বৃহস্পতিবার ২৪ এপ্রিল ২০২৫
১১ বৈশাখ ১৪৩২
জনসংখ্যাধিক্য: মূল সমস্যাগুলোর বড় কারণ
মাসুদ আহমেদ
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৫, ১:০৪ এএম আপডেট: ২৪.০৪.২০২৫ ২:০১ এএম |



 জনসংখ্যাধিক্য: মূল সমস্যাগুলোর বড় কারণ
আমরা আমাদের ব্যক্তিগত, ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগত জীবনে প্রতিদিনই কয়েকটি সাধারণ সমস্যার কথা বলে থাকি। যেমন- নদীদূষণ- দুর্গন্ধে ও বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। উপচে পড়া মানুষের ভিড়ে শহর ও গঞ্জ তো বটেই, এখন গ্রামেও শরীরে শরীরে ধাক্কা দেওয়া ছাড়া চলার পথ নেই। শহরে রাস্তা থাকার কথা আয়তনের ২৫ ভাগ কিন্তু তা কমতে কমতে এখন মাত্র ৬ ভাগে এসে ঠেকেছে। যানজটে সড়কে যান চলাচলের গতি কমতে কমতে ঘণ্টায় গড়ে সাড়ে ৪ কিমিতে এসে ঠেকেছে। গুলশানের লেক, বনশ্রীর লেক কিংবা বুড়িগঙ্গার পানিতে একই দুর্গন্ধ। একজন উপদেষ্টা সেদিন বললেন যে বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে চলতে হলে কেবল আতর দিলেই হয় না, নাকে রুমালও দিতে হয়। আবার জাতিক এবং আন্তর্জাতিক সংবাদে প্রায় প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে ঢাকা শহর বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর। এর পেছনে রয়েছে গৃহস্থালি বর্জ্য ও শিল্পবর্জ্যের স্তূপ, নানাবিধ শব্দদূষণ এবং যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও প্রচণ্ড তাপ উদগীরণের সমাহার। পরিবেশের এই  মান। ফুটপাত ফেরিওয়ালাদের দখলে, ফলে পথচারীরা নেমে আসছেন রাস্তায়। মানুষের ভিড়ে রাস্তায় যানবাহন চলতে পারছে না। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য সুধীজনরা প্রায় প্রতিদিনই সেমিনার করে নানা পরামর্শ ও উপদেশ বিতরণ করছেন। তার একটি বড় উপাদান হলো এই যে সচেতনতার মাধ্যমে নাকি এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব। যেমন যানজট দূরীকরণের ব্যাপারে বলা হয় ব্যক্তিগত গাড়ি পরিহার করে গণপরিবহণ বৃদ্ধি করে তাতে চড়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যাও। কথা হলো, মানুষের যদি সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়, তা পরিবার-পরিজন নিয়ে গণপরিবহনের ভিড় ও ধস্তাধস্তির মধ্যে আরোহণ করে প্রকৃত গন্তব্যের অনেক আগেই তা থেকে নেমে যাওয়ার জন্য নয়। যেমন এমআরটি চালু হয়েছে, তবে তা শহরের ২ কোটি ৬৫ লাখ লোকের মধ্যে সাড়ে ৬ লাখ লোকের যাতায়াতের আংশিক সমাধান দিয়েছে।
তার পরও বাকি রয়েছে গৃহ থেকে দীর্ঘপথ অসুবিধাজনক পন্থায় ভ্রমণ করে এতে আরোহণ এবং অনেক স্টেশনে নেমে একই কষ্টকর হাঁটা কিংবা যানবাহনে চড়ে প্রকৃত গন্তব্যে পৌঁছানো। পরামর্শকরা এটাও বলেন যে উন্নত দেশে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ির চেয়ে গণপরিবহনের ওপর বেশি নির্ভরশীল। কথাটায় বড় অসত্য রয়েছে। যেকোনো উন্নত দেশে পরিবারপ্রতি গড়ে ব্যক্তিগত মোটরগাড়ির সংখ্যা ৩.৫টি করে। এর পাশাপাশি তারা গণপরিবহন ব্যবহার করেন বড় দূরত্বগুলো পার হওয়ার জন্য। নদী বেআইনিভাবে শিল্পপতিরা ব্যবহার করার ফলে নদীর গতিপথ এবং পানিপ্রবাহ সংকুচিত হয়ে নৌ চলাচলের এবং মাছ চাষের অসুবিধা সৃষ্টি করছে। এ কথা ঠিক কিন্তু এই বেআইনি কাজকে সমর্থন না করেও বলা যায় যে ওই সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সারা দেশে যে লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে এবং সীমিত আয়ের লোকদের জন্য পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হচ্ছে, সেগুলোর বিকল্প ব্যবস্থা করবার স্থান কোথায়? নদী এবং জলাশয়ে রান্নাঘরের বর্জ্যর একটা বড় অংশ সরাসরি গিয়ে পড়ছে, কারণ এগুলো ফেলার বিকল্প স্থান নেই।
