বুধবার ১৬ এপ্রিল ২০২৫
৩ বৈশাখ ১৪৩২
শব্দ দূষণঃ আমাদের নাগরিক জীবনে অদৃশ্য ঘাতক
মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী
প্রকাশ: বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫, ১:৩২ এএম |

 শব্দ দূষণঃ আমাদের নাগরিক জীবনে অদৃশ্য ঘাতক
আমাদের ব্যস্ত নাগরিক জীবনে ‘শব্দ দূষণ’ ইতোমধ্যেই একটা প্রকট সমস্যা হিসেবে অবির্ভূত হয়েছে। পরিবেশগত সমস্যার মধ্যে অন্যতম মানুষের নিজের সৃষ্ট ‘শব্দ দূষণ’। এটি আমাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাকে নষ্ট করছে এবং দীর্ঘ মেয়াদে গভীর বিপর্যয় ডেকে আনছে। টানা দীর্ঘ সময় উচ্চ মাত্রার শব্দযুক্ত এলাকায় অবস্থান করার ফলে শ্রবণশক্তির উপর চাপ পড়ছে। ফলে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বাড়ছে, নিদ্রাহীনতা দেখা দিচ্ছে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে। রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে গাড়ির শব্দ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাইকিং, নির্মাণ কাজের শব্দ, কলকারখানার শব্দ, গাড়িসহ সকল ধরণের যানবাহনের হর্ণ এবং এর সাথে আরো নাম না জানা শব্দের সমারোহ এক ধরণের ভীতিকর ও অসহ্য অবস্থা তৈরী করছে। বিরক্তিকর এবং অসুরের এসব শব্দমালার ভিড়ে মানুষ এখন শ্রুতি মধুর শব্দমালা যেমন নদীর কলতান, বাঁশির সুর, পাখির ডাক, বাতাসের ঝিরি ঝিরি শব্দ ইত্যাদি ভুলতে বসেছে। 
আমাদের শ্রবন ইন্দ্রিয়ের মূল অংশ কান খুব জটিল এবং চমৎকার একটি প্রক্রিয়ায় শব্দ গ্রহণ করে। মূলত: শব্দ তরঙ্গ ধরা, সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করা এবং মস্তিস্কে প্রেরণ করার মাধ্যমে তিনটি ধাপে শব্দমালা আমাদের শারীরিক ও মানসিক প্রক্রিয়ায় সংযোজিত হয়। তাই যখন প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়ে উচ্চতর শব্দ তরঙ্গ আমাদের বহি:কর্ণে আঘাত করে তখন সেটি প্রক্রিয়াগত দিক থেকে এক ধরণের অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি করে এবং এটি শরীর ও মনের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। একটি সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার জন্য বা দৈনন্দিন কাজকর্ম করার জন্য যতটুকু শব্দের আওতায় থাকা প্রয়োজন, তার অতিরিক্ত শব্দ যদি দেহের ও মনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, ধরে নেওয়া যায় সেটাই শব্দ দূষণ। 
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি বেগবান করেছে বিশ্বের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। বাংলাদেশেও দ্রুত গতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে। কিন্তু প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি গুণগত উন্নয়ন নিশ্চিত না করার কারণে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। পরিবেশ দূষণ মুল ৪টি কারণে ঘটে-বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণ ও শব্দ দূষণ। আমরা শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টির মাধ্যমে কথা বলি পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ করি। কিন্তু এই শব্দই যখন বিভিন্ন কারণে নির্ধারিত মাত্রা অতিক্রম করে তখনই শব্দ দূষণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। 
যানবাহনে ব্যবহৃত উচ্চশব্দের হর্ণ শব্দদূষণের অন্যতম কারণ। যানবাহনের উচ্চশব্দের হর্ণ মানুষের শ্রবণ ক্ষমতায় আঘাত করে। এতে শুধু গাড়ির আশে-পাশের মানুষজন, গাড়িচালক নিজে এবং ট্রাফিক পুলিশ ক্ষতিগ্রস্থ হন। শহর এলাকার জনগণ নতুন ভবন নির্মাণে কাজে সৃষ্ট শব্দ, বিদ্যুৎ চলে যাবার পর জেনারেটরের শব্দ, উচ্চমাত্রার হর্ণ, লাউডস্পিকারের শব্দ, নির্বাচন, বিজ্ঞাপনসহ বিভিন্ন কারণে যেখানে সেখানে মাইক ব্যবহার ইত্যাদি কারণে শব্দ দূষণের শিকার হচ্ছেন। 
