আমার
এই নিবন্ধটি যেদিন প্রকাশিত হচ্ছে, সেই দিনটি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম
প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের গতকাল পর্যন্ত ৮৯তম
দিন। গত ২০ জানুয়ারি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। এতে
দেখা যায়, রাষ্ট্রক্ষমতায় এখনো তাঁর ১০০ দিন পূর্ণ হয়নি। বর্তমান অর্থনৈতিক
বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে সব দিক থেকে আবার বিশ্বের
এক নম্বরে পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন দেশের ওপর বর্ধিত হারে রপ্তানি কর আরোপ
করার কথা ঘোষণা করেন ২ এপ্রিল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ধারণা, চীন,
ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোতে
যুক্তরাষ্ট্রকে সীমাহীনভাবে ঠকিয়ে গেছে, কিন্তু আর নয়। এবার দ্বিতীয়
মেয়াদের জন্য ক্ষমতায় এসেছেন তিনি। সুতরাং অতীতের সব অসামঞ্জস্যপূর্ণ
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকর বন্ধ করতে হবে। যে কথা, সেই কাজ।
যুক্তরাষ্ট্রের
ওপর চীনের চাপানো করের পরিমাণ ছিল ৮৪ শতাংশ। তার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র
চীনের ওপর প্রথমে ১২৫ শতাংশ এবং দ্বিতীয় দফায় তা বাড়িয়ে করল ২৪৫ শতাংশ।
তিনি তাঁর নির্বাহী আদেশে ভারত, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর
নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী বর্ধিত বাণিজ্যকর চাপালেন। ৯ এপ্রিল ট্রাম্পের নতুন
শুল্কনীতি বাস্তবায়িত হয়ে দৈনিক গড়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুই বিলিয়ন ডলার আদায়
হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হলো তার বিপরীত।
ট্রাম্পের ঘোষিত নতুন আচমকা
শুল্কনীতিতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল বিশ্বের বাণিজ্য বাজার। এতে দেখা গেল,
প্রথম তিন দিনে স্টক, বন্ড ও শেয়ারবাজারে যুক্তরাষ্ট্র হারিয়েছে ১০
ট্রিলিয়ন ডলার। এই অচিন্তনীয় আঘাতে ট্রাম্প তখন তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর ঘোষিত
শুল্কনীতি ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করলেন। ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্কনীতির পরিণতি
নিয়ে প্রথমেই তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের
অর্থনীতি বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক রিচার্ড ওলফ। তিনি বলেছিলেন, ট্রাম্পের
ঘোষিত বাণিজ্যযুদ্ধ অতি দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রে এক অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে আনবে।
দ্রব্যমূল্য
বৃদ্ধি পাবে অসহনীয় হারে। অন্যদিকে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের
অর্থনীতির অধ্যাপক জেফ্রি স্যাকস বলেছেন, ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্কনীতিতে
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ধসে পড়বে। এতে চীনের জন্য মহাবিপদ ডেকে আনবে না।
তবে বিশ্বের বর্তমান অর্থনীতি ও বাজার ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। এতে
এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মধ্যে গড়ে উঠবে নতুন কর ও বাজার
ব্যবস্থা।
যুক্তরাষ্ট্র কি ট্রাম্পের কাছে হেরে যাবেঅধ্যাপক জেফ্রি
স্যাকস তাঁর জীবনের একটি দীর্ঘ সময় হোয়াইট হাউস, বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের
উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। রাশিয়াসহ সাবেক সোভিয়েত ব্লকের বিশেষ উপদেষ্টা
হিসেবেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। অর্থনীতির বিশাল ক্ষেত্র ছাড়াও জেফ্রি
স্যাকস একজন রাজনীতি ও কূটনীতি বিষয়ের বিশ্লেষক হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন
করেছেন। বিশ্বের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতি, মধ্যপ্রাচ্য সংকট এবং বিশেষ করে
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য তিনি সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
সাম্রাজ্যবাদী নীতিকে দায়ী করেছেন। শুধু তা-ই নয়, জেফ্রি স্যাকসের মতে,
যুক্তরাষ্ট্রের অপরিণামদর্শী শুল্কনীতি কিংবা বাণিজ্যযুদ্ধ এবং অন্যদিকে
সাম্রাজ্যবাদী কায়দায় রাজনৈতিক প্রভাববলয় সৃষ্টি করার পরিকল্পনা বিশ্বকে
ক্ষমতার বহু ভরকেন্দ্র সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে। বৈশ্বিক দক্ষিণের অর্থাৎ
ব্রিকসের উত্থানকে ত্বরান্বিত করবে আশাতীতভাবে। চীন অর্থনৈতিক
প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সামরিক আধিপত্যের ক্ষেত্রেও আগামী
এক দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। তা ছাড়া আঞ্চলিকভাবে সহনশীল