মানুষের সমৃদ্ধি বাড়ছে, ফলে ভোগও বাড়ছে, ফলে বর্জ্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলোর একটি অংশ ক্রমবর্ধমান হারে যে প্রথমত পদপথে, ড্রেনের ওপর এবং শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি ও পানিবাহিত হয়ে আশপাশের নদী এবং জলাশয়ে স্থান লাভ করবে, সে কথা এই পরামর্শকদাতারা বলেন না। মহানগরের অদূরে কাওলা, কাজলাসহ আরও কিছু অঞ্চলে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরের রান্নাঘরের বর্জ্য সরকারিভাবে ফেলার ফলে সেখানে যে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে গবাদি প্রাণী ছাড়া আর কোনো প্রাণী বসবাস করতে পারে না। অথচ ময়লা ফেলার আর কোনো জায়গাও নেই। উল্লেখ্য, ময়লা বৃদ্ধি পাওয়ার সমানুপাতে এর আগে মাতুয়াইল ও গোদনাইলে এই বর্জ্য ফেলার কারণে সেগুলোতে আর কোনো ফাঁকা স্থান এখন অবশিষ্ট নেই। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীও শিল্প এবং গৃহস্থালি বর্জ্যের শেষ আশ্রয়স্থল হওয়ার ফলে সেখানকার কালো পানি দৃষ্টিকটূ এবং গন্ধ মনুষ্য নাসারন্ধ্রের সম্পূর্ণ অনুপযোগী করে তুলেছে। এসব কথা কেবল সংবাদদাতাদের প্রেরিত নয় বরং এলাকাবাসী ও দায়িত্বশীল উপদেষ্টারাও এগুলো জনপ্রিয় করছেন। যানবাহনের গতি বৃদ্ধি করা এবং উপচে পড়া ভিড়  হ্রাস করার লক্ষ্যমাত্রা পিপির ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করে এমআরটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। দৈনিক সাড়ে ৬ লাখ যাত্রী পরিবহন অবশ্যই একটি সফলতার প্রমাণ।
 কিন্তু তার পরেও এই প্রকল্প পূর্ণ উদ্যমে চালু হওয়ার পরেও প্রতিদিন ঢাকা শহরে মাটির ওপর অবস্থিত প্রায় সব সড়কেই যানবাহনের গতি কমতে কমতে এখন ঘণ্টায় সাড়ে ৪ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। সমৃদ্ধি বাড়ছে, ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়ছে। সেই গাভি থেকে কালো ধোঁয়া এবং পুনঃ পুনঃ ব্রেক কষে গাড়ি চালানোর ফলে নিঃসরিত তাপ আশপাশে এবং ওপরে দীর্ঘক্ষণ কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকার সুযোগ পাচ্ছে। দ্রুতগতিতে চলে যেতে পারলে এটা অনেক কম হতো। তার মধ্যে প্রতিদিন গাড়িবহরে নতুন সংযোজনের ফলে এই তাপ ও কালো ধোঁয়ার বৃদ্ধি বেদম সংঘটিত হয়ে চলছে। শিল্পকারখানা থেকে উদ্ভূত তরল বর্জ্য আইন প্রয়োগের মাধ্যেমে অনেকটা বা কিছুটা পরিশোধিত করে নির্ধারিত জলাশয়ে ফেলার উদ্যোগ দেখা যায়। কিন্তু তার পরেও নানাবিধ নির্মাণকাজের ফলে সব ধরনের জলাশয়ের আয়তন সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ায় এর অন্তর্ভুক্ত পানিপ্রবাহের বিশুদ্ধতা ক্রমশই কমে আসছে। কারণ এটুকু আয়তনের  জলাশয় অতগুলো শিল্পকারখানার শোধনকৃত পানি রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। আরও উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ কোনো শিল্পোন্নত দেশ নয়।
তার শিল্পের সংখ্যা এখনো হাতে গোনা। তার রপ্তানি আমদানির চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগ। কিন্তু তার পরেও এই সামান্যসংখ্যক শিল্পের বর্জ্য সারা দেশের জলাশয়গুলোকে প্রবলভাবে দূষিত করে চলছে। তা হলে শিল্পোন্নত দেশ হলে অবস্থা কী হবে, তা অনুমেয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, তিন দশক আগেই যখন অবস্থার এত অবনতি ঘটেনি, তখন এক পানিসম্পদমন্ত্রী সংকল্প প্রকাশ করে বলেছিলেন, যমুনা নদীর পানি দিয়ে বুড়িগঙ্গাকে ধুয়ে পরিষ্কার করব। 