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচী (ইউএনইপি) বার্ষিক ফ্রাস্টিয়ারস রিপোর্ট-২০২২ এর প্রতিবেদন মতে শব্দদূষণ দেশের বিশ্বের শীর্ষ ৫টি শহরের মধ্যে বাংলাদেশের ঢাকা ও রাজশাহী রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাচিত আবাসিক এলাকার ও বাণিজ্যিক এলাকার জন্য অনুমতি যোগ্য শব্দ সীমার (যথাক্রমে ৫৫ ও ৭০ ডেসিবেল) তুলনায় ঢাকা ও রাজশাহীতে শব্দের মাত্রা যথাক্রমে ১১৯ ডেসিবেল ও ১০৩ ডেসিবেল পাওয়া গেছে বলে সে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ৬০ ডেসিবেল শব্দে মানুষের শ্রবণশক্তি সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, ১০০ ডেসিবেল শব্দে মানুষ তার শ্রবণশক্তি চিরতরে হারিয়ে ফেলতে পারে। ঢাকা শহরের মানুষ কি ধরণের বিপদের মুখে আছে সেটি সহজেই অনুমান করা যায়। 
যারা দিনের বেশিরভাগ সময় অতিমাত্রায় শব্দপ্রবণ এলাকায় অবস্থান করেন তাদের ক্ষেত্রে প্রভাবটা উপলব্ধি করা যায়। গণমাধ্যমের সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় ৫০ ভাগের অধিক ট্রাফিক পুলিশ কানে কম শুনেন, সমপরিমান রিক্সাচালকরা ভুগছেন নানাবিধ শব্দদূষণ জনিত জটিলতায়। পরিবেশ অধিদফতরের এক জরিপে উঠে এসেছে, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতোমধ্যে দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, সারা দেশে ২০ শতাংশ মানুষ বধিরতায় আক্রান্ত। এর প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু। আর যারা ট্রাফিক পুলিশ, তাদের ১১ শতাংশের শ্রবণ সমস্যা আছে। অন্য এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের ৬১ শতাংশ মানুষ শব্দদূষণের জন্য হতাশা ও উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যায় ভুগছে।
বলা হয়ে থাকে বৈশ্বিকভাবে শব্দ দূষণের কারণে বার্ষিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমান আর্থিক ক্ষতি হয়। যার মধ্যে রয়েছে উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া, স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেড়ে যাওয়া, সম্পত্তির দাম কমে যাওয়া, পর্যটনের ও পরিবেশগত ক্ষতি, অভিযোজন খরচ ইত্যাদি। ইউরোপের ইউরোসাইট নামক প্রতিবেদন মতে শব্দ দূষণের কারণে প্রতি বছর ইউরোপের আর্থিক ক্ষতির পরিমান ৪০ বিলিয়ন ইউরো। গবেষণা সংস্থা সিএনবি এর স্টাডিমতে ফ্রান্সের প্রায় ২.৫ কোটি মানুষ শব্দ দূষণের কারণে মারাত্বকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন। এ স্টাডিমতে মোট শব্দ দূষণের ৬৮.৪% পরিবহন সেক্টর হতে উদ্ভূত এবং সামাজিক ক্ষতির পরিমান প্রতি বছর ১০৬ বিলিয়ন ইউরো সমপরিমান। ইউরোপের পরিবেশবাদী সংস্থা (ইইএ) এর মতে শব্দদূষণে ইউরোপে প্রতি বছর ১২ হাজার জনের অকালমৃত্যু ঘটায় এবং ৪৮ হাজার জনকে হৃদরোগ সংক্রান্ত সমস্যায় চিকিৎসা নিতে বাধ্য করে। আর শব্দ দূষণ ইউরোপের ২ কোটি মানুষের বিরক্তির কারণ। আরেক গবেষণা মতে স্পেনের বার্সোলনা শহরে ট্রাফিক জনিত শব্দদূষণ প্রতিবছর ৩০০ হার্ট এ্যাটাক এবং ৩০ জনের মৃত্যুর কারণ। 
আমাদের নাগরিক জীবনে যে শব্দ দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রায় সবটুকুই মানুষের সৃষ্টি এবং এর অধিকাংশই চেষ্টা করলে নিবারণ করা সম্ভব। মটর সাইকেলের বা গাড়ির হর্ণ, অটো রিক্সার হর্ণ, মাইকিং, সাউন্ড বক্সের ব্যবহার ইত্যাদির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে শব্দ দূষণকে কমিয়ে আনা সম্ভব। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, হাসপাতাল ও স্কুল জোনে সচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রম জোরদার করণের মাধ্যমে শব্দ দূষণ হ্রাস করা সম্ভব। 
