতে তাদের ভিন্ন সংযোগের আবেদন তরা উচিত।
বিজয়পুর
মৃৎশিল্প কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, মাটির দলা তৈরি থেকে শুরু করে বিক্রয়
পর্যন্ত সবাই প্রায় নারী কর্মী। মাটি দিয়ে বানানো পণ্য পোড়ানোর মত কঠিন
কাজ কিংবা টেরাকোটার উপর চিত্রকর্ম আঁকা সব কিছুতেই অংশগ্রহন আছে নারীরা।
দেশ বিদেশে বিখ্যাত কুমিল্লার বিজয়পুর মৃৎ শিল্প কেন্দ্রে ৫০ জন কর্মীর
মধ্যে ৩০ জনই নারী। কর্মীদের ৬০ শতাংশ যেমন নারী কর্মী, এই কর্মীরাই আবার
পুরো শিল্পপল্লীর ৬০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। অথচ কাজ অনুযায়ী বাড়ে না
তাদের মজুরি বা বেতন। বর্তমানে এই শিল্পকেন্দ্র থেকে মাসে গড়ে ৮ লাখ টাকার
মৃৎপণ্য দেশীয় বাজারে বিক্রি হয়। যদি রপ্তানির চাহিদা থাকে তাহলে তা আরো
বেড়ে যায়। কর্মীদের প্রায় সবাই জানালেন, উৎপাদন না বাড়লে আয় থাকে না
সমিতির। পর্যাপ্ত জ্বালানি গ্যাস না থাকার কারণে বছরের পর বছর উৎপাদনের হার
কমে আসছে। অথচ এই মৃৎশিল্প কেন্দ্র থেকেই বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে মাটির
জিনিসপত্র। সবার দাবি, এই মৃৎশিল্প কেন্দ্রটি গ্যাস সঞ্চালন লাইন সচল করে
দেয়া হোক খুব শিগগিরই। এতে যেমন বিদেশে রপ্তানিযোগ্য পণ্য তৈরি সম্ভব হবে
তেমনি প্রাণ চাঞ্চল্য বাড়বে কর্মীদের মাঝেও।

ঘুরে
দেখা, মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্য তৈরি করতে স্তূপ থেকে মাটি কেটে কেটে
দিচ্ছেন পুরুষ কর্মীরা। এরপরই তা আকৃতি দেয়ার জন্য যে গলা তৈরি করতে হয় তা
করছেন নারীরাই। এরপর ছাঁচে বসিয়ে পাত্র তৈরি, সেটি করতেও মেশিনে কাজ করছেন
অন্তত দশজন। এছাড়া ফুলের টব, তেজপত্র এবং ট্যারাকোটায় যে শিল্পকর্ম করতে
হয় তাতেও হাত লাগাচ্ছেন তারা। কাঁচা মাটির পণ্য তৈরি শেষ হলে তারপর দিতে
হয় রোদে, এই কাজেও নারীদের দৌড় ঝাপ দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি। শুকনো মাটির
পণ্য লাকড়ির যে চুল্লি সেখানে নিয়ে আসা এবং আগুন দেয়ার কাজেও তাদের সমান
অংশগ্রহণ। পোড়ামাটির তৈরি পণ্য প্যাকেজিংয়ের জন্য কাজ করছে নারী কর্মী,
বিক্রয় কেন্দ্রের দায়িত্বে আছেন দুইজন নারী। সবমিলিয়ে পুরো মিট শিল্প
কেন্দ্রের ৬০ শতাংশ কাজই হয়ে থাকে নারীদের হাতে। তাদের বেশিরভাগেরই বাড়ি
স্থানীয় বিজয়পুর গ্রামে।
মৃৎশিল্প পল্লীর কর্মী রিংকু রানী পাল বলেন, ৭
বছর ধরে মাটির কাজ করছি। মাটির কাঠামো তৈরী থেকে শুরু করে পোড়ানো সব কাজই
নারীরা করেন। এখানে কারো কোন নির্ধারিত কাজ নেই। যখন যে কাজ পাবেন সে
সেটাই করবেন।
রাখী পাল বলেন, ৮ বছর ধরে চাকা ঘুরিয়ে মাটির দলা থেকে
ফুলের টব, পাতিল, থালা বাসন বানিয়ে আসছি। পুতুলসহ নানান খেলনাও বানাতে
পারি। শ্বশুর বাড়ি এসে বংশপরম্পরায় এ কাজে এসেছি। আগে বাড়িতে কাজ হত, এখন
আর হয় না। তাই কারখানায় এসেছি। বাবার বাড়ি থেকে কিছুই শেখা হয় নি, দেখে
দেখে সব শেখা।
শিল্পপল্লীর কর্মী পার্বতী রানী পাল বলেন, ৯ বছর আগে ৩
হাজার টাকা বেতনে কাজ শুরু করি। এখন বেড়ে ৯ হাজার ৩শ টাকা বেতন। ৮ ঘন্টার
কাজ। খাবার নিজের খরচে। এখানে সর্বোচ্চ বেতন ১৫ হাজার টাকা।
পার্বতী পাল আরো বলেন, এখানে ৮০% কাজ নারীরাই করে। টেরাকোটা থেকে শুরু করে দইয়ের পাতিল সবই বানানো হয় এখানে।