গাছ কেটে নির্মাণকাজ করার ফলে অক্সিজেন কমছে, কার্বন-ডাই অক্সাইড বাড়ছে এবং ছায়া কমে তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার ৩৬, ৪৮ ও ৫৬ তলার ভবন নির্মাণের ফলে সেখানে দিনের বেলাও প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবেশ করতে না পেরে বৈদ্যুতিক সাজসরঞ্জাম ব্যবহার করতে হচ্ছে। ফলে তা নগরের তাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। তেমনি রান্নার কাজে ৩৩ লাখ গ্যাসের ও বৈদ্যুতিক চুলা তিনবার জ্বালানোর ফলে নগরীর তাপমাত্রা কমার ফুরসতই পাচ্ছে না। এত মানুষেরে জন্য নিচ থেকে  পানি তোলার ফলেও  ভূগর্ভস্থ  পানির স্তর বছরে ৪ ফুট করে নেমে গিয়ে পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে।  সচেতনতা সৃষ্টি, পরামর্শ প্রদান, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, প্রকৌশলী ও স্থপতিদের গবেষণা কিংবা পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের ফলে ওপরের সমস্যাগুলো যে হ্রাস পাচ্ছে না, তা গত তিন দশকের পরিসংখ্যান একটু দেখলেই বোঝা যাবে। 
প্রতিটি ক্ষেত্রে সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা এর মূল কারণের দিকে না তাকিয়ে উপসর্গগুলো নিয়ে আলোচনা করছি। এর একমাত্র না হলেও মূল কারণ হচ্ছে যে, আয়তনে খুব বেশি হলে ৫০ লাখ মানুষ  বসবাস করতে পারেন যেখানে, সেখানে ঢাকা শহরে ২ কোটি ৬৫ লাখ মানুষ বসবাস করছেন। আবার দেশের যে আয়তনে ৮ কোটি মানুষ বসবাস করতে পারেন, সেখানে বসবাস করছেন প্রায় ১৯ কোটি মানুষ। সবকিছুর একটি সর্বোচ্চ বহনক্ষমতা আছে। আমরা তাকে অতিক্রম করে গেছি অনেক আগেই। ফলে এত মানুষের চলাচল, জীবনযাপন, জীবিকা নির্বাহ, ধর্ম পালন এবং বিনোদনের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে স্থানটুকু ন্যূনতম প্রয়োজন, তা ক্রমশই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে বছরে ২২ লাখ করে মানুষ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে।
 কবরজটেও মানুষ  দিশেহারা। এটিই একমাত্র কারণ নয়, তবে অবশ্যই এটি মূল কারণ। এবং সর্বত্র সবকিছুতেই যে উপচে পড়া ভিড় তার কারণ স্থানের চেয়ে জনসংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি। জনসংখ্যাধিক্য যে দেশের ১ নম্বর সমস্যা, এটিকে এই পরিবর্তনের চমৎকার সময়ে স্বীকৃতি দিয়ে একটি নির্ধারিত তারিখ ঘোষণা করে এক সন্তানবিশিষ্ট পরিবার গঠনের আদেশ দেওয়ার কথাটি এই জনপ্রিয় সরকার বিবেচনা করবে বলে আশা করি।  তাতে ১০ বছর পরে হলেও জনসংখ্যা কমতে শুরু করে সবকিছুর ওপর প্রবল চাপ কমে পরিস্থিতি ভালো হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রজাতন্ত্রের সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল














সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লায় রেল লাইনের উপর ৩ যুবকের খণ্ডিত লাশ
ঘুম, নেশা নাকি ভাগ্য- কোনটি কেড়ে নিয়েছে এই তিন যুবকের প্রাণ?
সিলিন্ডারবাহী পিকআপ উল্টে পুকুরে গোসলরত এক কিশোরের মৃত্যু
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা জামায়াতের সাবেক আমীর খন্দকার দেলোয়ারের পাশে ইনসাফ হাউজিং এন্ড ডেভেলাপার্স
কুমিল্লা শহরের পূর্বাংশে শুক্রবার ও পশ্চিমাংশে সোমবার দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশনা
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় রেল লাইনের উপর ৩ যুবকের খণ্ডিত লাশ
ঘুম, নেশা নাকি ভাগ্য- কোনটি কেড়ে নিয়েছে এই তিন যুবকের প্রাণ?
কুমিল্লা শহরের পূর্বাংশে শুক্রবার ও পশ্চিমাংশে সোমবার দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশনা
সিলিন্ডারবাহী পিকআপ উল্টে পুকুরে গোসলরত এক কিশোরের মৃত্যু
মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি গ্রেপ্তার
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২