অবস্থা বজায় রাখতে পারলে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। ইহুদিবাদী
ইসরায়েলের অযৌক্তিক তোষণনীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের
প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলতে পারে। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে যে
পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, সেটি সম্ভব হবে না বলে জেফ্রি মনে করেন। কারণ
শেষ বা চূড়ান্ত বিবেচনায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন কিংবা অন্যান্য রুশ
নেতা চীনের সঙ্গে সার্বিক সম্পর্ককে অবহেলা কিংবা অগ্রাহ্য করতে পারবেন না
কোনোভাবেই। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ঋণের পরিমাণ বর্তমানে ৩৭ ট্রিলিয়ন
ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই বিষয়টি এবং বিশেষ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে
যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাণািজ্য ঘাটতি ট্রাম্পকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে
তুলেছে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের
মধ্যে বর্তমানে যে সখ্য বা সমঝোতা গড়ে উঠেছে, অধ্যাপক জেফ্রি স্যাকস তা
হিতে বিপরীত হতে পারে বলে মনে করেন। এই অবস্থায় ইহুদিবাদী ইসরায়েলের
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্ররোচনায় ট্রাম্প যদি ইরান আক্রমণে
এগিয়ে যান, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল উভয়েরই অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে
পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অপরিণামদর্শী বা অপরিকল্পিত
শুল্কনীতি ও বাণিজ্যযুদ্ধ চীনের জন্য নতুন একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
আঞ্চলিকভাবে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীন একদিকে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে
একটি বলিষ্ঠ অংশীদারিতে পৌঁছেছে, অন্যদিকে দূর প্রাচ্যে আসিয়ান অর্থনৈতিক
জোটের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার কৌশল নিয়েছে। তদুপরি বেল্ট
অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় চীন দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া,
নাইজেরিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও উন্নয়ন ভিত্তিক ব্যাপক
কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। চীন বর্ধিত হারে ঢুকছে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন
উন্নয়নকামী দেশেও। এ ক্ষেত্রে ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা, আর্জেন্টিনাসহ অন্যদের
সঙ্গে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় আবদ্ধ
হচ্ছে প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের চীন। সুতরাং অসামঞ্জস্য শুল্কনীতি কিংবা
নতুন বাণিজ্যযুদ্ধের হুমকি-ধমকি দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনকে কাবু করতে
পারবেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন না। এ ব্যাপারে চীনের এক মুখপাত্র সম্প্রতি
বলেছেন, ‘বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আমরা অতীতে পাঁচ হাজার বছর টিকে
ছিলাম এবং ভবিষ্যতে আরো পাঁচ হাজার বছর টিকে থাকতে আমাদের অসুবিধা হবে না।’
স্পেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন সদস্যভুক্ত দেশ এখন বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও
শিল্প স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে চীনের দিকে ধাবিত হওয়া শুরু করেছে। এর
সূচনালগ্নেই ডলারের বিকল্প হিসেবে চীন এখন ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থা চালু
করার ঘোষণা দিয়েছে, যা অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক লেনদেন সম্পন্ন
করতে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে ডলারের আধিপত্য বজায় রাখার দিন এমনিতেই শেষ হয়ে
আসছে। তা ছাড়া চীনের রেনমেনবির পাশাপাশি ইউরো কিংবা রুবলও বিকল্প মুদ্রা
কিংবা বিনিময় মূল্য হিসেবে গৃহীত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নেহাত হুমকি-ধমকি দিয়ে
ট্রাম্প ডলারের আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হবেন না। কারণ তিনি নিজেই বিভিন্ন
পন্থায় প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে একঘরে হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মার্কেট ইকোনমির (বাজার অর্থনীতি) পরিবর্তে আবার ধনতন্ত্রের আদি ব্যবস্থা
‘কমান্ড ইকোনমি’ বা চাপিয়ে দেওয়ার অর্থনীতি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তি যেমন
ভিয়েতনাম, ইরাক কিংবা আফগানিস্তানে খাটেনি, তেমনি চলবে না অগ্রসরমাণ
বর্তমান বিশ্বের অন্য কোথাও।
নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন হয়েই ট্রাম্প
ঘোষণা করেছিলেন বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তিনি
যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপানো বাড়তি করের পরিমাণ পারস্পরিকভাবে সমন্বয় করবেন।
কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে দেখা গেল এক অবিশ্বাস্য চিত্র। ট্রাম্প চীনের ১২৫
শতাংশকে বাড়িয়ে দ্বিতীয় দফায় করলেন ২৪৫ শতাংশ। আর চীন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর
চাপানো করের পরিমাণ ৮৪ শতাংশেই রেখে দিল। নতুন বাড়তি শুল্ক ঘোষণার তিন দিন
পর ট্রাম্প যথারীতি তা স্থগিত করলেও শুধু চীনের ব্যাপারে তা প্রযোজ্য হলো
না। ট্রাম্প চাইছিলেন এ ব্যাপারে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং তাঁকে ফোন
করে বিভিন্ন বিষয় ফায়সালার জন্য অনুরোধ জানান, কিন্তু ৯০ দিনের জন্য স্থগিত
হয়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া বাড়তি করের বোঝা মেনে নিতে
প্রেসিডেন্ট শি কোনোমতেই রাজি হননি। চীনের ধীরস্থির নেতা শি চিনপিং এখনো
কোনো উগ্র মন্তব্য করেননি এবং ট্রাম্পের বর্তমান আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
লড়াইয়ে কোনো বিরূপ বা দৃষ্টিকটু আচরণ করেননি। এতে প্রেসিডেন্ট শির
নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বনেতারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এরই মধ্যে চীন তাদের
বিমান সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে, তারা যেন যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং
কম্পানির কাছে কোনো নতুন বিমান অর্ডার না করে। চীন যুক্তরাষ্ট্রের
কম্পানিগুলোর কাছ থেকে যেকোনো ধরনের যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম কেনা বন্ধের
নির্দেশ দিয়েছে। বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বোয়িংয়ের যন্ত্রাংশ ও বিমানের দাম
এখন চীনের জন্য প্রায় দ্বিগুণ হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
হবে। কারণ বিশ্বে বোয়িংয়ের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে চীন। চীন এখন
পর্যায়ক্রমে হলিউড ফিল্ম থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পণ্য আনা
বন্ধ করছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটারসহ ইলেকট্রনিক
পণ্যসামগ্রীর বেশির ভাগ আমদানি করে চীন থেকে। চীন সে রপ্তানি বন্ধ করে দিলে
ইলেকট্রনিক পণ্যসামগ্রী যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে
চলে যাবে বলে বাজার বিশ্লেষকদের ধারণা। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৫৬ শতাংশ
মানুষ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্কনীতি কিংবা চীনের বিরুদ্ধে
বাণিজ্যযুদ্ধের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছে। ট্রাম্প এরই মধ্যে চীন থেকে
আমদানি করা ইলেকট্রনিক পণ্যসামগ্রীর ওপর সম্পূর্ণভাবে কর উঠিয়ে দেওয়ার
ঘোষণা দিলেও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রবাসী সন্তুষ্ট নয়। কারণ
দিনে দিনে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের
বিশিষ্ট বিলিয়নেয়ার রে ডালিউ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে শুধু মূল্যস্ফীতি নয়,
শিগগিরই এক মহামন্দা দেখা দিতে পারে।
বর্তমানে অত্যন্ত উত্তপ্ত
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পরিস্থিতি নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি বলেছেন, বাড়তি
শুল্ক আরোপ কিংবা বাণিজ্যযুদ্ধে কেউ কখনো জিততে পারে না। কারণ তাতে সব কিছু
বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বাড়তি করারোপের বিষয়টি আলোচনা সাপেক্ষে ফায়সালা করতে
হয়। সে কারণে তিনি ট্রাম্প ঘোষিত সম্পূর্ণ শুল্কনীতিটি অবিলম্বে বাতিল করে
দিতে পরামর্শ দিয়েছেন। এভাবে সাম্রাজ্যবাদী কায়দায় চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন
দেশের ওপর বাড়তি কর চাপিয়ে না দিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে এই
স্পর্শকাতর বিষয়টি সুরাহা করার পরামর্শ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের
অনেক খ্যাতিমান অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিশ্লেষক। বিশ্লেষকরা বলছেন,
বিশ্ববাণিজ্য ও বাড়তি শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের বর্তমান গোঁয়ার্তুমি শেষ
বিচারে মোটেও ঠিকবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বর্তমানে চীন ছাড়া
প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী আমদানির বিশেষ কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই। এই
পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় বিকল্প উৎপাদন ব্যবস্থা কার্যকর করতেও