পরিবহন সেক্টরের শব্দ নিয়ন্ত্রণ, সঠিক নগর পরিকল্পনা, রাস্তার শব্দ নিয়ন্ত্রণ, শব্দ হ্রাসকারী আধুনিক ভবন নির্মাণ, বিমানের শব্দ কমানো, নির্দিষ্ট এলাকার জন্য জোনিং কোডের ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ম প্রয়োগ করে কিছুটা হলেও শব্দ প্রশমণ করা সম্ভব। ব্যক্তিগত পর্যায়ে শব্দের চাপ কমাতে ইয়ারপ্লাগ ব্যবহার করা যেতে পারে, যা কানের পর্দার ক্ষতি প্রতিরোধ হবে। যেসব শিল্প কারখানা তাদের যন্ত্রপাতি থেকে প্রচুর শব্দ উৎপন্ন করে, সেসব শিল্প কারখানায় শব্দরোধী উপকরণ ব্যবহার করা উচিত। আশপাশে রাস্তা, যানজট কিংবা অতিরিক্ত গাড়ি চলাচল করে এমন জায়গায় যাদের বাড়িঘর আছে তারা শব্দরোধী জানালা ব্যবহার করে শব্দদূষণের ক্ষতি কমাতে পারেন। শিল্প ও নির্মাণ শ্রমিকদের শব্দদূষণের ক্ষতি কমাতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। গাছ লাগিয়ে শব্দদূষণ কমানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
শব্দদূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বর্তমানে শব্দদূষণ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা খুবই আশংকাজনক। টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা ২০৩০ (এসডিজি) বিষয়ক উন্নয়ন এজেন্ডায় সসসাময়িক চ্যালেঞ্জসমূহের পরস্পর আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিয়ে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমন্বিত ও অংশগ্রহণমুলক পদ্ধতি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এর ১১ নং লক্ষ্যমাত্রাটিতে টেকসই নগর বিষয়ক সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। একটি শহর টেকসই হওয়ার অর্থ হলো সেখানে কর্মসংস্থান ও বাণিজ্য বৃদ্ধি, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী আবাসন এবং একটি ঘাতসহনশীল সমাজ ও অর্থনীতির নিশ্চয়তা থাকবে। এ ধরনের শহর প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হবে মানসম্মত গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ বান্ধব খোলা জায়গার সংস্থান ইত্যাদি। আধুনিক ও স্মার্ট নগর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে বায়ু ও শব্দদূষণ রোধ করা একটি অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত। 
শব্দ জনিত দূষণ বিষয়ক সমস্যা সমাধানে বা এ থেকে উত্তরণে বিশ্বব্যাপী অনেক কাজ হচ্ছে। বিশেষ করে শব্দের মান মাত্রা নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। দেশে দেশে আইন ও বিধিমালা প্রণীত হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা (২০০৬) অনুযায়ী, নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প এলাকা এরকম জায়গার ক্যাটাগরি অনুযায়ী দিন ও রাতের জন্য আলাদা আলাদাভাবে শব্দের 'মানমাত্রা' বা স্ট্যান্ডার্ড লেভেল নির্ধারণ করা আছে। তবে আইন কানুন বা বিধিমালা যাই থাকুক না কেন, এ সমস্যা সমাধানে নাগরিকদের সচেতনতাবোধ জাগ্রত করাটাই হচ্ছে মুখ্য বিষয়। আমাদের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির বিষয়টি যখন আমরা অনুধাবন করতে পারবো তখনই এ সমস্যা সমাধানের পথ সহজ হবে। আসুন সচেতন হই, একটি সহনীয় ও আনন্দময় সুমিষ্ট শব্দের পৃথিবী গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখি।
লেখকঃ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।












সর্বশেষ সংবাদ
বর্ষবরণে বর্ণিল আয়োজন
কলকাতায় ‘সেরা বাঙালি সম্মাননা’ পেলেন বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের প্রেসসচিব তারিক চয়ন
কুমিল্লায় যৌথবাহিনীর অভিযানে বিদেশি রাইফেল, শটগান উদ্ধার
লালমাইয়ে ছিলোনিয়া দিঘি থেকে মানুষের মাথার খুলি ও হাড় উদ্ধার
জায়গা দখল সংক্রান্ত বিষয়ে লাকসামের মজির আহমেদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
জায়গা দখল সংক্রান্ত বিষয়ে লাকসামের মজির আহমেদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ
তিতাসে প্রবাসী স্বপন হত্যা মামলার আসামি দুই সহোদর গ্রেপ্তার
‘মনে হচ্ছে, সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে’
ইরানে হামলায় ৮ পাকিস্তানি নিহত
কলকাতায় ‘সেরা বাঙালি সম্মাননা' পেলেন বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের প্রেসসচিব তারিক চয়ন
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২