সীমা
রানী দে বলেন, এখন কুমিল্লার মৃৎ শিল্প পণ্য বিদেশেও রপ্তানি হয়। আমাদের
হাতে বানানো জিনিস বিদেশে যায়- শুনলেও ভালো লাগে। কিন্তু সকাল ৯ টা থেকে
সন্ধ্যা ৬ পর্যন্ত কাজ করে যে বেতন পাই তাতে কোন ভাবেই পোষায় না।
বিক্রয়কর্মী
লতা মজুমদার বলেন, এখন সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় দইয়ের পাতিল ও খাবারের
পাত্র। এছাড়া শৌখিন তৈজসপত্র, ফুলের টব, টেরাকোটা, খেলনা সামগ্রীও বিক্রি
হয়। খাবার পাত্র আর ফুলের টবের বেশ কয়েকটি চালান মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরেও
রপ্তানি হয়েছে।
আক্ষেপ করে লতা মজুমদার বলেন, আমাদের কর্মীদের যা
প্রাপ্য বেতন আমরা আসলে তা পাই না। উৎপাদন না হলে আয় পারবেনা বেতনও হবে না
এটাই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি।
রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমিতির হিসাবরক্ষক
রাজেশ চক্রবর্তী জানান, আমরা ২০১৯ সাল থেকেই গ্যাস পাই না। তাই তিনটি
গ্যাসের চুল্লীই বন্ধ রয়েছে। এখন লাকড়ি দিয়ে পোড়ানো হয় মাটির পণ্য। এতে
পণ্য উৎপাদনের খরচ বাড়ে। আমাদের পণ্য দেশের বাইরে বিদেশে ভালো চাহিদা আছে।
তবে গ্যাস সংকটের কারনে উন্নত মানের পন্য তৈরী না করতে না পারায় আমরা
চাহিদামত জিনিসপত্র দিতে পারছি না। সাম্প্রতিক সময়েও আমরা মালয়েশিয়া এবং
সিঙ্গাপুরে দইয়ের পাত্র রপ্তানি করেছি।
বিজয়পুর মৃৎশিল্প কেন্দ্রে
পরিচালনার দায়িত্বে থাকা রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমিতির সভাপতি দ্বীপক চন্দ্র
পাল বলেন, ১৯৬১ সালের প্রতিষ্ঠানটির শুরু। চাহিদার সাথে যোগানের ভরসাম্য
রাখতে ১৯৯১ সালে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়। সেসময় উৎপাদনও ভালো ছিলো। বিগত দুই
দশক ধরে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস্ লিমিটেড এই শিল্প প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব
সংযোগ থেকে অনিয়ম করে দুই হাজারের বেশি আবাসিক সংযোগ দেয়। আর এতেই শুরু হয়
বিপত্তি। গ্যাস কম আসায় বন্ধ হয়ে গেছে ৩ টি চুল্লী। লাকড়ি দিয়ে মাটির পণ্য
পোড়াতে সময় লাগে বেশি, উৎপাদনও হয় কম। শিল্পকেন্দ্রের উৎপাদন কমলে আয় কমে
যায়, আর যে আয় হয় তা দিয়ে কর্মীদের পর্যাপ্ত বেতন দেয়া সম্ভব হয় না।
বাখরাবাদ
গ্যাস সিস্টেমস্ লিমিটেড এর উপ মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় ডিপার্টমেন্ট)
প্রকৌশলী মোঃ আবদুর রাজ্জাক বলেন, বিজয়পুর মৃৎশিল্প কর্তৃপক্ষ যে অভিযোগ
করেছেন তা ঠিক নয়। কেউ যদি আগে সংযোগ নেয় সেটি ‘ডেডিকেটেড বা নিজস্ব’ হয়
না। যেহেতু চাহিদা আছে সেক্ষেত্রে ওই সংযোগ থেকে আরো সংযোগ গিয়েছে। এছাড়া
তাদের কাছে আমাদের অনেক বিল পাওনা রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে আমাদের যে গ্যাস
সংকট তৈরী হয়েছে সে কারণে তারা গ্যাস পায় নি।
তবে এই সমস্যার সমাধান
হিসেবে প্রকৌশলী মোঃ আবদুর রাজ্জাক বলেন, আমরা মৃৎশিল্প কেন্দ্রকে বলেছি
কুমিল্লা-নোয়াখালী মহাসড়ক থেকে সড়ক বিভাগ ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে
নতুন একটি সংযোগের আবেদন করতে পারে। ওই দিকের সংযোগে গ্যাসের ভালো চাপ
আছে, সেখান থেকে তারা উপকৃত হতে পারেন।