যুক্তরাষ্ট্রের ১০ থেকে ২০ বছর সময় লাগতে পারে। এতে বৈশ্বিক মুক্তবাজার
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় চীন আরো অনেক এগিয়ে যাবে বলে
পর্যবেক্ষকদের ধারণা। ২০২৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ক্ষেত্রে
তাদের আধিপত্য হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে একমাত্র
সামরিক ক্ষেত্র ছাড়া কোনো দিকেই চীন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের খুব একটা
পেছনে নেই। আগামী ১০ বছরের মধ্যেই চীন বিশ্বের নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে এক
নম্বর অবস্থানে চলে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। এই জটিল পরিস্থিতিতে
অনেক আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষকের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্র সার্বিক পরিস্থিতি
বেগতিক কিংবা তার হাতের নাগালের বাইরে চলে যেতে দেখলে সংঘর্ষ বাধিয়ে বসতে
পারে, যা শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত হতে পারে। সেটি ইউক্রেন
কিংবা বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান আক্রমণের মধ্য দিয়েও সূত্রপাত হতে
পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত মিত্র ইহুদিবাদী ইসরায়েল ছাড়া ইউরোপের
বিশেষ কোনো দেশকে খুঁজে পাবে না। অনেকে মনে করেন, এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে
পারে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং আরো দু-একটি দেশ। কিন্তু ইরানের মিত্র
চীন, রাশিয়া, তুরস্ক ও ইসলামী শক্তি সে পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধভাবে
মাঠে নামবে বলে অনেকের ধারণা। ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের পরিকল্পনা তখন
পূর্ণাঙ্গভাবে সামরিক যুদ্ধে রূপান্তরিত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তখন একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
চীনের
সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বর্তমানে বছরে প্রায় ২৯৫ বিলিয়ন
ডলারের মতো। যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে আমদানি করে ৪৩৯ বিলিয়ন ডলারের
পণ্যসামগ্রী। অন্যদিকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আমদানি করে ১৪৪ বিলিয়ন
ডলারের মতো। এই বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমে ক্রমে প্রতিবছর বেশ কিছুটা কমিয়ে
আনা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেটি না করে যে পথ বেছে নিয়েছে,
তা মূল সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনের বিরুদ্ধে এক
অপরিণামদর্শী বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করতে গিয়ে বৈশ্বিকভাবে যে বাড়তি শুল্কনীতি
ঘোষণা করেছে, তাতে তাৎক্ষণিকভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের মতো
উন্নয়নশীল ছোট ছোট দেশ। কারণ এমনিতেই তারা কভিড-পরবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতি
সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্য ছিল
তাদের ক্রমে ক্রমে অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেওয়ার একটি নির্ভরযোগ্য উপায়।
গণতন্ত্র
ও মানবাধিকারের প্রবক্তা এবং অন্যদিকে মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারক ও বাহক
যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে আর কোনো সহযোগিতা ও
আশার আলো দেখাতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করে তার সার্বিক নীতি-নৈতিকতা
কিংবা আদর্শ ও পররাষ্ট্রনীতিকে পাশ কাটিয়ে এখন একলা চলার নীতি বেছে নিতে
যাচ্ছে। এতে কি যুক্তরাষ্ট্র তার পরাশক্তিগত আধিপত্য কিংবা মুক্তবিশ্বের
প্রবক্তা বা নেতা হিসেবে কাক্সিক্ষত ভূমিকা ধরে রাখতে পারবে? এই অবস্থায়
আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষকদের প্রশ্ন হচ্ছে, কী নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র
ভবিষ্যতে টিকে থাকতে চায়? কী হবে তার আর্থ-রাজনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতির মূল
বৈশিষ্ট্য? তাহলে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র কি তার বৈশ্বিক কিংবা
আন্তর্জাতিক ভূমিকা পালন কিংবা নেতৃত্ব থেকে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যেতে চায়? এ
ধরনের হাজার প্রশ্নের মধ্যে বর্তমান সময়টি অতিবাহিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে
অনেকে মনে করেন, ট্রাম্পের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ববাসীর বেশি প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হতে পারে না।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক